‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান/ ওরা আসবে, চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’। দেশাত্মবোধক এ গানের যে আবেদন-তা থাকবে ততদিন, যতদিন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড সার্বভৌমত্বের ভিত্তি নিয়ে জ্বলজ্বল করবে বিশ্ব মানচিত্রে। আর ততদিনই মঞ্চে কিংবা মহল্লার অলিগলিতে বাজতে থাকবে এমন অন্যান্য দেশপ্রেমের গান, বিজয়ের গান, স্বাধীনতার গান।
বিজয় দিবস বাঙালির অন্যতম উৎসবের দিন। এ দিনের আনন্দ আত্মিক। আত্মার এ প্রশান্তি বাঙালি প্রকাশ করে পোশাকে, আচারে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বিজয় দিবসের আগের দিনই মনেপ্রাণে বাঙালিরা সাজিয়ে তোলেন নিজের আঙিনা। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সাজিয়ে তোলেন স্কুল-কলেজ ভবন ও প্রাঙ্গণ। কাগজের তৈরি ছোট ছোট জাতীয় পতাকা দিয়ে বাড়ির চারপাশ সাজিয়ে তোলার প্রিয় সে সংস্কৃতি এখনো আছে। অনেক বাড়ির ছাদে শোভা পায় পতপত করে ওড়া বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বিজয় দিবসের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই পতাকার ফেরিওয়ালাদের জমজমাট ব্যবসা। আর এ সময়ই বাঙালির দেশাত্মবোধের প্রবল বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। বিজয়ের দিনে আনন্দের উপলব্ধি যোগ হয় বাঙালির পোশাক-আশাকে। লাল-সবুজের মিশেলে নিজেকে রঙিন করে তোলেন তারা। এখানেই বাঙালি অন্যান্য জাতি থেকে আলাদা, স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট খানিকটা ভিন্ন। তবু লাল-সবুজের পসরায় সাজবে দেশ, বিজয়ের গানে বিজয়ের বেশে রঙিন হবে বাঙালি-একথা বলাই যায়।
বাংলাদেশে বাঙালিদের সময়োপযোগী ফ্যাশনে অভ্যস্ত করেছে ফ্যাশন হাউজগুলো। তাদের সৃজনশীল মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বলেই বিজয় বা স্বাধীনতা দিবসে লাল-সবুজ পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন বাঙালিরা। শুধু পোশাকই নয়, পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য অনুষঙ্গেও বিজয়ের আবহ ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন তারা। দোপাট্টা, হিজাব, কানের দুল, খোঁপার ক্লিপ, হাতের চুড়ি-বালা, পুঁতির মালা, মাস্ক, গলার হার, ঘড়ি, চশমার ফ্রেম, মাথার হ্যাট-সব কিছুতেই যেন থাকতে হবে বিজয় দিবসের চিহ্ন। বিশেষ করে রুচিশীল বাঙালি তরুণ-তরুণীরা বিজয়ের দিনে এমন সাজে বের না হলে যেন তাদের বিজয়ের দিনটাই মাটি। রুচি আর সামর্থ্যরে সামঞ্জস্যে নিজেদের সাজান তারা।
প্রতি বছরই এ ধরনের উৎসব রাঙাতে বাঙালিদের উৎসাহী করে তোলে বাঙালিদের দেশের অন্যতম ফ্যাশন হাউজগুলো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কে-ক্র্যাফট, রঙ বাংলাদেশ, অঞ্জনস, নিপুণ, মেঘ, বাংলার মেলা, নিত্য উপহার, বিবিআনা, কারু বুটিক, সাদাকালো, দেশাল, নগরদোলা, নকশা, ফিওনা, সারা, লা-রিভ প্রভৃতি। শাড়ি, শার্ট, টি-শার্ট, টিউনিক, কুর্তি, টপস, পাঞ্জাবি, শাল, ব্লাউজ, ফতুয়া, কামিজ, ফ্রকে থাকে লাল-সবুজের মিশেলে ডিজাইন। সিল্ক, লিনেন, খদ্দর, জর্জেট কিংবা সুতি কাপড়ে স্ক্রিন প্রিন্ট, ব্লক প্রিন্ট, অ্যামব্রয়ডারি ইত্যাদির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয় মোটিফ। কেউ কেউ বিজয়ের পোশাকে টাইপোগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফির সমন্বয়ে তুলে ধরেন বাংলাদেশের পতাকার গ্রাফিক্যাল ফর্ম। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও বিশেষ আয়োজন থাকে প্রায় সব ফ্যাশন হাউজেই। পরিবারের সবার জন্য থাকবে ম্যাচিং পোশাক। যেন বিজয়ের আনন্দ পারিবারিকভাবে সবাই ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। তবে গত কয়েক বছরের মতো এবারও বিজয়ের দিনে শীতের প্রভাব বিরাজ করছে। এ কারণে লাল-সবুজকে প্রাধান্য দিলেও শীতকে মাথায় রেখেই ডিজাইনগুলো করবেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। তবে, সময় বিবেচনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের বিজয় দিবসের পোশাকে ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে।
এটা ঠিক, ডিজাইনে যে বৈচিত্র্যই রাখা হোক না কেন-বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে অন্যান্য উৎসবের মতো অতিরিক্ত খরচ বইতে হয় না ক্রেতাদের। দেশাত্মবোধের কথা মাথায় রেখে প্রায় প্রতিটি পোশাকই ক্রেতার নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে ফ্যাশন হাউজগুলো। যেন মনে না হয়, বাঙালির দেশপ্রেমকে পুঁজি করে বেনিয়াবৃত্তির সুযোগ নিচ্ছেন কেউ। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে হচ্ছে। দেশপ্রেম না থাকলে মানুষ হওয়ার অন্যতম শর্তই থাকল না। তবে শুধু দেশপ্রেমই নয়, বরং ধর্মীয় রীতিনীতির কথা মাথায় রেখে কুসংস্কারমুক্ত দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাটাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত।