পঁচিশে যুগান্তর
দ্রব্যমূল্যে অস্থিরতা : উত্তরণের উপায়
পণ্য সরবরাহ ঠিক না থাকলে আইন প্রয়োগ করে লাভ নেই -ড. মসিউর রহমান * মজুতদারি করে সমস্যা তৈরি করলে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ -আহসানুল ইসলাম (টিটু) * সরকার ছাড় দিলেও ভোক্তারা সুফল পাচ্ছে না-অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম * সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যুগান্তরের এই আয়োজন-সাইফুল আলম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুগান্তরের পঁচিশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘দ্রব্যমূল্যে অস্থিরতা : উত্তরণের উপায়’ গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু), যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম, বিশেষজ্ঞ আলোচক বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী, ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান ও সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান -যুগান্তর
ড. মসিউর রহমান
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
একেক দেশের অর্থনীতির আচরণ ও কাঠামো ভিন্ন। যেমন: অনেকে বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু ওই দেশের অর্থনীতির কাঠামো ভিন্ন। শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হলো পর্যটন। আমাদের আয়ের উৎস পণ্য রপ্তানি। আরেকটি বিষয় হলো সমন্বয়ের অভাব। কিন্তু সমন্বয়ের জন্য কিংবা ভোক্তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় কি দরকার? খাদ্য মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়েও একটি মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট আছে। এ বিভাগগুলো ঠিকভাবে কাজ করে না বলে অনেকের ধারণা থাকতে পারে। গত কয়েক দশকের হিসাবে দেখা যায়, বাজারকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আমরা অনুসরণ করেছি। এর ফলে বেসরকারি খাত প্রসারিত হয়েছে। সরকার একা সব দায়িত্ব নিতে পারে না। সবাই দায়িত্ব নিলে কাজটা সহজ হয়। সবাই শুল্ককর কমানোর কথা বলে। কিন্তু শুল্ক কমালে সরকারের পক্ষে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বাজারের আচরণ বাজারকে করতে দিতে হবে। কিন্তু সেখানে আচরণ যাতে নিয়মমাফিক হয়, সেটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দেখতে পারে। প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য বা এসেনশিয়াল কমোডিটির সংজ্ঞার কথা আসছে। এক্ষেত্রে পণ্য আমরা জীবনধারণের জন্য ব্যবহার করি, সেটিই প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন জরুরি। কারণ সব সময় সবার খাদ্য ও পণ্যচাহিদা এক নয়। বাজারে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। কারণ, সরবরাহ নিশ্চিত না হলে যত আইন করা হোক, কোনো আইনই কার্যকর করা সম্ভব নয়।
আহসানুল ইসলাম (টিটু)
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর প্রথমদিন থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের ব্যাপারে ১৯৫৬ সালের একটি আইন আছে। সেই আইন অনুসারে আমরা কাজ শুরু করেছি। সেখানে ট্যারিফ কমিশনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোও কাজ করছে। যুগান্তরের আজকের এই আয়োজন এবং এ ধরনের একটি প্যানেল আমাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজারে গিয়ে দেখেছি চালের বস্তায় কোনো মার্কিং নেই। তাই এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুসারে আগামী এক মাসের মধ্যে চালের প্রতিটি বস্তায় ধানের জাত ও নাম, উপজেলা ও জেলা এবং মিলগেটের মূল্যসহ সবকিছু উল্লেখ করতে হবে। এর ফলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বড় একটি সফলতা। আরও একটি বড় কাজ রয়েছে। কৃষিপর্যায়ে পণ্য উৎপাদনের খরচ, খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য এবং ঢাকা মহানগরীর বাজারগুলোয় পাইকারি ও খুচরা মূল্য ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকবে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের যেসব ধানের জাত উৎপাদন করি, সেসব ধানের চাল বাজারে পাওয়া যায় না। আবার বাজারে যেসব চাল পাওয়া যায়, সে চাল আমরা উৎপাদন করি না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আগামী বোরো মৌসুম থেকে যে ধানের জাত, সেই জাতেই পাতে প্যাকিং করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। বিশেষ করে যে চালগুলো আমাদের বেশি উৎপাদন হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় গ্রহণযোগ্য নয়। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা এসব বিষয় নিশ্চিত করব। বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের আইনের কোনো অভাব নেই। প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের ১৯৫৬ সালের আইন আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনার আইন আছে। চালসংক্রান্ত আইন এবং আরও অনেক আইন আছে। অর্থাৎ আইনের কোনো অভাব নেই। এগুলো যথাযথ প্রয়োগ করা সম্ভব হলে বাজার শৃঙ্খলার মধ্যে থাকবে। তিনি বলেন, একটি জিনিসে একেবারেই বিশ্বাসী না, তা হলো মুক্তবাজার বলে কিছু নেই। এটি একটি ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব দেশেই কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটি বাজারে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা নয়। একে শৃঙ্খলা বলা উচিত।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, সাবেক মহিলা ও
শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং প্রকাশক, যুগান্তর
করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশও এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের দাম বেশি বেড়েছে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে খুব বেশি পড়েনি। ফলে সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন জনগণ। পণ্যের দাম অতিমাত্রায় বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে সরকার থেকে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে পণ্য আমদানির জন্য এলসি মার্জিন শিথিল, আমদানি পণ্যে শুল্কছাড় ও স্থানীয় পর্যায়ের আমদানিতে ভ্যাট কমানো হয়। কিন্তু কোনো সময় ভোক্তারা এর প্রকৃত সুফল পান না। সরকার যে ছাড় দিচ্ছে, এর সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। তবে প্রথমে দেশের জনসংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করে মাথাপিছু চাহিদা ও খাদ্যশস্যের চাহিদার হিসাব বের করা উচিত। এরপর মোট উৎপাদন থেকে নষ্ট ও ক্ষতির অংশ বাদ দিয়ে নিট খাদ্য ও চাহিদার হিসাব মেলাতে হবে। এছাড়া অসৎ মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। বাজারে পণ্যের জোগান ঠিক থাকলেও গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি পণ্য মজুত ও অতিমুনাফার মাধ্যমে মানুষের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসাবে যুগান্তর এই গোলটেবিলের আয়োজন করেছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
সাইফুল আলম
সম্পাদক, যুগান্তর ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব
যুগান্তর বিশ্বাস করে, শুধু সংবাদ প্রকাশই একটি গণমাধ্যমের দায়িত্ব নয়। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতিও গণমাধ্যমের দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সে কারণেই যুগান্তর অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অত্যাচারী-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, কালোবাজারির বিরুদ্ধে তথাকথিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সব সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। আজ যুগান্তর পঁচিশে পদার্পণে আবারও পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, যুগান্তরের এই অঙ্গীকার-আরও শক্তিশালীভাবে মানুষের সঙ্গে থাকব, জনগণের সঙ্গে থাকব, দেশের অগ্রযাত্রার সঙ্গে থাকব।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান
সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
যুগান্তরের অর্থনৈতিক প্রতিবেদনগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি। আমরাও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মধ্য দিয়ে যুগান্তরের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে পারি। মূল্যস্ফীতি এমন একটি বিষয়, যার ফলে নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে যেতে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হলো পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া। আর অস্থিরতা হলো যখন দাম বাড়ে ও কমে, তখনই অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে মূল্যস্ফীতি কমে গেলেও পণ্যের দাম নাও কমতে পারে। কারণ, একটি বেইজ দাম থেকেই যায়। মূল্যস্ফীতি কমলেও ওই বেইজ দামের নিচে পণ্যমূল্য আর নামবে না। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়াতে হবে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে। এই ঝুঁকি সামাল দিতে পারলে একদিকে যেমন আয় বাড়বে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও কমবে। সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন: সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করা হচ্ছে। ক্রেডিট আপডেট করা হয়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সুদের হার বাড়লে সেটি আবার উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়ে। মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নির্ভর করছে।
এমকে মুজেরী
সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস
যুগান্তরের বিশেষত্ব হচ্ছে, একঝাঁক তরুণ সাংবাদিক রয়েছেন যারা সব সময় অর্থনৈতিক সংবাদ ও বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করছেন। অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে আমার এটা ভালো লাগে। আজকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে বলতে চাই, মূল্যস্ফীতি ও অস্থিরতার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কিছু কারণ থাকে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এসব পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু অস্থিরতার কারণ কি? আমরা মূল্যস্ফীতির কারণে না গিয়ে দেখতে পারি কী কী কারণ অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং কীভাবে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়। এক্ষেত্রে দুভাবে আমরা দেখতে পারি। স্বল্পকালীন এবং কাঠামোগত বা দীর্ঘকালীন কারণ। এই স্বল্প ও দীর্ঘকালীন কারণের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো দরকার। যে কোনো পণ্যের মূল্যশৃঙ্খল রয়েছে। যেমন ধান বা চালের মধ্যে উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত শৃঙ্খল ধারণা থাকতে হবে। মূল্যশৃঙ্খল প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। তাহলে দুরভিসন্ধি থাকলেও কেউ তা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আমাদের দেশে চালের মূল্যশৃঙ্খল প্রতিযোগিতামূলক নয়। এ শৃঙ্খলে যারা যুক্ত আছে তারা কেউ দুর্বল, কেউ সবল আবার কেউ অতি সবল। ফলে সবলেরা বেশি সুবিধা নিতে পারে। যে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। আমদানি ও দেশীয় উৎপাদিত পণ্যেও এটা হতে পারে। মূল্যশৃঙ্খলে দুর্বল ও সবল চিহ্নিত করতে হবে।
গোলাম রহমান
সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে দেশের একটি শ্রেণির লোকের কিছু যায় আসে না। আবার কিছু কম মানুষের দুবেলা খাওয়া-দাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশ বিভিন্ন ভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। সক্ষমও হয়েছে। দেশে যত সমস্যা আছে, যত বিষয় আছে, এটাকে কেন্দ্র করে একটি করে মন্ত্রণালয়ও আছে। আজকের যে সমস্য আলোচনা করছি, দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি। এ সমস্যা সমাধান কোন মন্ত্রণালয় করবে সেটি ঠিক করতে হবে। মূল্যস্ফীতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেখার বিষয় নয়। এটা অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হতে হবে। পণ্যমূল্যের কারণে মানুষ কষ্টে আছে। নতুন সরকার আসার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সমন্বিত কার্যক্রমের কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী কয়েকটি মন্ত্রণালয় নিয়ে সভাও করেছেন।
কিন্তু সমন্বয়ে কারও না কারও দায়িত্ব থাকতে হবে। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আবার তিনি এও বলেছিলেন, আমি যদি আলু আমদানি করতে চাই, তাহলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। চাল আমদানির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। অর্থাৎ পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাধীনতা নেই। তাই আমি শক্তভাবে অনুভব করি, এখানে সমন্বয়ের খুব বেশি প্রয়োজন আছে। আর সমন্বয়ের জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ফুড অ্যান্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন নামে একটি মন্ত্রণালয় আছে। আমাদের দেশেও একটা থাকা উচিত। আমি ক্যাবের মাধ্যমে জোর দিয়ে বলছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি ডিভিশন থাকা উচিত। একটি হলো ভোক্তাবিষয়ক, আরেকটি বাণিজ্যবিষয়ক বিভাগ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব চিরাচরিত বিষয় সেগুলো বাণিজ্যবিষয়ক বিভাগ দেখবে। আর ভোক্তাবিষয়ক বিভাগ ভোক্তা অধিকার আইনসহ ভোক্তার স্বার্থে আইন, আমদানি-রপ্তানি নিরীক্ষা করা ও সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করবে।
ড. বদরুন নেছা আহমেদ
রিসার্স ফেলো, বিআইডিএস
২০২৩ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবার বর্তমানে উদ্বিগ্ন রয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত বা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস করছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে জনসংখ্যার একটি অংশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসতে বাধ্য করেছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণি পর্যন্ত। পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের নানা পদক্ষেপ যেমন বাজার মনিটরিং, ওএমএস, টিসিবির কার্ড দেওয়া ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইত্যাদি সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য নাকি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া দ্রব্যমূল্য? এ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত দাম একবার বাড়লে তা কমে আর আগের জায়গায় আসে না।
উদাহরণ হিসাবে ২০১৩ সালে চাল ছিল প্রতি কোজি ৩৬ টাকা, সেটি ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আরও বেড়ে হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা প্রতি কেজি। একই ভাবে দাম বেড়েছে মাংস, পোলট্রি মুরগি, সয়াবিন তেল, ডিমসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যেরই। এছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রতিবছর ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার গণণা করা হয়েছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যেখানে দশকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার ছিল অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি। বাংলাদেশে ২০২১ সাল থেকে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে তিনি বলেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে মূলত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান বাহ্যিক কারণ হলো কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার ব্ল্যাক সি গ্রেইন চুক্তি প্রত্যাহার, ডলারের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন অস্থিরতা অন্যতম।
অভ্যন্তরীণ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, টাকার অবমূল্যায়ন খাদ্য আমদানিকে ব্যয়বহুল করেছে। এছাড়া দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে ভোক্তা যত বেশি দামেই খাদ্যদ্রব্য কিনুন না কেন উৎপাদন বা কৃষক ন্যায্য দাম পান না। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক পরিবহণ ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিক্রয় কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় কমিশন বা খরচের কারণে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হচ্ছে। পাশাপাশি ডিজেল, কেরোসিন, অকটেনসহ বিভিন্ন জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, চিনি ও চাল বাদে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। গম, ভুট্টা ও তেলের দাম কমেছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে পাইকারি বাজারে দামের কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেলেও খুচরা পর্যায়ে তেমন লক্ষণীয় প্রভাব সৃষ্টি হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল ও গমের দাম ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এলেও দেশে আটার দাম আগের মতোই আছে। আরও যেসব কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে সেগুলো হলো-চীন ও ভারতের মতো সরাসরি রাশিয়া থেকে তেল না কিনে পশ্চিমা দেশ থেকে তেল কেনা হচ্ছে। এতে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যে।
প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন
দেশে প্রতিযোগিতা কমিশন আইন হয় ২০১২ সালে। এরপর ২০১৬ সালে গঠন করা হয় কমিশন। ২০২২ বিধিমালা হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজির মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতা নষ্ট করে দিচ্ছে। সেটি প্রতিরোধ করতেই কাজ করছে প্রতিযোগিতা কমিশন। আমরা সিভিল কোর্টের আঙ্গিকে কাজ করছি। অলিগপলি, মনোপলি বা ষড়যন্ত্র করে পণ্যমূল্য বাড়ানো এরকম ৯৫টি মামলা এখন পর্যন্ত রুজু হয়েছে। এর মধ্যে ৫০টির মতো আমরা নিষ্পত্তি করেছি। ব্যাপক অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে পোলট্রি শিল্পের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে এখন বাজারে পোলট্রি মাংসের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। আমাদের কাজ বিজনেসকে উৎসাহিত করা, বাধা দেওয়া নয়। যারা সততা ও সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করতে চান তাদের কোনো সমস্যা নেই। আর যারা অন্যকিছু চিন্তা করে তাদের বিরুদ্ধে ডাক, কুরিয়ার, সরাসরি বা যে কোনো মাধ্যমে আমাদের কাছে অভিযোগ করা যেতে পারে। বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে সৎ ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সহায়তা দিতে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
মোহাম্মদ এমরান মাস্টার
সভাপতি, বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতি
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন আর কোনো বিশেষ সংবাদ নয়। বরং এটি নিত্য সত্য। যা আজকের আলোচনার অতীব প্রাসঙ্গিক বিষয়। আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে চাহিদা এবং জোগানে ভারসাম্যহীনতা অন্যতম কারণ হলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে আরও বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সংরক্ষণ ও সরবরাহ বণ্টনে অব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিরিক্ত পরিবহণ ভাড়া, কর বৃদ্ধি, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার, চাঁদাবাজি, চোরাচালানি, কালোটাকার দৌরাত্ম্য, ঘুস, দুর্নীতিসহ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, করোনা প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ও আন্তর্জাতিকবাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, অসুস্থ প্রতিযোগিতাসহ সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকলে তখন আর করণীয় বা গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়ে না। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে গেলেই তখনই শুধু করণীয় বা গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়ে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে অধিক পরিমাণে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে সরবরাহ এবং বণ্টনের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত এবং কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ জরুরি। পচনশীল ভোগ্যপণ্যের অপচয় বা নষ্ট রোধে আড়ত বা পাইকারি বাজারগুলোর পাশে কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করতে হবে। কোনো দ্রব্যের উৎপাদন-সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে বা ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিলে অধিক পরিমাণ আমদানিতে উৎসাহিত করা উচিত।
এহসানুল হক বাবু
উপসম্পাদক, যুগান্তর
নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী শত্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে দাম। তবে সরকারও বসে নেই। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড় এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। এসব নিয়ে যুগান্তরের আয়োজন। এই আয়োজনের মাধ্যমে আমরা সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরতে চাই। যা পরবর্তী সময়ে সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে।
১৬ দফা সুপারিশ
দীর্ঘমেয়াদি
১. সরকারি তথ্য-উপাত্তে বড় গরমিল আছে। এটি দূর করে পণ্যের প্রকৃত চাহিদা ও উৎপাদন নিরূপণ। এরপর আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন ও মজুতের পরিকল্পনা গ্রহণ।
২. ভোক্তা বা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের জন্য সমন্বয় মন্ত্রণালয় গঠন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের মন্ত্রণালয় রয়েছে।
৩. কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ।
মধ্যমেয়াদি
১. বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুটি বিভাগ থাকবে-ভোক্তা বিভাগ ও বাণিজ্য বিভাগ।
২. রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়।
৩. কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু এবং ফিউচার্স মার্কেট চালু।
৪. পচনশীল ভোগ্যপণ্যের অপচয় রোধে আড়ত বা পাইকারি বাজারের পাশে কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন।
৫. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানো।
৬. জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করা।
স্বল্পমেয়াদি
১. প্রয়োজনীয় নিত্যপণের সংজ্ঞা নির্ধারণ।
২. সরবরাহ বাড়ানো এবং বণ্টনের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
৩. পণ্যের দাম বাড়ানো এবং রপ্তানি বন্ধের ব্যাপারে ভারত যাতে আগে সরকারকে অবহিত করে, এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি।
এ ব্যাপারে সেপারকে (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) কাজে লাগানো।
৪. অসাধু সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. পরিবহণসহ বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ।
৬. বিভিন্ন পণ্যের ভ্যালু চেইন বা মূল্যশৃঙ্খলে প্রতিযোগিতা বাড়ানো।
৭. জরুরি কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় এবং মানুষ যাতে এ সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করা।