
প্রিন্ট: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪০ পিএম
অনুসন্ধান
ঈদে টার্গেট ৫০ কোটি টাকার মাদক বিক্রি
সাভারের বেদেপল্লিতে ২শ স্পটে বেচাবিক্রি

মতিউর রহমান ভান্ডারী, সাভার
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সাভারের বেদেপল্লির মাদক ব্যবসায়ীরা অন্তত ৫০ কোটি টাকার মাদক বিক্রির টার্গেট নিয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা এরই মধ্যে বেদেপল্লির দুই শতাধিক স্থান চিহ্নিত করে মাদক বিক্রি শুরু করেছে।
এর আগে দৈনিক যুগান্তরে ২ ডিসেম্বর ‘বেদেপল্লির ৯ সাপুড়ের হাতে মাদকের চেরাগ’ এবং ৬ ডিসেম্বর ‘সাপের বাক্সে আসছে মাদকের চালান’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। মাসখানেক পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যস্থতায় বেদেপল্লিতে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। এ সংক্রান্ত ৬টি অডিও আলাপ যুগান্তরের হাতে এসেছে। একটি অডিওতে এক এক ব্যবসায়ীকে বলতে শোনা যায়, আত্মগোপনে থাকা অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ী সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান অভির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে অভি মাদক ব্যবসায়ীদের আবার বেদেপল্লিতে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। পরে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তাকে মাসে ৬ লাখ টাকা করে দিতে হবে। নিশ্চয়তা পেতে মাদক ব্যবসায়ীরা রাকিবের মাধ্যমে এই টাকা পৌঁছে দেবে। অন্য ৫টি রেকর্ডিংয়েও প্রায় একইরকম কথা শোনা গেছে।
ওবায়দুর রহমান (অভি) যুগান্তরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশেষ কারণে আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বেদে সম্প্রদায়ের বেশকিছু লোক এ ধরনের অপপ্রচার চালাতে পারে। আমি নিজেকে মাদকবিরোধী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেছি। মূলত আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বক্তারপুর মজির মার্কেটের পাশে ও কাঞ্চনপুর বাবলু মিয়ার বাড়ির কাছে বেলতলায় অফিকোল মিয়া, ইন্না মিয়া, ইমরান মিয়া, রাকিব মিয়া, পাতাল মিয়া, অঞ্জনা বেগম, মামুন মিয়া, হৃদয় মিয়া, সোহাগ, আরমান, লুৎফর, আমিরসহ অন্তত ১৫ জন হেরোইন ও ইয়াবা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করছে। এরা সবাই মাদক ডিলার আরিফ মিয়ার লোক।
ইয়াবা, হেরোইন ও গাজা ডিলার রুস্তম মিয়া। তিনি আতাউর মেম্বারের বাড়ির পাশে, তিন রাস্তার মোড়ে, ঘোরাদিয়া মহল্লায় ব্রিজের পাশে এনাম মিয়া, আল আমিন মিয়া, ইসমাইল, সাদ্দাম, মনতাজ, হাতকাটা হারুন, মান্নান, ধলা, ভিমলা, ওয়ানুর, আয়শা, মনিরুলসহ অন্তত ১৫ জনের মাধ্যমে খুচরা ও পাইকারি দামে মাদক বিক্রি করে আসছে।
পোড়াবাড়ি মসজিদের সামনে, মাঝিপাড়া ও নদীর পাড়ে মোহাম্মদ আলির টেকে পাইকারি ও খুচরায় ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করে কদম মিয়া, মাহে আলম, আনা, মনা, টিটো, মৌসুমি, রুবি, শিপন, সাগর, খোকন, খাবিনুরসহ ১৫ জন। এসব খাবিনুর ডিলার শাহিন মিয়ার মাদক বিক্রি করছে। এই মাদকের ডিলার রুস্তম, শাহিন ও তার ভাই (খোকন) ঢাকা জেলা বিএনপির সহসভাপতি খন্দকার মাইনুল ইসলাম বিল্টুর অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করে। এ বিষয়ে বিল্টু যুগান্তরকে বলেন, অফিসে আসত এটা সত্য। তাদের বিষয়ে জানতে পারলাম, এখন তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করে দেব।
