চিকিৎসায় নতুন মাইলফলক
রোবট দিয়ে হৃদযন্ত্রের রিং পরানোর যুগে বাংলাদেশ
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হার্ট অ্যাটাকের পর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন কুষ্টিয়ার বৃদ্ধ কৃষক আজম আলী। এনজিওগ্রাম করলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে দুটিতে ৯৫ ভাগ এবং একটিতে ৯০ ভাগ ব্লক ছিল। হৃদরোগ ইনস্টিটিউট সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার তার হৃদযন্ত্রে রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য বিনামূল্যে সর্বাধুনিক রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব দেন তাকে। এতে সায় দিলে রোববার হাসপাতালটির ক্যাথল্যাবে নেওয়া হয় আজম আলীকে। অত্যাধুনিক এই ক্যাথল্যাবেই স্থাপন করা হয় রোবট প্রযুক্তি। যা এক মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। যন্ত্রটির মাধ্যমে দূর থেকে নির্দেশনা দিয়ে দিয়ে ৩০-৪০ মিনিটেই সম্পন্ন হয় তিনটি রিং পরানোর কাজ। একই দিনে অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরও একজনের হার্টে সফলভাবে রিং পরানো হয়। এভাবেই রোবট দিয়ে হৃদযন্ত্রের রিং পরানোর যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কেবিন ফ্লোরে মঙ্গলবার কথা হয় আজম আলীর সঙ্গে। স্ত্রী ইজারুন্নেসা ও ছেলে মো. মনিরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি তখন হাসপাতাল ছাড়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। শরীর কেমন-জিজ্ঞেস করতেই মুখে মৃদু হাসি আর চিকিৎসকের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা। আজম আলী বলেন, ২২ বছর ধরে হৃদরোগের সমস্যা। অনেক কষ্ট পেয়েছি। হাঁটাচলাও করতে পারছিলাম না। স্বাভাবিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। সর্বশেষ বুধবার ভর্তি হই। রোববারই রোবট দিয়ে আমার চিকিৎসা হলো। বিনামূল্যে এত ভালো চিকিৎসা পাব চিন্তাও করিনি। এখন পুরোপুরি সুস্থ। স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছি-চলছি। আমি সবাইকে পরামর্শ দেব-সরকারি হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে। দেশের সবাই যেন এমন চিকিৎসা পান-সরকারের কাছে অনুরোধ করব সেই ব্যবস্থা করার।
আজম আলীর হৃদযন্ত্রে রিং পরানোর মাধ্যমে দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় নতুন মাইলফলক যুক্ত হয়। দেশের হৃদরোগের চিকিৎসাসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বে ১৬০টি রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি (রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানো) সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ছয়টি সেন্টার রয়েছে। রোববার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালও রোবটিক যুগে পদার্পণ করল। হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তার দল পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। তাদের সহযোগিতা করেন ফ্রান্স, চীন ও ভারতের তিন সদস্যের একটি টেকনিক্যাল গ্রুপ। এই গ্রুপটি এক মাস বাংলাদেশে থেকে একটি প্রশিক্ষিত দল তৈরিতে কাজ করবে। এই সময়ে তাদের যন্ত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করে বিনামূল্যে ১০টি রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করা হবে। এরপর যন্ত্রগুলো তারা ফিরিয়ে নেবে। পরে সরকার চাইলে সেগুলো তারা সরবরাহ করবে।
অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তিটি সম্পর্কে ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, রোবটিক এনজিওপ্লস্টির মাধ্যমে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর অবস্থান থেকে অনেক দূরে থেকেও নিখুঁতভাবে হৃদরোগীদের হার্টের ধমনিতে রিং পরান। এই রোবটের দুটি অংশ থাকে। একটি হলো রোবটের একটি হাত যা ক্যাথল্যাবে থাকে। আরেকটি থাকে কন্ট্রোল সেকশন। যেখান থেকে মূল কার্ডিওলজিস্ট পুরো রিং পরানো কার্যক্রমটি দূর থেকে সম্পন্ন করে থাকেন।
প্রযুক্তিটির সুবিধা নিয়ে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হলো হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। অনেক সময় হার্টের রিং নিখুঁতভাবে পজিশন করার জন্য এক মিলিমিটার সামনে অথবা এক মিলিমিটার পেছনে নেওয়ারও প্রয়োজন হয়। হাত দিয়ে করলে নিখুঁতভাবে এই কাজটি করা কঠিন হয়। কিন্তু রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে এটি সম্পন্ন করা যায়। রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হলো-হৃদরোগ চিকিৎসকরা সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে এক ঘণ্টার উপরে সময় লাগে। রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে। এতে অল্প সময়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যায়। হার্টের ভেতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার (তার), বেলুন, রিং যত কম সময় রাখা যায় রোগীর জন্য তত নিরাপদ। তাই রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং পরাতে সময় কম লাগে বলে জটিলতাও কম হয়। হৃদরোগ হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রযুক্তির ব্যবহারে হার্টের রিং পরাতে ভারতে মূল খরচের বাইরে ২-৩ লাখ রুপি বেশি ব্যয় হয়। সিঙ্গাপুরে অতিরিক্ত ৭-১০ লাখ টাকা গুনতে হয়। আমেরিকা ও ইউরোপে টাকার পরিমাণ আরও অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রযুক্তিটি স্থায়ীভাবে স্থাপন করা গেলে এটি অতিরিক্ত ২০-৩০ হাজার টাকার মধ্যেই তারা সম্পন্ন করতে পারবেন। তখন এ ধরনের চিকিৎসাপ্রত্যাশী রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। এর মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং অনেক বড় অঙ্কের একটি অর্থ দেশে থেকে যাবে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামোর সঙ্গে সহায়ক কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য বর্তমান মেশিনটি এক মাস ব্যবহারের জন্য ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি এক মাস পরে আবার ফেরত চলে যাবে ফ্রান্সে। এখন পর্যন্ত রোবটিক সিস্টেমটি বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে সহায়ক মনে হয়েছে। এক মাস দেখার পরে যদি এটি পুরোপুরি সহায়ক মনে হয় তাহলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এ রোবটিক সিস্টেমটি কেনার জন্য সরকারকে অনুরোধ করবে। এতে খুব কম খরচে আন্তর্জাতিক সর্বাধুনিক এ প্রযুক্তি সব সময়ের জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চালু রাখতে পারবে।
রোববার কৃষক আজম আলীর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের সৌদি প্রবাসী মোরশেদ আলমের হার্টে একই পদ্ধতিতে তিনটি রিং পরানো হয়। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, সৌদিতে চিকিৎসক বলেছিলেন বাইপাস করে হার্টের চিকিৎসা করতে হবে। শুনেই আমি কাগজপত্র নিয়ে দেশে চলে এসেছি। পরে ডা. প্রদীপের কাছে এলে তিনি কাটাছেঁড়া ছাড়াই রোবটের মাধ্যমে সুন্দরভাবে তিনটি রিং পরান। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। গরিবের জন্য এ চিকিৎসা তো চিন্তাও করা যেত না।
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, রোবটিক এনজিওপ্লাস্টিতে চিকিৎসকদের জন্য সুবিধা হলো যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন একটা সময় এসে তারা দুটি সমস্যায় পড়েন। প্রথমত, রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যানসার ও চোখে ক্যাটারাক্টসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার ঝুঁকিতে পড়েন। এছাড়া হৃদরোগ চিকিৎসকরা যখন অপারেশন থিয়েটার বা ক্যাথল্যাবে কাজ করেন রেডিয়েশন প্রটেকশনের জন্য তাদের ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ পোশাক দীর্ঘক্ষণ পরে থাকতে হয়। এতে ঘাড়ের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। পরে চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ও হাতে ব্যথার কারণে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। বর্তমানে অনেক জ্যেষ্ঠ ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এ সমস্যার জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়া এবং ভারী বিশেষ জামা পরা ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোলরুমে, তার অফিসে অথবা সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে অথবা দেশের বাইরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হার্টে রিং পরাতে পারবেন। দেশের সব প্রান্ত থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে এই সেবা পাওয়া সম্ভব। এতে বাঁচবে সময়, কমবে ঝুঁকি। ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার ভারতের হায়দরাবাদের অ্যাপোলো হসপিটাল এবং চীনের সাংহাই থেকে রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাছাড়া রোবটিক এনজিপ্লাস্টিতে ভারতের প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডাক্তার পিসি রাথের কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো কোনো সরকারি হাসপাতালে ট্রান্স ক্যাথেটার এউটিক ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট বা টিএভিআর পদ্ধতিতে বুক না কেটে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেন। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীর টিএভিআর পদ্ধতিতে এউটিক ভাল্ব প্রতিস্থাপন করেছেন তিনি। সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে এইচ ও সিএম বা হাইপারট্রপিক অবস্ট্রাক্টিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি চিকিৎসা করেন তিনি।