গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও করণীয় জানুন
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। দিনটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও দৈনিক যুগান্তরের উদ্যোগে এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগিতায় সম্প্রতি একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। তারা বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা তুলে ধরার পাশাপাশি রোগটির লক্ষণ, ঝুঁকি, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে করণীয় বিভিন্ন দিক নিয়েও আলোচনা করেন।
প্রতি ৭ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সর্বশেষ বুলেটিনে জানা গেছে, পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রি-ডায়াবেটিস অর্থাৎ ডায়াবেটিসের পূর্ব অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে পূর্ণ বয়স্কদের মধ্যে প্রতি ৭ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রতি ৪ জনে ১ জন প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিক রোগী দেশে বেড়ে যাওয়ার জন্য তিনটি ফ্যাক্টর দায়ী। এগুলো হচ্ছে-নগরায়ণ বা আধুনিক জীবন প্রণালিতে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ এবং গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া। নগরায়ণের ফলে আমাদের কায়িক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে, হাঁটা বা ব্যায়ামের জন্য মূলত জায়গা, পার্ক ও মাঠের অপ্রতুলতা, খেলাধুলা কমে যাচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছি। পক্ষান্তরে শাকসবজি ও ফল কম খাচ্ছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘুম কমে যাওয়া, ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তন হওয়া, দেরিতে ঘুমানো ও দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
-অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান, সভাপতি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও সিনিয়র কনসালটেন্ট, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা
ডায়াবেটিক রোগীদের ৬ বেলা খেতে হবে
ডায়াবেটিক ও নন ডায়াবেটিক রোগীদের প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ খাবারে ৫০-৫৫ ভাগ শর্করা, ২০-২৫ ভাগ প্রোটিন, ৩০-৩৫ ভাগ ফ্যাট থাকবে। সঙ্গে ভিটামিন, মিনারেলস, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস ও পানি থাকতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের ৬ বেলা খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সকাল ৮টা থেকে সাড়ে আটটায় হালকা নাশতা, বেলা ১১টায় হালকা স্ন্যাকস, দুপুর ২টায় লাঞ্চ, বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টায় হালকা নাশতা, রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টায় ডিনার এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাত সাড়ে দশটা থেকে ১১টায় হালকা নাশতা যেমন বিস্কুট, মুড়ি খেতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শর্করা, অর্থাৎ প্রতিদিন ৮০-৯০ শতাংশ এ খাদ্য উপাদান গ্রহণ করছে। পক্ষান্তরে কম প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণ করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অল্প পরিমাণ অর্থাৎ মাত্র ৫-১০ ভাগ শর্করা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। একে কিটোডায়েট বলা হচ্ছে। এ পরিমাণ শর্করা গ্রহণ করলে হার্টঅ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কিংবা মাঝারি বা লম্বা সময় না খেয়ে থাকার কিছু উপকার থাকতে পারে।
-ডা. এম সাইফুদ্দিন, বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি, সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
স্বাস্থ্যবান জাতি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে আপনারা যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যুগান্তরের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করলেন, পরামর্শ দিলেন, তা গণমাধ্যম হিসাবে যুগান্তর প্রকাশ করবে। এতে যুগান্তরের পাঠক, অনলাইনের শ্রোতা কিছু না কিছু উপকৃত হবেন। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা নীতিমালা প্রণয়ন করেন, তারা স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলোচকদের সুপারিশ যদি বাস্তবায়ন করেন, তাহলে দেশের নাগরিকরা উপকৃত হবেন। শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যে যদি জীবনযাপন করা যায় তাহলে ডায়াবেটিস নিয়েও দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। মানবতার সঙ্গে চিকিৎসা পেশা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ডাক্তারি পেশায় রোগীদের সঙ্গে রোগ নিয়ে কাউন্সেলিং রোগ আরোগ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করি। রোগীরা কেন বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারেও আপনারা খতিয়ে দেখবেন বলে আশা করি। হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধায় যদি ঘাটতি থেকে থাকে, তাও পূরণ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এ কলেজগুলো দক্ষ চিকিৎসক তৈরির জন্য কতটা মানসম্মত, সেটিও দেখতে হবে। দেশে ভালো চিকিৎসক আছে, উন্নত চিকিৎসাও হচ্ছে। তারপরও কাউন্সেলিং ও আস্থার সংকটে অনেকে বিদেশে যাচ্ছেন। বিষয়টি সশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা উচিত।
