শহর পেরোলেই দুপাশে চা বাগান। নাম মালনীছড়া। চায়ের জন্যই সিলেটকে বলা হয় দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ। যাওয়ার পথে অল্প সময়ের দেখা মিলল। আমরা কিছুটা সময় চা বাগানে বিরতি দিলাম। যেহেতু কোনো তাড়া নেই। চোখে এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে তখন। সবুজে আরাম। চোখের এ আরাম দিয়ে যাত্রা শুরু। আমাদের এবারের গন্তব্য ভোলাগঞ্জ সীমান্তে সাদাপাথর। এক সময় সিলেট ভ্রমণ মানেই ছিল চা বাগান দেখা, জাফলং, মাধবকুণ্ড। এখন অনেক জায়গা আবিষ্কৃত হয়েছে। আসলে আগেও ছিল সেই প্রকৃতি।
কিন্তু তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। এখন অনেক স্পট সুন্দরের অভ্যর্থনায় স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে। সাদাপাথরের দূরত্ব শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার। চা বাগান পেরিয়ে এয়ারপোর্ট যাওয়ার আগে বাইপাস মোড়। ডান দিকে আমাদের গাড়ি ইউটার্ন নিল। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা। শরতের আকাশ এ মেঘলা আবার একটু পরই ফরসা। প্রকৃতির মেজাজ এ সময় এমনই থাকে। সূর্যের তেমন তেজ নেই আজ। মনের আনন্দ তাই একটু বেশিই। আমার সঙ্গী এবার ছোট ভাই পল্লব ও ছানোয়ার ভাই।
ভোলাগঞ্জ সীমান্তে পাথরের স্বর্গ রাজ্যে আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকব বলে মনস্থির করে এসেছি। পাহাড়ি স্রোতে আজ ভাসব। পাথর, পানি, আর পাহাড়ের সান্নিধ্য অনেক দিন ধরেই হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। আজ সেই সুযোগ হতে যাচ্ছে।
যাত্রাপথে পল্লব ও ছানোয়ার ভাই জানতে চাইলেন এটা সাদাপাথর কেন আর কবেই বা আবিষ্কারের হলো। এখানে এর আগে আমি বেশ কয়েকবার আসায় ইতিহাসটাও জানার চেষ্টা করেছি সে সময়গুলোয়। ভ্রমণ এমনই, একই জায়গায় বারবার গেলেও প্রকৃতির আয়োজন ভিন্নভাবে ধরা দেবেই।
আমি জানালাম আবিষ্কারের গল্প
পাহাড়-পাথর-পানির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সারা বছরই পর্যটকমুখর থাকে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র। যাতায়াতের সুব্যবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি দেশে ও বিদেশে জনপ্রিয় সিলেটের এ প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রটি ২০১৭ সালে আবিষ্কার হয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ধলাই নদের উৎসমুখে ২০১৭ সালের পাহাড়ি ঢলের পর পাথর জমা হয়। সে পাহাড়ি ঢলের পর পাথর সংরক্ষেণের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক পর্যটন প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনায় কোম্পানীগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবুল লাইছ ও পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন পাথরগুলো সংরক্ষণের মধ্যে রাখেন। এরপর তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার স্থানটি সরেজমিন পরিদর্শন করে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে সাদাপাথর এলাকা।
