নারীর জীবনে পিরিয়ডকালীন অসহ্য ব্যথার নাম এন্ডোমেট্রিওসিস। বিশ্বের ২০০ মিলিয়ন নারী এ অসুস্থতায় আক্রান্ত। হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা উল্লেখযোগ্য অংশ এন্ডোমেট্রিওসিসের রোগী। এ রোগ নিয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর মার্চ মাসকে এন্ডোমাস হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে পিরিয়ডকালীন নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে রোগীদের সংকোচ ও দ্বিধাবোধ রয়েছে, যা রোগের চিকিৎসা ক্রমশ জটিল করে তোলে। এ বাস্তবতায় এন্ডোমেট্রিওসিস-এডেনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ইএসবি) উদ্যোগে ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল্স লিমিটেডের সহযোগিতায় দেশের খ্যাতনামা প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের আলোচনায় রোগের লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ, করণীয় ও সমাজের কুসংস্কারের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
প্রতিদিনের বাজারে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করুন
হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীদের শতকরা ৩০ জন এন্ডোমেট্রিওসিস নামক দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগেন। প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জন এ সমস্যায় আক্রান্ত। মাসিকের সময় পেটে তীব্র ব্যথা কিংবা মাসিকে অনিয়ম এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। শতকরা ১০ ভাগ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। এত রোগীকে সেবাদানের জন্য প্রতিটি টারসিয়ারি লেভেলের হাসপাতালের বহির্বিভাগে এন্ডোমেট্রিওসিস কর্নার খোলা এখন তীব্র প্রয়োজন। সম্মিলিতভাবে এ রোগকে জয় করতে হবে। সেবাদানকারীদের মধ্যে দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এন্ডোমেট্রিওসিস ও এডেনোয়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সোসাইটি স্কুল লেভেলে কিশোরীদের পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতায় স্কুল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে। প্রতিরোধের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী
সভাপতি, এন্ডোমেট্রিওসিস-এডেনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ
মাসিক নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ বিষয় নয়
এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অনেক কিছুই জানেন না। আমরা যারা গবেষণা করি তারা জানি পুরো পৃথিবীতে এটি একটি পাবলিক হেলথ কনসার্ন। বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন নারী এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত। আমাদের দেশে ৬২ শতাংশ নারী এই সমস্যায় আছে। এদের মধ্যে যাদের বয়স ১৪-২৪ বছরের মধ্যে তারা জানেই না এটা কি। তারা জানেন না, বোঝেন না কিন্তু আক্রান্ত। এ কারণে এ রোগকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৭৫-৯৮ শতাংশ পরিবার মনে করেন মাসিক সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা গোপন রাখতে হয়। অনেক অভিভাবকও মনে করেন, এ সমস্যা জানাজানি হলে মেয়ের বিয়ে হবে না কিংবা হলেও মেয়ে গর্ভধারণ করতে পারবে না। যারা জানেন না তাদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য নিরলস কাজ করছে এন্ডোমেট্রিওসিস-এডিনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ইএসবি)। এই রোগীদেরকে সহমর্মীতা দিয়ে সময় দিতে হবে। তাদের সমস্যাগুলো ভালো করে শুনে ও বুঝে যে চিকিৎসা প্রয়োজন সেটিই দিতে হবে। রোগী ও তাদের পরিবারকে সচেতন করার পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসকদেরও সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
সভাপতি, ওজিএসবি
রোগীকে সঠিক চিকিৎসা সময় মতো দেওয়া জরুরি
বিশ্বব্যাপী মার্চ মাসকে এন্ডোমাস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মাসিকের সময় পেটে তীব্র ব্যথা হলে এন্ডোমেট্রিওসিসের কথা বিবেচনায় আনতে হবে। সব স্তরের চিকিৎসক, রোগী, রোগীর পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবার মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এর ফলে রোগীর ভয় দূর হবে, তিনি আশ্বস্ত হবেন এবং রোগের তীব্রতার বিরুদ্ধে লড়াই করে রোগী জয়ী হবে। এ মাসে সোসাইটির পক্ষ থেকে আমরা গোলটেবিল বৈঠক, পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, র্যালি, টকশো, লিফলেট বিতরণ এবং রোগীর মাঝে কিছু ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করছি। এ রোগের চিকিৎসা ক্রমে আধুনিক ও অগ্রসর হচ্ছে। সার্জারির টেকনিকগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন টেকনোলজি আবিষ্কার হচ্ছে। আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে চকোলেট সিস্ট শনাক্ত হলে অতিদ্রুত গাইনোকোলজিস্টের কাছে রোগীদের রেফার করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী
মহাসচিব, এন্ডোমেট্রিওসিস ও এডেনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ
রোগীর গুণগত জীবনশৈলী যেন অক্ষুণ্ন থাকে
এন্ডোমেট্রিওসিস রোগীদের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা চিকিৎসকদের সহানুভূতির সঙ্গে জানাতে হবে। রোগীর গুণগত জীবনশৈলী যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কোন ওষুধ কতদিন, কীভাবে খেতে হবে তা বলা দরকার। ওজিএসবিতে তিন হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। দেশব্যাপী এ সোসাইটির উনিশটি শাখা রয়েছে। এডোলোসেন্স বা বয়ঃসন্ধিক্ষণে নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের সোসাইটিতে একটি সাব-কমিটি রয়েছে। দেশব্যাপী সর্বস্তরের চিকিৎসকদের মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে সচেতন করতে হবে এবং এ রোগ শনাক্ত হলে দ্রুত গাইনোকোলজিস্টের কাছে রেফার করা জরুরি। হাসপাতালের বহির্বিভাগে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগীদের রোগের লিফলেট বিতরণ করা যায়।
অধ্যাপক ডা. লতিফা শামসুদ্দিন
সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
এন্ডোমেট্রিওসিসের সব চিকিৎসা দেশে সম্ভব
এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত ৩০-৫০ ভাগ রোগী বন্ধ্যাত্বে ভোগেন। এটি যেহেতু অনিরাময়যোগ্য রোগ তাই নারীরা একসময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। প্রজননক্ষম বয়সে এ সমস্যা হলে ল্যাপারোস্কোপি করা হয়। প্রজননতন্ত্রের কোনো অংশে স্পট বা দাগ থাকলে ডায়াথার্মি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্টেজ ১ ও ২-এ এন্ড্রোমেট্রিওসিস নির্ণীত হলে গর্ভধারণে সাধারণত সমস্যা হয় না। এ স্টেজে আইইউআই করলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে। স্টেজ ৩ ও ৪-এর চিকিৎসা করা দুরূহ, এক্ষেত্রে আইভিএফ করা লাগতে পারে। আরেকটি সমস্যা হলো এডোনোমায়োসিস। যাদের এন্ডোমেট্রিওসিস থাকে তাদের এক তৃতীয়াংশের এডোনোমায়োসিস হয়। এটি গর্ভধারণের জন্য খুবই জটিলতা তৈরি করে। ফলে অনেকে গর্ভধারণ করলেও গর্ভপাতারে ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই রোগীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম
সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
ইনসেপ্টা চিকিৎসকদের নিয়ে সেমিনারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়
যতটুকু জানি, কোনো মেয়ে এন্ডোমেট্রিওসিস সমস্যায় আক্রান্ত হলে, তখন তারমধ্যে এক ধরনের হিনমন্যতা, বিষন্নতা বিষাদগ্রস্থতা তৈরি হয়। অনেকে সহপাঠীদের কাছে বুলিংয়ের শিকার হয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। যার প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যে। গবেষকরা জানিয়েছে, যারা এন্ডোমেট্রিওসিসে ভুগছে তাদের প্রতি তিনজনে দুইজন রোগটি নিয়ে উদ্বিগ্নতায় থাকে। আমাদের প্রতিষ্ঠান এ রোগটি নিয়ে সর্বোচ্চ সচেতন। এ জন্য বিশ্বমানের ওষুধ আমরা তৈরি করছি। অনেকেই জানেন, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল্সের প্লান্টে হরমোনাল ড্রাগ তৈরি হচ্ছে। যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এন্ডোমেট্রিওসিস ও অন্যান্য গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধ ইনসেপ্টা তৈরি ও দেশব্যাপী বিতরণ করে আসছে। যেমন-ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল রোজেন, ডাইনোজেস্ট প্রিপারেশন ডাইনোসেন, লেট্রোজেল প্রিপারেশন এন্ডোফ্রি, রেলুগোরিক্স ও ইস্ট্রাডিওল প্রিপারেশন রেহানজিল এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিসহ সব ধরনের ওষুধ যা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে তা আমরা দেশে সহজলভ্য করেছি। অতিশিগ্গির বিভিন্ন ধরনের হরমোনাল ইনজেকশন আমরা বাজারে নিয়ে আসব।
মো. শফিকুজ্জামান
অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল্স লি.
