Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

ছাত্র আন্দোলনে মাথায় গুলিবিদ্ধ রায়হানের চিকিৎসা

মাউন্ট এলিজাবেথের অসহায়ত্ব নিউরোসায়েন্স সফল

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাউন্ট এলিজাবেথের অসহায়ত্ব নিউরোসায়েন্স সফল

বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা। রাজধানীর শেরে বাংলানগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের চতুর্থতলার আইসিইউ’র পোস্ট অপারেটিভ-১ এর চার নম্বর শয্যায় নেতিয়ে থাকতে দেখা যায় ব্রেনে সার্জারির রোগী কিশোর রায়হানকে। ন্যাড়া মাথার এক অংশে ব্যান্ডেজে মোড়ানো অবস্থায় বিছানায় দুই পায়ের মাঝে বালিশ রেখে দু’চোখ বুঝে শুয়েছিল সে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ডটিতে ভাইয়ের (রায়হানের) পাশেই মেডিকেল ভিজিটরের গাউন পরে চুপচাপ বসে ছিলেন বড় বোন নাবিলা। অনুমতি নিয়ে এই প্রতিবেদক কাছে গিয়ে রাহয়ান বলে ডাকতেই চোখ মেলে তাকায় সে। এখন কেমন অনুভব করছেন জানতে চাইলে ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু একটা বলে ওঠেন।

বোন নাবিলা জানান, রায়হান এখন কথা শুনতে পারে, কিন্তু বলতে চেষ্টা করেও আওয়াজ বের হয় না। দুই পা এখনো প্যারালাইজড (অবশ)। কতদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে জানা নেই। সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হবে কিনা তাও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তবে ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করছেন। এ সময় ওয়ার্ডের বাইরে এসে যুগান্তরের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে শুরু করেন তার ভাই মুজিবুর রহমান। তিনি জানান, তাদের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ডালি পাড়া গ্রামে। রায়হান স্থানীয় সিলাম পিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট সে।

মুজিবুর আরও বলেন, রায়হান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সামনের সারিতে ছিল। গত ৫ আগস্ট সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমার সঙ্গে আন্দোলনে ছিল। দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম নিয়ে আসার জন্য তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই। বিকালের দিকে শেখ হাসিনার পলায়নের খবরে বিজয় উল্লাস করতে সবার সঙ্গে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা সংলগ্ন আজাদ চত্বরে যায়। ওই সময় পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়ারদৌস হাসানের নির্দেশে বিজয় মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। পুলিশের গুলিতে দুইজন আহত ও একজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ওই সময় রায়হানের মাথায় বুলেট লাগলে স্থানীয়রা দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা ৫ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে রাখে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে রেফার করে। এলাকার বিত্তশালীদের সহযোগিতায় ১৭ আগস্ট এয়ার-অ্যাম্বুলেন্স এই হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করি। চিকিৎসকরা দ্রুত অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন বলে জানান। তবে মস্তিষ্কের আঘাত গুরুতর হওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর বেঁচে ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এরপর আমাদের পরিচিত একজন চিকিৎসকের সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যোগাযোগ করি। গত ১ সেপ্টেম্বর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে রায়হানের মেডিকেল হিস্টোরি ফাইল মেইল করা হয়। ৪ সেপ্টম্বর সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা ফিরতে মেইলে সার্জারি করতে অক্ষমতার কথা জানান। সেখানকার চিকিৎসকরা আরও জানান সার্জারি করে ভালো কিছু হবে না। এমনকি ওটি (অপারেশন থিয়েটার) টেবিলেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে!

মাথায় বুলেট বেঁধায় রায়হানকে বাঁচানো নিয়ে শঙ্কা ছিল সবার। তবে এই অস্ত্রোপচার জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ‘ব্রেইন অ্যান্ড স্পাইন সার্জন’ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের হাতে সফলভাবে সম্ভব হয়।

মুজিবুর রহমান আরও জানান, যখন সব আশা নিভে আসছিল, তখন ডা. মাহফুজ বলেছেন, অস্ত্রোপচারে কিছু ঝুঁকি আছে, তবে আপনারা চাইলে সার্জারি করতে পারি। আমরা তখন ভাইয়ের চিকিৎসার বিষয়টি ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দেই। আমরা বলি যে কোনোভাবেই হোক ভাইকে বাঁচাতে চাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে এই সার্জারি সফল হয়। ৯ সেপ্টেম্বর তার সার্জারি হয়। দেড় ঘণ্টার সার্জারি শেষে আধাঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে।

এ সময় রায়হানের বাবা নানু মিয়া কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ছেলের বেঁচে ফেরার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। ডা. মাহফুজের আগ্রহ থেকে চিকিৎসা দেওয়ায় তাকেও ধন্যবাদ জানান। তিনি জানান, তার সম্পূর্ণ সুস্থতা কখন হবে তা জানা নেই। তবে ডাক্তার বলেছেন সময় লাগবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘রায়হান আমাদের এখানে ভর্তি ছিল। তার মাথায় জটিল ফ্র্যাকচার হয়েছিল। ব্রেনের রক্তনালির সাইনাসে খুলির হাড়ের ভাঙা অংশ ঢুকে ছিল। সার্জারিতে ঝুঁকি থাকায় রোগীর অভিভাবককে বিষয়টি জানাই। তখন তারা সিঙ্গাপুর বা দেশের বাইরে কোথাও করানোর কথা বলে। সিঙ্গাপুর থেকে তাদের জানানো হয় এটি করে তেমন লাভ হবে না। এদিকে সার্জারি ছাড়া রোগীকে বাঁচানোও সম্ভব না। তখন তারা দেশে সার্জারি করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। আমরা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে সার্জারি করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। একই সঙ্গে সার্জারির টেবিলে মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টিও জানাই। পরে তাদের সম্মতিতে আমি ও আমার কয়েকজন সহযোগী মিলে গত ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় সার্জারি কাজ শুরু করি। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে শেষ হয়। আলহামদুলিল্লাহ অপারেশন সফল হয় এবং ১টার দিকে রোগীর জ্ঞান ফেরে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম