
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪৩ এএম
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন

সেলিম আল রাজ
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
সকাল বেলা। মনে অন্যরকম অনুভূতি। এর অবশ্য কারণ আছে। প্রথমত বাকৃবির ক্যাম্পাসটা দারুণ সুন্দর। বেশ ভালো লাগে। সাজানো-গুছানো সবকিছু। দ্বিতীয়ত, সঙ্গে দুজন অতিথি। তাদের এই প্রথম আসা। মনোরম পরিবেশে মুগ্ধ রনি আর কাজল।
বাকৃবির শহিদ মিনারটা অন্য ধাঁচের সুউঁচু শিরে দাঁড়ানো। পাশেই পলাশ গাছ। ফুলে ফুলে সাজানো ডালপালা। আমাকে ক্রস করে কাজলই প্রথম এগিয়ে গেল গাছটার গোড়ায়। ফুল ধরার বৃথা চেষ্টা। অবশ্য ফুল নিতে চেয়ে ছিল তার জন্য নয়, মায়ের জন্য। কাজলের মা ভীষণ পলাশ ফুল পছন্দ করে। মায়ের হাতে একগুচ্ছ ফুল দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কাজলের আক্ষেপ ভুলানোর চেষ্টায় হাতে থাকা ক্যামেরা উঁচিয়ে ইশারা করলাম। পলাশ ফুলের সঙ্গে নানা ভঙ্গিমায় ফ্রেমবন্দি হলাম তিনজনে। ক্ষণিকেই হাস্যোজ্জ্বল কিছু মুহূর্ত।
বারোটার পর থেকে মৃদু রোদ ডানা মেলল। টিপিটিপি পায়ে ঘুরে দেখা সৌন্দর্য। পিচঢালা রাস্তার দুপাশে সবুজ ঘাসের মাঠ। টিএসসি চত্বরের ফুলবাগানে সারিবদ্ধ নানা ফুলের গাছ। ফুলের সুভাসে মৌমাছি আর প্রজাপতির আপন মনে খেলা। দুপুর দিকে ঘোলাটে আবহাওয়ার ভাব। হাল্কা বাতাস। আকাশটা ক্ষণে ক্ষণে মেঘে ডাকা পড়ে। কিছুটা সময় মৌনতা। শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরা তরুণ-তরুণীর পথচলার দৃশ্য। কারও কারও সঙ্গে পরিবার পরিজন। বিজয় একাত্তর ভাস্কর্য হয়ে ফুচকার দোকানের সামানে দাঁড়ালাম। এ পরিবেশে খাওয়ার আমেজটা মন্দ না। ফুচকার সঙ্গে মিষ্টি টক, তা দিয়ে চলল কিছুক্ষণ।
তিনটি টিকিট নিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে ডান দিকে পা চলল। আমি সচরাচর যেভাবে হাঁটি সেভাবে হাঁটছি। একটু এগুতেই মনে হলো আমি দ্রুত যাচ্ছি। আবার চিন্তা করলাম, না তো। তাহলে। এবার নিশ্চিত হলাম রনির দিকে চেয়ে। তিনি হারিয়ে গেছেন উদ্ভিদ জগতে। বৃক্ষের সঙ্গে যে তার সখ্য নিমিষেই বুঝা গেল। ব্যাগে থাকা কাগজ কলম নিয়ে লিখে চলেছেন স্বর্ণঅসোক, রক্তকরবী, তমাল, হিজল, অশ্বগন্ধা, নাগলিঙ্গম, পানবিলাস, কালাবাস, সিলভিয়া, জেসিয়া, হৈমন্তি। পঁচিশ একর জায়গা বিস্তীর্ণ বোটানিক্যাল গার্ডেনটিতে রয়েছে বিরল প্রজাতির ছয়শর মতো উদ্ভিদ। ঔষধি, ফলজ, বনজ গাছের বিশাল সংগ্রহশালা। প্রত্যেক বৃক্ষের বুকে বাঁধা তাদের আত্মপরিচয়। বিচিত্র সব গাছের বৈশিষ্ট্য। ছোট, বড়, মাঝারি আকৃতির। একগাছ অন্যগাছ বেয়ে চলে গেছে বহুদূর। দ্বন্দ্ব সংঘাতহীন তাদের সমাজ। মিলে মিশে গড়ে ওঠা তাদের ভুবন। আমাদের সুবজ অরণ্য। তরুলতার মাঝে দাঁড়িয়ে পৃথিবীটা কল্পনা করলে অন্যরকম অনুভূতি জন্মে। পাশে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের এক পাশে বাকৃবি অন্যপাশে চর। চর পেরিয়ে মানুষের বসতি। নৌকা তাদের যাতায়াতের মাধ্যম। পাড়ের ধারে সারি সারি বেঞ্চিতে বসে মনোরম দৃশ্যগুলো স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে নিলাম।
আমরা তিনজন একই পেশার মানুষ। এইচএসটিটিআই এ পরিচয়। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। একেবারেই বন্ধ বলা যাবে না। সকালে প্রভাতফেরি শেষে শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। নয়টায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর টাউন হল হয়ে ব্রিজ মোড়। সেই থেকে অটো রিকশায় চড়ে সোজা বাকৃবির জব্বার প্রান্ত। বাকৃবি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাদীক্ষা গবেষণায় অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রজাতির নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে তার বিশেষ খ্যাতি। ভার্সিটির শেষ মোড় থেকে আমাদের ঘুরে দেখা। রেল স্টেশনের সমান্তরাল লাইনের মাঝে ফ্রেমবন্দি হই তিনজনই। সুন্দর সুন্দর আবাসিক হল ও অনুষদ ভবনগুলোর নান্দকিতা মুগ্ধ করে সবাইকে। সমৃদ্ধ বাকৃবি মিউজিয়াম। বিনা ইনস্টিটিউট হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে চললাম। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। ভাস্কর্যের চারপাশ মসৃণ সবুজ ঘাসে ঘেরা। নরম ঘাসের ওপর বসে আলাপচারিতায় মগ্ন হলাম তরুণ তিন প্রাণ। মূলত আটাশ দিনের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে এইচএসটিটিআই আসা আমাদের। আমি ময়মনসিংহ জেলার। রনি নেত্রকোণার আর কাজল মানিকগঞ্জ জেলার মানুষ। প্রথম থেকেই আমাদের ব্যাচের সবার সঙ্গে বেশ সখ্য, পরস্পর আন্তরিক সহযোগিতার মনোবৃত্তি। আজ ছিল প্রশিক্ষণের ২২তম দিন। ছুটির সময়টুকু উপভোগ করার জন্য বাকৃবিকে বেছে নেওয়া। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করা গাড়ির আনাগোনা চোখে পড়ে। রনি আমাদের জন্য তিনটা আইসক্রিম নিলেন। এসময় এক বৃদ্ধা এসে মিনতিভরা কণ্ঠে সাহায্য চাইলেন। কাজল তার ব্যাগ থেকে একটা নোট বের করে বৃদ্ধার হাতে দিল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। রনি তার হাতের আইসক্রিমটাও দিলেন। বৃদ্ধা আনন্দে আত্মহারা। সজলচোখে ওপর দিকে তার দুহাত উঠাল।
স্মৃতিস্তম্ভের সম্মুখে আমজাতীয় গাছে সুগন্ধি ফুলের মুকুল। ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য কাছে গেলাম। ভালো লাগার মতো পরিবেশ। ভার্সিটি ক্যাম্পাস ও নদীর দুধারের দৃশ্যগুলো উপভোগ করি। ব্রহ্মপুত্র থেকে আসা বাতাসে চুল উড়ে, মন দোলে। বেলা বাড়ে। সূর্য হেলে পড়ে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। বাস কিংবা ট্রেনে যেতে পারেন। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশের গণপরিবহণ চলাচল করে ময়মনসিংহ রোডে। শহরের প্রাণকেন্দ্র শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ মোড় থেকে মাত্র ১০ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারেন মনোরম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।