লক্ষণ জেনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
বিশ্বব্যাপী কিশোরীকালে মাসিক শুরুর পর থেকে বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের এমনকি মধ্যবয়সী নারীদেরও এন্ডোমেট্রিওসিস হচ্ছে। রিপ্রোডাক্টটিভের বয়স ছাড়াও মধ্যবয়সী অনেক নারী লক্ষণ হিসেবে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, তীব্র ব্যাথাসহ বেশ কিছু উপসর্গ নিয়ে আমাদের কাছে আসছে। ব্যাথার তীব্রতায় অনেক মেয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এজন্য কিশোরী থেকে সব বয়সী নারীদের রোগটির লক্ষণগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। কারও সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে। আরেকটি বিষয়, এন্ডোমেট্রিওসিস এমন একটি রোগ, যেটি অন্য রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নাও হতে পারে। দেখা গেছে একজনের অনেক বেশি এন্ডোমেট্রিওসিস কিন্তু লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। বিভিন্ন কারণে আণ্ট্রাসনোগ্রাম বা সার্জারী করতে গিয়ে রোগটি ধরা পড়ছে। আবার অনেকের সামান্য পরিমাণে এন্ডোমেট্রিওসিস আছে তাদের শুরুতেই লক্ষণ দেখা দিতে পারে। রোগটি বেশি পরিমাণে হয়ে গেলে পেটে চাকা বা ডিম্বাশয়ে টিউমার সন্দেহে রোগীরা আসে। আল্ট্রাসনোগ্রাম করে দেখা যায় ডিম্বাশয়ে সিস্ট হয়েছে। তাই শুরুতে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে কোনো বয়সের নারী এমনকি মেনোপজ বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও নারীরা এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত হতে পারে। মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা, কখনো কখনো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, স্বামীর সঙ্গে সহবাসে ব্যথা এ রোগের লক্ষণ। রোগের অগ্রসর পর্যায়ে পেটে চাকা নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের কাছে এলে অনেকে একে ডিম্বাশয়ে সিস্ট হয়েছে ভেবে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে এটি চকোলেট সিস্ট যা এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে হয়। এ অবস্থায় রোগের চিকিৎসা গুরুত্বের সঙ্গে দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ
মহাসচিব, ওজিএসবি
মাসিকের সমস্যার কথা বলতে লজ্জাবোধ কেন
এন্ডোমেট্রিওসিস রোগটির কারণে মানসিক অস্থিরতায় অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। কারণ আক্রান্ত নারীর এমনিতেই মাসিকের সমস্যা থাকে, তারমধ্যে আবার স্বামীর সঙ্গে সহবাসে সমস্যা হয়। এতে অনেকের বিচ্ছেদও ঘটে। এটি নিয়ে আমাদের দেশে সচেতনতার অভাব রয়েছে। মাসিকের যে কোনো ধরনের সমস্যার জন্য যে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে তা নিয়ে নারীদের মধ্যেও লজ্জাবোধ আছে এবং সমাজে ব্যাপক কুসংস্কার রয়েছে। ৭২-৯৮ ভাগ রোগীর পরিবার মাসিক নিয়ে কোনো না কোনো ধরনের কুসংস্কারে আক্রান্ত। জরায়ু মুখের ক্যানসার নিয়ে যেমন গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তেমনি এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়েও গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম, সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
প্রতি তিনজনে দুজন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত
রোগটি যেহেতু সারা জীবনের, তাই এ থেকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এবং যন্ত্রণাও দীর্ঘস্থায়ী হয়। রোগীরা রোগে ভুগতে থাকলে, দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খাওয়ার ফলে এক সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। এর ফলে মন খারাপ থাকা, হীনমন্যতা, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার চিন্তাও রোগীরা করে থাকেন। এন্ড্রোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত স্কুলগামী কিশোরীরা স্কুলে অনিয়মিত হয়, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারে না, ফলে স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হয়। এতে অভিভাবক ও বন্ধুদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই রিপ্রোডাক্টিভ এইজের কোন নারী সমস্যাটি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। এ রোগীদের চিকিৎসকরা আশ্বস্ত করবে, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিকিৎসা করবে।
অধ্যাপক ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
কিশোরীদের সক্রিয় জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে
একজন নারীর মাসিকের বয়স থেকে শুরু হয়ে মনোপোজ পর্যন্ত এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে। যারা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না অর্থাৎ ইনফার্টিলিতে ভুগছেন এমন ৩০ থেকে ৫০ ভাগ নারীর এন্ডোমেট্রিওসিস থাকে। এটি প্রতিরোধে কিশোরীদের সক্রিয় জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ রোগে সৃষ্ট ব্যথা কমাতে সঠিক জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা রয়েছে। মাছের তেল যাতে ওমেগাথ্রিফ্যাটি অ্যাসিড আছে তা প্রদাহ বা ব্যথা কমাতে সহায়ক। নিষ্ক্রিয় ও অলস জীবনযাপন এ রোগের ব্যথা ও উপসর্গ বাড়াতে পারে। পক্ষান্তরে ব্যায়াম রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়ক। ইয়োগা, মেডিটেশনও কিন্তু রোগের তীব্রতা কমাতে পারে।
অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম
সভাপতি (ইলেক্ট), ওজিএসবি
সবাইকে চিকিৎসায় সম্পৃক্ত হতে হবে
এ সমস্যায় আক্রান্ত নারীদের পরিবারের সবাই রোগীকে সহযোগিতা করবে। মেয়েরাও তার মাসিক শুরু হয়েছে বা মাসিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। পরিবারের সদস্যরা এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত রোগীদের ডাক্তার দেখানো, ডাক্তারের সঙ্গে রোগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা, ওষুধ কিনে দিয়ে রোগীকে সহযোগিতা করবে। যেহেতু বেশির ভাগ নারী গ্রামে বাস করে তাই এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে সর্বত্র তথ্য পৌঁছে দিতে মিডিয়ার ভূমিকা রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. কোহিনূর বেগম, সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
দক্ষ জনবল দিয়ে সার্জারি করানো উচিত
এন্ডোমেট্রিওসিস রোগীদের সার্জারির প্রয়োজন হলে তা খুবই দক্ষ, প্রশিক্ষিত গাইনোকোলজিস্ট, ইউরোলজিস্ট, অ্যানেসথেসিস্ট এবং পর্যাপ্ত ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও যন্ত্রপাতি আছে এমন হাসপাতালেই করা উচিত। সিস্টের সাইজ ৪ সেন্টিমিটার হলে সাধারণত অপারেশন লাগে না, কিন্তু এর সাইজ ৭-৮ সে.মি. হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সার্জারি করা লাগতে পারে। মেডিসিনের সাহায্যে চিকিৎসা ৫-৬ বছর চালানোর পরও যদি সিস্টের সাইজ বড় হতে থাকে, রোগী গর্ভধারণ করতে চাচ্ছে কিন্তু চকোলেট সিস্টের জন্য করতে পারছে না তখন অপারেশনের কথা বিবেচনায় আনা হয়। রোগ প্রতিরোধের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম, সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি
ওষুধের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে
এ রোগের চিকিৎসা যেহেতু দীর্ঘ সময় চালিয়ে যেতে হয় তাই ওষুধগুলো যেন স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে এন্ডোমেট্রিওসিস কর্ণারগুলোতে এর দাম সাশ্রয়ী মূল্যে রাখতে হবে। মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশনগুলো দামি হওয়ায় অনেক রোগী চিকিৎসা সম্পন্ন করতে পারছে না। সোসাইটি ও সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় ওষুধ ও চিকিৎসার জন্য একটি ফান্ড তৈরি করা যায়। পেশেন্ট সার্পোটিং গ্রুপ গঠন এ চিকিৎসায় ফলপ্রসূ হবে। সর্বোপরি রোগীকে চিকিৎসার জন্য সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. দিপি বড়ুয়া
কার্যকরী সদস্য, অবসস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ
এন্ডোমেট্রিওসিস বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ
এন্ডোমেট্রিওসিস প্রতিরোধযোগ্য নয়, চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও কষ্টকর, তাই এ রোগের অগ্রযাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়েই অর্থাৎ স্টেজ ১ এবং ২-এ থামিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন অতিদ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং শনাক্ত হওয়া মাত্র রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা। শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীদের বন্ধ্যাত্বের কারণ এ এন্ডোমেট্রিওসিস। সন্তান নেওয়ার আদর্শ সময় ২৫-৩০ বছর। বর্তমানে নারীরা সন্তান নিতে দেরি করছে, ফলে তাদের বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কাও বাড়ছে।
অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা
সাবেক মহাসচিব, ওজিএসবি
এন্ডোমেট্রিওসিস যোদ্ধাদের পাশে আছি আমরা
গবেষণায় দেখা গেছে, মেনোপজের পর এন্ড্রোজেন কমে গেলেও এন্ডোমেট্রিওসিসের আশঙ্কা থাকে। এ সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোটেরন সংবলিত পিল খেতে দিতে হবে। মেনোপজে হট ফ্লাস অর্থাৎ প্রচণ্ড গরম ও ঘাম হওয়া, মেজাজ-মর্জিতে পরিবর্তন হওয়া ও স্বামীর সঙ্গে থাকতে কষ্ট হলে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দিতে হয়। মেনোপজের পর ডিম্বাশয় বা জরায়ুতে কোনো সিস্ট হলে তা চকোলেট সিস্ট কিনা তা নির্ণয় করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. জিন্নাত আরা নাসরীন
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, এন্ডোমেট্রিওসিস-এডেনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ
চকোলেট সিস্ট হলেই অপারেশন করা জরুরি নয়
চকোলেট সিস্ট হলে অপারেশন লাগবে কি না এ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যেও মতভেদ আছে। সিস্টের সাইজ বড় হলেও আধুনিক অনেক মেডিসিনের সাহায্যে এর চিকিৎসা দেওয়া হয়। আশার কথা সব ওষুধ আমাদের দেশেই সহজলভ্য। অনেক সময় জরায়ুর মধ্যে আইইউডি বসিয়ে চিকিৎসা দিলে ভালো কাজ হয়। মাসিকের সময় কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দ্রুত গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। রোগীদের জানাতে হবে দেশে আধুনিক টেকনোলজির সব ধরনের চিকিৎসা আছে, প্রয়োজনীয় ওষুধ আছে।
অধ্যাপক ডা. ফাতেমা রহমান পিংকি
বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক
ওজিএসবি
বিয়ে দিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়