-সাইফুল আলম, সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব
ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে দ্রুত পরামর্শ নিন
ডায়াবেটিক রোগীদের যদি উচ্চরক্তচাপ থাকে এবং তা অনিয়ন্ত্রিত থাকে তবে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীর উচ্চরক্তচাপ থাকলে সেটা ১৩০/৮০-এর নিচে রাখতে হবে। যদি এর চেয়ে রক্তচাপ বেশি হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোন রোগীর জন্য কোন ওষুধের প্রয়োজন তা রোগের সঠিক অবস্থা ও কী কী শারীরিক জটিলতা আছে তা জেনে নির্ধারণ করা হয়। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রোগীদের আয়ুষ্কাল নন-ডায়াবেটিস ও ননহাইপারটেনসিভের প্রায় সমান। এরা স্বাভাবিক জীবনযাপন পালন করতে সক্ষম।
-ডা. মির্জা শরিফুজ্জামান, সদস্য (নির্বাহী কমিটি), বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি, সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
কারা ঝুঁকিতে আছেন তা জানা জরুরি
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘নো ইয়োর রিস্ক, নো ইয়োর রেসপন্স’ অর্থাৎ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে আপনার ঝুঁকি জানুন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। ডায়াবেটিসের কিছু ঝুঁকি পরিবর্তন করা যায় এবং কিছু যায় না। কারও পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বংশে ডায়াবেটিস থাকলে, কায়িক পরিশ্রম না করলে, শারীরিক ওজন ও মেদ বাড়লে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া যাদের উচ্চরক্তচাপ ও হার্টের রোগ আছে, কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, ধূমপায়ী ও শরীরে ইনসুলিন রেসিসট্যান্স বা ইনসুলিন কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে তারাও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। যে গর্ভবতী গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিসে ভুগছে এবং ৯ পাউন্ডের বেশি সন্তান জন্মদান করেছে তারাও বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। ইনসুলিন রেসিসট্যান্টে গলায় ও বগলে কালো কালো দাগ থাকে। যত বেশি ঝুঁকি থাকবে তত বেশি ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ঝুঁকি জেনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে, পরীক্ষা করে জানতে হবে ডায়াবেটিস হওয়ার তার মধ্যে কী কী ঝুঁকি আছে। ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে অতিসত্বর ডায়াবেটিস সেবা কেন্দ্রে গিয়ে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা এন্ডোক্রাইনোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। পরীক্ষা করে যদি ডায়াবেটিস হওয়ার কোনো ঝুঁকি পাওয়া যায় কিন্তু ডায়াবেটিস এখনো হয়নি এমন ব্যক্তিদের শারীরিক ওজন কমানো, কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো যায়। এ ঝুঁকি কমিয়ে ৫০-৬০ ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। যাদের ডায়াবেটিস হয়ে গেছে তারা যেন ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকে মুক্ত থাকে। যত দ্রুত রোগ শনাক্ত ও দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় তত জটিলতা এড়ানো যায়। এদের রক্তচাপ থাকলে নিয়ন্ত্রণ, কোলেস্টেরল থাকলে তা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা ও ধূমপান পরিহারের মাধ্যমে জটিলতা থেকে দূরে থাকা যায়।
-অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান, প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও পরিচালক (শিক্ষা), বারডেম, ঢাকা
রোগীর ব্যায়ামের গুরুত্ব বোঝা উচিত
প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যায়াম করার জন্য ডায়াবেটিক রোগীদের পরামর্শ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া হয়। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট বা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৫-৭ দিন নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তেমনি শারীরিক ও মানসিক উপকারিতাও আছে। ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, জয়েন্টের ব্যথা নিরাময়, হাড়ের সুগঠন ও ভালো ঘুমের জন্য ব্যায়ামের প্রয়োজন। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণেও ব্যায়ামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হাটের সমস্যা ও স্ট্রোক এড়াতেও ব্যায়ামের কার্যকারিতা রয়েছে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্যও ব্যায়ামের উপকারিতা আছে। শুধু চাইপ-২ ডায়াবেটিস নয়, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরাও যেন ব্যায়াম করেন তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যায়ামের ফলে শারীরিক ওজন ও অন্যান্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকেও দূরে থাকা যায়।
-ডা. ফারিয়া আফসানা, সহসভাপতি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বারডেম, ঢাকা
নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন
ডায়াবেটিক রোগীর রোগ সুনিয়ন্ত্রণে রাখা ও সঙ্গে অন্যান্য রোগব্যাধি আছে কি না, তা জানার জন্য নিয়মিত বিরতিতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। প্রথমেই তিন মাসের রক্তের গড় গ্লুকোজের মান বা এইচবিএওয়ান-সি যা ৩-৬ মাস অন্তর পরীক্ষা করা দরকার। এটি ৭ শতাংশের নিচে থাকলে বোঝা যাবে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে। ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে খারাপ চর্বি বা কোলেস্টেরল আছে কিনা তা জানার জন্য বছরে ২-৩ বার পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কিডনি সুস্থ আছে কি না, তা বোঝার জন্য রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও প্রস্রাবের অ্যালবুমিন এবং অ্যালবুমিন-ক্রিয়েটিনিনের অনুপাত জেনে নিতে হবে। বর্তমানে ডায়াবেটিসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ফ্যাটিলিভার। যকৃত সুস্থ আছে কিনা বা এর সঙ্গে চর্বি জমে ফ্যাটিলিভার সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা জানার জন্য লিভার ফাংশন টেস্ট করা জরুরি।
-ডা. মারুফা মোস্তারী, দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি, সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ
ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব
দেশে বিশালসংখ্যক ডায়াবেটিক রোগী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা দেওয়া বাংলাদেশের জন্য দুরূহ। এজন্য প্রতিরোধের দিক আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আরও ৭০ লাখ মানুষ প্রিডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থায় রয়েছে। এদের খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস ঠেকাতে পারলে আমরা স্বাস্থ্য খাতের ওপর বোঝা কিছুটা লাঘব করতে পারব। উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ শারীরিক ওজন বজায় রাখতে হবে, শতকরা ৫-৭ ভাগ ওজন হ্রাস, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, ধূমপান পরিহার, চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট পরিহারের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩০-৬০ ভাগ কমানো সম্ভব। তবে সব রোগীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সঠিক লাইফস্টাইলের মাধ্যমে আমরা তাদের ডায়াবেটিস দেরিতে শনাক্ত করা সম্ভব করতে পারি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত দায়িত্ব পালন ও সঠিক ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব।
-ডা. আহমেদ ইফরাদ বিন রউনাক, সদস্য, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি, মেডিকেল অফিসার, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ
আধুনিক ও বিশ্বমানের ওষুধ দেশে আমরা সহজলভ্য করেছি
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল চিকিৎসকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে নিরলস কাজ করছে। ডায়াবেটিসের মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনসুলিন আমরা উৎপাদন করে তা স্বল্পমূল্যে বাজারজাত করছি। বিশ্বে যে আধুনিক ওষুধ আছে, সবই এদেশে আমরা উৎপাদন করছি। ডাক্তারদের জ্ঞান উৎকর্ষের জন্য আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে এদেশের চিকিৎসকদের আমরা সহযোগিতা করছি। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও আমেরিকার মায়ো ক্লিনিক যে প্রোগ্রাম করে তাতেও ইনসেপ্টা নিজেকে সম্পৃক্ত রাখে।
-আশরাফ উদ্দিন আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক (সেলস)
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
জটিলতা এড়াতে ইনসুলিন প্রয়োজন