মাদক ডিলার ফরিদা। তিনি তার বাড়ির পাশে ও আয়াত আলীর বাড়ির সামনের রাস্তায় আবার সুযোগ বুঝে কখনো বিবির বাড়ির সামনে মাদক বিক্রি করে। তার বিক্রেতারা হলো-সেলিম মিয়া, মিজান, আতিয়া, রুবিনা, আশা, অমিতসহ দশ থেকে বারো জন।
মাদকের অন্যতম ডিলার বরজু মিয়া। তার বিক্রির সীমানা বড় এবং বিক্রেতাও অন্তত ২৫ জন। সে ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা পাইকারি দরে বিক্রি করে লস্কর মিয়ার বাড়ির পাশে, কাঞ্চনপুর বেলতলার মাঠ, জহল্লাল মিয়ার বাড়ির পেছনে মাঠ এবং সান্দারপাড়া তিন রাস্তার মোড়ে। তার বিক্রেতা হিসাবে রয়েছে-সাদ্দাম, রুকমিয়া, ছোটকু, আমির ইসলাম, ফাইটার, রবিন, সেলিম, বক্তার, মনির, নাজিরুল, রুকসানা, রোজিনা, ফেরি, ল্যাংড়া জামানসহ অন্তত ২৫ জন। তারা প্রকাশ্যে এসব মাদক বিক্রি করে আসছে।
অন্তত দুই যুগ আগে বেদেপল্লিতে প্রথম মাদক ব্যবসা শুরু করেছিল আলমগীর হোসেন। তার অসংখ্য অনুসারী রয়েছে এই পল্লিতে। তিনি নিজ বাড়ি থেকে হাকিম আসু মোল্লার বালুঘাট পর্যন্ত ছেলে রাহুল ও আলম, জামাই মেহেদি, মেয়ে রুবি এবং নজরুল, শাবানা, আজগর, মিলনসহ অন্তত ২০ জন তার মাদক পাইকারি দরে বিক্রি করে আসছে।
মাসুক মিয়া তার দোতলা বাড়ির সামনে দুই ছেলে রাজু ও সাজু এবং তার চার মেয়ের মাধ্যমে দেদারসে ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করছে। এদের বিক্রির কাজে সহযোগিতা করছে-রাকেশ, আজগর, আসলাম, নজরুল, ইমন, আকাশ, রুবেল ও গ্যাদা আরিফ।
আলমগীরের মাদক বিক্রেতা-আবুল মিয়া, হাকিম মিয়া, ইরফান আলি, সামসু মিয়া, ধন মিয়া, মামুন মিয়া ও তার বাবা আক্কেল। এরা সবাই নিজ বাড়ির সামনে মাদক বিক্রি করছে। কাঞ্চনপুর বেদেপল্লি এলাকায় আজিমের মাদক ঘুরেফিরে বিক্রি করে তার পরিবার। এর মধ্যে স্ত্রী রাজেদা, ছেলে- রাজিদুল ও দুই মেয়েসহ অন্তত দশ জন রয়েছে।
প্রভাবশালী মাদক সম্রাট শাকিল ফেনসিডিল ইয়াবা ও হেরোইনের ডিলার। সে তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে বেশ বড় মাদক সিন্ডিকেট করেছে। তার মাদক বিক্রি করছেন বোন জামাই কামাল, মামাতো ভাই সুজন, চাচাতো ভাই জাহাদুর মিয়া এবং সুমন, লেবা মিয়া, নুরু মিয়াসহ অন্তত ১৫ জন।
অমরপুর আয়সার বারির সামনে এবং কাঞ্চনপুর বেলতলা মাঠে পাইকারি দরে ছোট ডিলারদের কাছে ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা পাইকারি দরে বিক্রি করে রাশেদ মিয়া। তার অধীনে অন্তত ১৫ জন বিক্রেতা রয়েছে। তারা হলো-দিতি, বুলবুল, আলমগীর, আয়শা, কালা, মিম আসলামসহ আরও অনেকে।
খাঁন বাড়ির সামনে ‘রাজন খাঁর’ মাদকের হাট। ওই হাটে ওপেন পাইকারি দরে মাদক বিক্রি করছে-খাবিনুর, আলিফ সেলিম, বক্তার, বিবি, রুমা, এনাম, বারিউল, তার আপন ৩ বোন, মানিকসহ আরও অনেকে।
পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রেতা আফসার। তার মাদক বিক্রি করছে স্ত্রী মাসুমা, ভাই এরশাদ, বোন অঞ্জনা এবং দিতি, খোদেজারা। এছাড়া ওই বেদেপল্লিতে অন্তত দুই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী বিক্রির স্থান চিহ্নিত করে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছে। কয়েকজন খুচরা মাদক ব্যবসায়ীর দাবি অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের ছুটিতে এই বেদেপল্লিতেই ৫০ কোটি টাকার মাদক বিক্রির টার্গেট নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানের বিষয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা টের পেয়ে সতর্ক হয়ে গেছে। তাই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বরজুর মুঠোফোনে কথা হয় তার ছেলে সজলের সঙ্গে। সে বলে, ‘আমার বাবা দেশের বিভিন্ন জেলায় সাপের খেলা দেখিয়ে আয়-রোজগার করে। তার বিরুদ্ধে মাদকের যেসব অভিযোগ এসেছে তা সত্য নয়।’