সন্তান নিতে চাচ্ছেন এমন এন্ডোমেট্রিওসিসের রোগীদের সিস্ট বা গাইনি সংক্রান্ত কোনো অপারেশন করতে হলে খেয়াল রাখতে হবে ডিম্বাশয়ের টিস্যু বা ডিম্বাণু যেন বেশি নষ্ট হয়ে না যায়। ডিম্বাশয়ে দশভাগের এক ভাগ টিস্যু থাকলেও সুস্থ ডিম্বাণু পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ফার্টিলিটি অক্ষুণ্ন রেখে সার্জারি করতে হবে। এক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা সিএ ১২৫ এবং এএমএইচ করা লাগতে পারে। সার্জারির পর যদি আবার ৭-৮ সে.মি. সিস্ট দেখা দেয় তাহলে আমরা দ্রুত সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্টেজ ১ ও ২-এ রোগী চিকিৎসা নিতে পারলে, সফলতার হার শতকরা প্রায় ৯৩ ভাগ।
অধ্যাপক বেগম নাসরিন কিরণ
চেয়ারম্যান, স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
মাসিক নিয়ে সব কুসংস্কার দূর করতে হবে
এন্ডোমেট্রিওসিস রোগীর শরীর ও মনে ব্যথা, বিষণ্নতা ও বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়। এ সমস্যা যেহেতু দিন দিন বাড়ছে তাই সমাজের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত রোগের লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও করণীয় সম্পর্কে জানাতে হবে। আমাদের সোসাইটির মাধ্যমে গত চার বছরে আমরা লাখ লাখ নারীকে সচেতন করতে পেরেছি। এ সচেতনতা সৃষ্টির অন্যতম অংশীদার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া। প্রতিটি স্কুল-কলেজে কিশোরীদের মাসিক বা পিরিয়ডের জন্য যেন একটি কর্নার থাকে। কোথাও কোথাও এ কর্নারে বিনামূল্যে প্যাডও বিতরণ করা হয়।
অধ্যাপক ডা. সেহরিন এফ সিদ্দিকা
সাংগঠনিক সম্পাদক, এন্ডোমেট্রিওসিস-এডেনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ
পাঠ্যপুস্তকে পিরিয়ডকালীন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
যারা কিশোরীকালে মাসিক শুরুর পর থেকে বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের, এমনকি মধ্যবয়সি নারীদেরও এন্ডোমেট্রিওসিস হচ্ছে। তাই রোগটি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কিশোরীর স্বাস্থ্য এবং পিরিয়ডকালীন হাইজিন গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদের এ ব্যাপারে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অর্থাৎ এ হাইজিনকে মেডিকেল এডুকেশনের একটি অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষকদের এ বিষয়ের কর্মশালায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। অনলাইনের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের মেডিকেল এডুকেশন দেওয়া যায়।
ডা. ফারজানা দিবা
সহযোগী অধ্যাপক, ইনফাটিলিটি এন্ড রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সহজে রোগ নির্ণয়ে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি
এন্ডোমেট্রিওসিস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোনো কোনো রোগীর রোগ বিলম্বে নির্ণয় হয়। দেখা যায় রোগ শনাক্তের পূর্বে এ রোগীরা পাঁচজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিল। সঠিকভাবে ও সঠিক সময় রোগ নির্ণয় না হওয়া, কখনো কখনো প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিকিৎসা দেওয়া বা এ রোগে কিছুই হবে না-এ ধরনের ভ্রান্ত আশ্বাস দেওয়াতে রোগীদের ভোগান্তি বাড়ে। দেশের সব গাইনোকোলজিস্ট প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের একত্রিত করে এন্ডোমেট্রিওসিস চিকিৎসায় অচিরেই বেস্ট ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রটোকল তৈরি করবে, যা এখন সময়ের দাবি। সহজে রোগ নির্ণয় করতে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি।
ডা. শারমিন আব্বাসি
বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, ইএসবি