
প্রিন্ট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০৮ এএম
আরও পড়ুন
মার্কিন পণ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা প্রত্যাহার, ট্যারিফ এবং বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসসহ সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে দ্বিতীয় ‘রোডম্যাপ’ বা কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হবে ইউএসটিআর ডিপার্টমেন্টের কাছে। এসব কার্যক্রম আগামী তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
সূত্রমতে, তিনটি শর্ত দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে তা স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে শর্তগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ ও অশুল্ক বাধা আছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এ নিয়ে কাজ করছে। মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যেসব শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তা শনাক্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে সংস্থাটি। এরপর তা প্রত্যাহার করে ইউনাইটেড স্টেটস অব ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভকে (ইউএসটিআর) অবহিত করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চার থেকে পাঁচটি পণ্য বাংলাদেশের বাজারে রপ্তানি করছে। যার মধ্যে সয়াবিন শূন্য শুল্ক, তুলা শূন্য শুল্ক, স্টিল ও মেশিনারিজ ৪ থেকে ১৫ শতাংশ। তবে অ্যালকোহল আমদানির ওপর ৬০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ আছে। কিন্তু অ্যালকোহল মাত্র কয়েক বোতল আমদানি হচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মার্কিন পণ্যে গড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ আছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে বাংলাদেশ। এ হিসাবটি সঠিক নয়। এখন আলোচনার মাধ্যমে সঠিক হিসাবটি তুলে ধরা হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, তিন মাসের জন্য শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি স্পেস তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের আলোচনার মৌলিক জায়গা হচ্ছে ইউএসটিআর ডিপার্টমেন্ট। আমাদের কর্মপরিকল্পনাগুলো সেখানে তুলে ধরা হবে। তবে আমাদের অর্থনীতির ব্যাপ্তির সুযোগ রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনে এর সমাধান করব। বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, ট্যারিফ ইস্যু নিয়ে টিকফা বৈঠকে আলোচনার বিষয় নয়। যে কারণে টিকফা ফোরামে এটি আলোচনা করা হবে না। তার মতে, যেসব দেশের সঙ্গে টিকফা চুক্তি আছে তাদের ওপরও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে তা পরে তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে। চীন বাদে অন্য ১৮৫ দেশের ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে সরকার ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিতের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম রোডম্যাপের প্রথম সফলতা হিসাবে দেখা হচ্ছে। এখন যে তিন মাস সময় মিলছে তার মধ্যে দ্বিতীয় রোডম্যাপের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র মতে, শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ার পরও বিদেশি ক্রেতারা এক ধরনের পণ্যে ছাড় (ডিসকাউন্ট) চাচ্ছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে। যদিও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এখন আর আগের মতো ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। ব্যবসায়ীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলা, সয়াবিন, এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। অবশ্য শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরপরই দেশের তৈরি পোশাক খাতের বেশ কিছু অর্ডার বাতিল হয়। বিদেশি ক্রেতারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আরও অর্ডার বাতিল করতে পারেন এমন শঙ্কাও উদ্যোক্তাদের ভেতর কাজ করছিল। উদ্যোক্তারা জানান, রপ্তানির উদ্দেশ্যে পণ্যের গায়ে মূল্যের ট্যাগ লাগানোর কাজ হয়েছে। ফলে পুরোনো মূল্যে এসব পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। তবে তিন মাসের জন্য এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিতের কারণে শঙ্কা অনেকটা কেটেছে বলে উদ্যোক্তারা মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শুক্রবার যুগান্তরকে জানান, ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে শুল্ক ইস্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আলোচনা করতে পারবে। এ শর্ত দিয়ে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। এখন আশা করছি আলোচনার মাধ্যমে ভালো কিছু পাব। এক্ষেত্রে সরকার যেন ফলপ্রসূ আলোচনা করে। সেটি হলে আমরা ভালো কিছু সুবিধা বের করে আনতে পারব। তিনি আরও বলেন, মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে। এতে সয়াবিন, তুলা, এলএনজি আমদানি বাড়বে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহার করে এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ ট্যারিফ সুবিধা পাওয়া যায় সেটি বলতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
সূত্রমতে, ইউএসটিআর অফিসের সঙ্গে বুধবার একদফা বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
সরকারের হিসাবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮.৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) মার্কিন ডলারের পণ্য। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ২.২ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট আমদানির ৭৫ শতাংশ হচ্ছে তুলা, লোহার স্ক্র্যাপ, সয়াবিন এবং জ্বালানি পণ্য। এছাড়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলার রেমিট্যান্স পাচ্ছে যা মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ। অপরদিকে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিনিয়োগ মাত্র ১৭ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক মোকাবিলায় বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে পুরোপুরি নজর দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্য অর্থাৎ কোনো শুল্ক নেই। বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনের আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অব বাংলাদেশ (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতিকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আমি বিশ্বাস করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে, তবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তা সহায়ক হতে পারে। দেশে আন্তর্জাতিক নিবন্ধন পরিকল্পনা (আইআরপি) বিধিমালায় দুর্বলতা আছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য একাধিক মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় এবং মনোযোগ প্রয়োজন। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য এ দেশে নকল করে ফেলতে পারে। সে শঙ্কা থেকেও এখানে রপ্তানি করতে চান না সে দেশের উদ্যোক্তারা। এছাড়া বন্দর ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি আমেরিকা থেকে সরকারি কেনাকাটা বাড়াতে হবে।