অঙ্গসংগঠনের লাগাম টানতে হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি
উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা * পদবঞ্চিতদের দলে ফেরানোর উদ্যোগ
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের লাগাম টেনে ধরতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি। উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পদবঞ্চিতদের দলে ফেরানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
মঙ্গলবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় নেতারা একমত পোষণ করেন যে, আগামীতে একদফা আন্দোলন শুরুর আগে যে কোনো মূল্যে দলের চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে কোন্দল নিরসন করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে যা যা করার দরকার, তাই করা হবে বলেও তারা মত দেন। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন চরমে উঠেছে। এতে একদিকে নেতাকর্মীদের মাঝে বিভাজন বাড়ছে, অন্যদিকে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে। এটা যুগপৎ আন্দোলনে সাফল্য পেতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে যাচ্ছেন হাইকমান্ড। এর পাশাপাশি দলের বিভাজন যাতে বাইরে না ছড়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায় এ ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন সিনিয়র নেতারা। এ সংক্রান্ত দলীয় নির্দেশনা খুব শিগগিরই প্রকাশ করবে দলের দপ্তর বিভাগ।
তবে এসব বিষয়ে এখন কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এটা তাদের দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
তবে নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, সম্প্রতি কয়েকটি কর্মসূচিতে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পল্লবী থানা বিএনপির ইফতার অনুষ্ঠান পণ্ড করতে যুবদলের একটি অংশ সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়। তাদেরকে আহত করে ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। এতে পুরো অনুষ্ঠান ভণ্ডুল হয়ে যায়। একটি অংশের আত্মঘাতী এ কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তেমনি আগামী আন্দোলনেও এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পল্লবী থানায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা ভাঙচুরের ঘটনা তুলে ধরে জিডি করার ঘটনায় আরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে বিএনপিকে। এ অবস্থায় অতি উৎসাহী নেতা-কর্মী এবং দায়িত্বশীল নেতাদের আচরণ এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে তারা মনে করছেন।
ওই নেতা আরও জানান, বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল ও বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। এছাড়া গ্রুপিংয়ের কারণে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা পদ বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে নেতাকর্মীদের একটি অংশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। নানা ক্ষোভ, রাগ, অভিমানের কারণে তারা আন্দোলন কর্মসূচিতেও অংশ নেন না। এসব বিষয় আমলে নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির সভায় একটি জাতীয় দৈনিকের নাম উল্লেখ করে একজন নেতা বলেন, ওই পত্রিকার সাংবাদিককে রাতের অন্ধকারে তুলে নেওয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়ার ঘটনায় যখন সারাদেশ সমালোচনায় মুখর, তখনই পল্লবীতে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। এসব বিষয় নিয়ে দলের সভায় নেতারা দীর্ঘ সময় আলোচনা করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়-যারা পদপদবি বঞ্চিত হয়ে দলের বিরুদ্ধে কাজ করছেন বা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া যেসব কমিটিতে বিভাজন রয়েছে বা নেতাকর্মীরা বঞ্চিত আছেন, তাদের বিষয়টি শিগগিরই সমাধান করা হবে। এজন্য একটি কমিটি করা হবে। ওই কমিটির সুপারিশে পর্যায়ক্রমে সবাইকে পদ-পদবিতে সম্পৃক্ত করা হবে।
স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা জানান, দলীয় কোন্দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবগত। সামনে সরকারবিরোধী বড় আন্দোলন আসছে, এই মুহূর্তে দলীয় কোন্দল দলের জন্য শুভ নয়। তাই তিনি বিএনপিসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোন্দল নিরসন করতে শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। খুব অল্প সময়েই এসব সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করবে বিএনপি।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির সভায় আগামী নির্বাচনে জাতিসংঘের সহযোগিতার প্রস্তাব বাংলাদেশের নাকচ করার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গ তুলে একজন নেতা বলেন, সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তারা বৈঠক করেছেন। জাতিসংঘ নির্বাচনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। নির্বাচনি পর্যবেক্ষক বা অন্যান্য সহযোগিতার প্রস্তাবও নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। পরে বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করেছি। একটা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও করেছি; তারা যথেষ্ট সক্ষম। সেজন্য অন্যের সাহায্যের আমাদের প্রয়োজন নেই।
বিএনপির ওই নেতা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে জাতিসংঘের সহযোগিতা করতে চাওয়ার মানেই হলো আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে আস্থার সংকটে পড়েছে। নইলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ সহযোগিতা করতে চাইবে কেন? জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব সংস্থা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সরকারের অধীনে আগের নির্বাচনগুলো যে সুষ্ঠু হয়নি, সেই প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে। সে শঙ্কা থেকে জাতিসংঘ নির্বাচনে সহযোগিতা করতে চেয়েছে বলে মনে হয়। তবে জাতিসংঘের সহযোগিতার প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তও সন্দেহজনক বলেও তিনি জানান।
সভার নেতারা আরো মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই নির্বাচন দুটিতে কী সব ঘটেছে তা সবারই জানা। দলে ও দলের বাইরে কেউ কেউ বলেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ছিল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর, এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে আর কেউ বলছে না। এখন সবাই বুঝে গেছে যে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।