ডায়াবেটিস চিকিৎসার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ইনজেকটেবল ওষুধ এবং ইনসুলিন। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে যেখানে রোগীর শরীরে ইনসুলিন তৈরিই হয় না, এ রোগীকে ইনসুলিন না দিলে জটিলতা হিসাবে ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে যে ইনসুলিন তৈরি হয় তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। মুখে খাওয়ার যে ওষুধগুলো ডায়াবেটিসে ব্যবহৃত হয় তার কোনোটিই ইনসুলিন তৈরি করে না, এ ওষুধগুলো ইনসুলিন বের করতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিক রোগী ওষুধ খেতে খেতে যখন ডোজ বাড়িয়েও ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে থাকছে না তখন ইনসুলিন ব্যবহার অবশ্যই শুরু করতে হবে। এ রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়াতে গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের সুগার অবশ্যই টার্গেটে রাখতে হবে। দেরিতে ইনসুলিন শুরু করলে বিটা সেলের পরিমাণ কমে যাবে, ফলে দ্রুত জটিলতা দেখা দেবে। কাকে কোন ইনসুলিন দেব তা নির্ভর করে ওই রোগীর রক্তের গ্লকোজের পরিমাপের ওপর।
-অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ আমিন
সহসভাপতি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি এবং অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বারডেম
মায়েদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
ডায়াবেটিস আক্রান্ত মা সন্তান নিতে চাইলে গর্ভধারণের আগেই ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাদের উচ্চরক্তচাপ, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলে কিংবা ডায়াবেটিসজনিত কোনো জটিলতা থাকলে তাও চিকিৎসার মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে গর্ভধারণ করতে হবে। যে নারী ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন, যেমন-যাদের বংশে ডায়াবেটিস আছে, যারা ওজনাধিক্যে ভুগছেন, যাদের গর্ভধারণে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে, যেমন বারবার অ্যাবরশন হয়েছে, পেটে বাচ্চা মারা গিয়েছে বা পূর্বে বর্ডারলাইন ডায়াবেটিস ছিল-এ নারীদের গর্ভধারণের আগে কিছু পরীক্ষা করে নিতে হবে। খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়ামের সঙ্গে প্রয়োজনে নিরাপদ ইনসুলিন দিতে হবে। গর্ভধারণের প্রস্তুতির জন্য মুখে খাওয়ার কোনো ডায়াবেটিসের ওষুধ এ নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। এ নারীরা গর্ভধারণকালীন পুরো সময় ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা নেবেন। কারণ ইনসুলিন মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার দেহে প্রবেশ করতে পারে না। নবজাতকের জন্মের পর পূর্ব থেকে আক্রান্ত ডায়াবেটিস মায়েদের নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে।
-ডা. সুলতানা মারুফা শেফিন, সদস্য (নির্বাহী কমিটি), বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি, সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ইবনে-সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
রোগীভেদে ওষুধ নির্বাচন করতে হয়
কোন অসুখের জন্য কী ওষুধ দিতে হবে, সেটা নির্বাচনে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। একই ধরনের সুগার থাকলেও একেক রোগীর জন্য একেক ধরনের ওষুধ নির্বাচন করা হয়। এটি নির্ভর করে রোগী কীভাবে তার রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, রোগের তীব্রতা কেমন, তার আনুষঙ্গিক কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান যেমন-স্থূলতা, হৃৎপিণ্ডের অসুখ আছে কিনা, ওষুধের কার্যকারিতা কোন ধরনের, রক্তের গ্লুকোজ কমানোর পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাবে কিনা, কিডনি রোগের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করবে কিনা-এগুলো ওষুধ নর্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কত দ্রুত রোগী হাইপো হতে পারে, ওজন কতটা বৃদ্ধি পাবে, কিডনির কার্যকারিতা ঠিক রেখে কত মাত্রার ওষুধ দেয়া যায়-এগুলোও ওষুধ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। রোগীর পেশা, রোগী চিকিৎসা পরামর্শ মেনে চলবে কিনা ইত্যাদি ফ্যাক্টরও ওষুধ নির্বাচনে লক্ষ রাখতে হয়। রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসার খরচ সংগতিপূর্ণ হওয়া উচিত। ওষুধ সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণাও দূর করতে হবে।
-ডা. আফসার আহাম্মদ মেরাজ, সদস্য (নির্বাহী কমিটি), বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, নিটোর
ভেষজ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নয়
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ভেষজ বা হারবালের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোনো গাইডলাইনেও ভেষজ ব্যবহার করার কথা বলা হয়নি। রোগীরা না জেনে বা বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ হয়ে এ ধরনের ভেষজ সেবন করার ফলে ডায়াবেটিস তো নিয়ন্ত্রণে থাকছেই না, বরং অনিয়ন্ত্রিত হয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করছে। মরিঙ্গা, সজনে পাতাসহ বিভিন্ন হার্বস এ রোগীরা গ্রহণ করে থাকে। এর জটিলতায় ডায়াবেটিস কিটোঅ্যাসিডোসিস বা হাইপার অসমোলার স্টেট, কোমায় রোগী আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে নেফ্রোপ্যাথি বা কিডনি বৈকল্য, নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুবৈকল্য, চোখের রেটিনোপ্যাথি হয়ে রোগীর বড় ধরনের ক্ষতি হয়। এর ফলে অঙ্গহানিও হতে পারে। তাই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হয়ে সঠিক চিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। এ সচেতনতার জন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
-ডা. এসএম মহিউদ্দিন
সদস্য (নির্বাহী কমিটি), বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি এবং সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল
লক্ষণের জন্য অপেক্ষা নয়
শুধু ডায়াবেটিস নয়, সব রোগের কিছু লক্ষণ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু লক্ষণগুলোর উপস্থাপনা এবং প্রকাশ পাওয়া ও ধরন-ধারণ একরকম নয়। এটি ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের লক্ষণ খুব স্পস্ট থাকে। যেমন-ঘনঘন প্রস্রাব হয়, পানি পিপাসা পাওয়া, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, দুর্বল লাগা, অস্বাভাবিক ইনফেকশন বা ঘনঘন ইনফেকশন হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ রোগী টাইপ-২-তে আক্রান্ত। কিন্তু এদের কোনো লক্ষণ কখনো নাও দেখা দিতে পারে। প্রতি ৪ জনে ৩ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী লক্ষণবিহীন অবস্থায় কোনো কারণে ডাক্তারের কাছে গেলে রোগটি শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৬১.৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী মনে করেন তিনি ডায়াবেটিসের রোগী নন, কারণ তাদের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ রোগীরা লক্ষণবিহীন অবস্থায় থেকে ডায়াবেটিসজনিত কোনো জটিলতা হওয়ার পর ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি তারা লক্ষণের জন্য অপেক্ষা না করে টেস্ট করে ডায়াবেটিসের অবস্থা সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
- ডা. শাহজাদা সেলিম
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি এবং সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ
সুপারিশ
* রোগীর আর্থসামাজিক অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসার খরচ সংগতিপূর্ণ হওয়া উচিত।
* ওষুধ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্তধারণা দূর করতে হবে।
* ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ যেহেতু সারা জীবনের রোগ, তাই জীবনব্যাপী এ অসুখের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
* পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম যাদের আছে, তারা ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করিয়ে নেবেন।
* শুধু টাইপ-২ ডায়াবেটিস নয়, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরাও যেন ব্যায়াম করেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
* অ্যাগ্রিকালচারে বিভিন্ন কীটনাশক, ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
* শারীরিক ওজন বেড়ে যাওয়া ও স্থূলতাও স্বাস্থ্যহানিকর। তাই সমাজের সর্বস্তরের দায়িত্ব হচ্ছে পরিবেশ দূষণ রোধে কাজ করা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অর্থাৎ কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
* বুকের দুধ খাওয়ানো মা এবং যারা ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন কিন্তু গর্ভধারণকালীন তাদের রক্তের গ্লুকোজ রিপোর্ট নরমাল এসেছে, তাদের দেখতে হবে তারা নতুন করে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কিনা।
* ইনসুলিন দিয়ে গর্ভবতীর চিকিৎসা না হলে অ্যাবরশন, নবজাতকের জন্মগত ত্রুটি ও গর্ভের শেষ পর্যায়ে বাচ্চা মারা যাওয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।
* ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের রক্তনালি বা স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে।
* বয়স্ক কিংবা শারীরিক বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে আছেন তারা হৃদরোগের পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
* ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য দুই বেলা রুটি, একবেলা ভাত ও দিনে ছয়বার খাবার গ্রহণ সুষম খাবার।