ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক পরীক্ষা
প্রথম দিনেই ‘প্রশ্নফাঁস’ পরীক্ষা শেষ ৩ ঘণ্টায়
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশ্নপত্র আগের মতো গোপন করার কোনো বিষয় নয়-অধ্যাপক মশিউজ্জামান * আরও গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে-সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ * পরীক্ষার সময় আরও কমিয়ে আনা দরকার-অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নতুন নিয়মে এভাবেই দলবেঁধে পরীক্ষা দেয় শিক্ষার্থীরা
মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রমে ষাণ্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। বুধবার ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রথম দিনেই শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র ফাঁস! অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষার আগের দিন মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার সকালে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে উত্তর তৈরি করেও ছড়ানো হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলও পাওয়া গেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী উত্তরপত্র লিখে পরীক্ষার হলে নিয়ে যায়। তবে এটিকে ‘প্রশ্নফাঁস’ বলতে চান না এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র আগের মতো গোপন করার কোনো বিষয় নয়। এটা ওপেন বিষয়। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে ভিন্নমতও প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এ নিয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার ছিল।
মশিউজ্জামান আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের কেউ প্রশ্ন আগে পেলে তা ফাঁস হয়ে গেছে এমন মনে করার কিছু নেই। বাচ্চাদের আনন্দের সঙ্গে কিছু কাজ করার জন্য এই প্রশ্ন তৈরি করা হয়। গত বছর আমরা ১৫ দিন আগেই মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছিলাম। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র আগেই জানিয়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই। এখানে সমস্যা হচ্ছে, প্রশ্নপত্রের সমাধানের নামে কিছু বিষয় ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইনে লিখে দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা কনফিউসড হয়ে যায়। তখন শিক্ষার্থীরা সেটাই প্রশ্নের উত্তর মনে করে মুখস্থ করে এসে খাতায় লিখে দেয়। নিজের বোধ থেকে কিছু লিখতে চায় না। এতে বাচ্চাদের মেধা বিকশিত হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। তাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায় না। তবে এবার আমরা পরীক্ষার আগের দিন এই প্রশ্নপত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। সামনে আমরা আরও গোপনীয়তা রক্ষা করব যেন এই প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে কোনো অনলাইনে বা মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে না পারে।
জানা যায়, নতুন নিয়ম হওয়ায় এবার এনসিটিবি থেকে প্রশ্ন তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে অনলাইনে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা প্রশ্নপত্র ডাউনলোডের পর ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি দুঃখজনক। এ বিষয়ে শিক্ষকদের আরও সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে এবং কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
এদিকে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয় পাঁচ ঘণ্টা। এর মধ্যে আধা ঘণ্টা বিরতি রাখা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগেই অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। হলে শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরীক্ষা দিয়েছে। মোবাইল ফোন নিয়েও প্রবেশ করে অনেক শিক্ষার্থী। পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা অনেকটাই নীরব ভূমিকায় ছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়তি সময় থাকায় অনেক শিক্ষার্থী আড্ডা দিয়ে সময় পার করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষাথী ও অভিভাববকরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মানসম্মত হয়নি শ্রেণিভিত্তিক প্রশ্নপত্র। তাই খাতায় অনেক সহজ বিষয়ে উত্তর দিতে হয়েছে। পরীক্ষাকে কঠিন মনে হয়নি। যদিও পরীক্ষার আগের রাতে খুব ভয়ের মধ্যে ছিল শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হওয়ায় উদ্বিগ্ন ছিলেন অভিভাবকরাও।
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী পিয়াল বলে, পরীক্ষার নিয়মকানুন ও প্রশ্নপত্রের ধরন নিয়ে খুবই টেনশনে ছিলাম। রাত জেগে অনেক পড়াশোনা করেছি। কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে একদম সহজ বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। সময়ও লেগেছে কম। মাত্র তিন ঘণ্টায় পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাখওয়াত বলে, পরীক্ষায় অনেক প্রশ্ন এসেছে, যা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে লিখতে হয়। অনেকেই বিষয়গুলো ধরতে পারে না। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে।
বিএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জাহিন নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, আমরা যেসব কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছি, ওইসব বিষয় পরীক্ষায় আসেনি। বইয়ের ৩০ শতাংশ প্রশ্ন আমাদের কমন পড়েছে। বাকি প্রশ্নগুলো ধারণা করে লিখতে হয়েছে। তবে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর কেউ ইচ্ছা করলে তিন ঘণ্টা পড়াশোনা করে দিতে পারবে। আরও মানসম্মত প্রশ্ন করা উচিত। অনেকেই পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়েছে। তারা উত্তরপত্র মোবাইল ফোনে নিয়ে এসে পরীক্ষা দিয়েছে।
নুরুন নাহার নামে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি কেবল চূড়ান্ত হয়েছে। এখনো বিষয়গুলো বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমদিন সন্তানরা গ্রুপভিত্তিক আলোচনা করে পরীক্ষা দিয়েছে। এটা ভালো হয়েছে নাকি খারাপ, বলা মুশকিল।
জেবল রহমান নামে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে পরীক্ষার টেনশনে সারা রাত ঘুমায়নি। পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন হবে, এতে কী কী লিখতে হবে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সে। এই নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে তারা হতাশ বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরীক্ষার সময় আরও কমিয়ে আনা দরকার। প্রশ্নপত্রের মান আরও বাড়াতে হবে। অতিসহজ প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে বলে জানান তিনি।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আ ন ম সামসুল আলম বলেন, নতুন মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একধরনের মানসিক চাপে ছিল। প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে তারা। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা রক্ষায় শিক্ষকদের আরও সচেতন হতে হবে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, এদিন সকাল ১০টা থেকে এ মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়ে, বিরতিসহ চলে পাঁচ ঘণ্টা। প্রথম দিনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলা, সপ্তমে ধর্ম, অষ্টমে জীবন ও জীবিকা এবং নবম শ্রেণিতে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ২০ হাজার ৬৩৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
দুই বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১ জুলাই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। তবে দেরিতে অনুমোদন হওয়ায় নতুন এ পদ্ধতি ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে পুরোপুরি প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে এনসিটিবি সূত্র। এনসিটিবির প্রস্তুত করা খসড়া মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি বিষয় মূল্যায়নে সাতটি পর্যায় বা স্কেল রয়েছে। মূল্যায়নের পর্যায়গুলো হলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সবচেয়ে যে ভালো করবে, সে ‘অনন্য’ পাবে।
গত বছর দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। এতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।