লেখক-সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী সাদাপাথরকে ‘ধলাসোনা’ আখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমে প্রথম প্রতিবেদন করেছিলেন। সেটা পড়েছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি থেকে ধলাই নদে সারা বছর পানি প্রবাহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এসব পাথর উত্তোলিত পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপত্যকাজে। দেখতে ধূসর ও সাদা হওয়ায় স্থানটির নাম পড়ে ‘সাদাপাথর’। গল্পের কোনো শেষ নেই। ইতিহাস পাঠও এক ধরনের গল্প। ইতোমধ্যে গন্তব্যেও পৌঁছে যাই আমরা। আম্বরখানা পয়েন্ট ধরে হিসাব করলে আমাদের ৪০ মিনিট লেগেছে। আমরা রিজার্ভ গাড়ি নিয়েছিলাম নিজেদের মতো করে যাতে যেতে পারি। এ ভর দুপুর স্বাভাবিকভাবে কিছুটা তৃষ্ণার্ত আমরা। ১০০ টাকা করে ডাব বিক্রি করছে এক দোকানি। আমরা তিনজন ৩টা নিলাম।
ধলাই ঘাটে নৌকার টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। অদের ফিক্সড করা ৮০০। একজন হোক আর ১০ জন হোক। আমাদের তিনজনকে দেখে আরেকটা পরিবার যুক্ত হতে চাইল। তারা ঢাকা থেকে এসেছে। আমাদের নৌকার পুরো ভাড়া দিতে হলো না।
ধলাই নদীর স্বচ্ছ পানি। পথ ২০ মিনিটের। একের পর এক ইঞ্জিলচালিত নৌকা যাচ্ছে। আবার ফিরছে। পাহাড়, পানি। অদূরে পাথুরের বুক দেখা যাচ্ছে। নৌকা নির্দিষ্ট ঘাটে ভিড়ল। ঘণ্টা দুই-তিন পর আমাদের নিয়ে যাবে আবার।
সাদাপাথর নদী বলি আর ঝরনা বলি হেঁটে যেতে ৫ মিনিটের পথ
যখন হাঁটছিলাম স্থানীয় একজন বললেন, অনেক পাথর চুরি হয়ে গেছে। না হলে পাথরের ওপর দিয়েই আরও এক মাইল হেঁটে যেতেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আমরাই আবার ধ্বংস করে দিচ্ছি। আবার আমরাই পর্যটন সম্ভাবনার কথাই বলছি। ঠিকমতো সব ব্যবস্থাপনা রাখলে পর্যটন খাত এ দেশের সম্ভাবনাময় শিল্প হতে পারত। ৫ মিনিট পোড়া বালুর ওপর হাঁটতে গিয়ে এমনই ভাবছিলাম। একটু পর সতর্ক হলাম। এখন হাঁটছি পাথরের ওপর দিয়ে। ছোট বড় পাথর। প্লাস্টিকের সেন্ডেল তিনজনে তিন জোড়া কিনে নিয়েছিলাম। মাঠে অনেক অস্থায়ী দোকান। আর লকার আছে। ১০০ টাকায় লকার ভাড়া নিয়েছিলাম। প্রয়োজনীয় জিনিস আপনি লকারে রাখতে পারবেন।
আমাদের পা অবশেষে শীতল পানির দেখা পেল। বেশ ঠান্ডা পানি। পাথুরে নদীতে স্রোত আছে বেশ। একদম আয়নার মতো স্বচ্ছ জলধারা। পানির শব্দটাকে এত মধুর ও প্রশান্তিময় লাগল। স্বচ্ছ নীলচে পানিতে আমরা গা এলিয়ে দিলাম। নানা বয়সের পর্যটকদের ভিড় এড়াতে আমরা একটু সীমান্তঘেঁষা হওয়ার চেষ্টা করি। আজ এত বেশি পর্যটকের ঢল নেমেছে মনে হচ্ছে একটা উৎসব লেগেছে।
জলে স্রোতের তীব্রতা বেশ। এত ঠান্ডা পরিষ্কার পানি। দুই তিন হাত পানির নিচের পাথরগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কখনো পানিকে নীলের মতো কখনো সবুজের ছায়ার মতো দেখা দেয়। সবই প্রকৃতির রূপ বদল।
সোজা তাকালে সবুজ পাহাড়। মেঘালয় রাজ্যের উঁচু নিচু পাহাড়ের বুক চিরে পানির ধারা নেমে আসছে। একমনে শুধু তাকিয়েই থাকা যায়। পাহাড়ঘেঁষে সাদা মেঘ তুলার মতো ভেসে যাচ্ছে। কোনো ক্লান্তি নেই। আমি একটু এগুলাম। হাজার পর্যটকদের কোলাহল থেকে একটু দূরে নীরবতা নেব বলে। তবে সীমানা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। একটুপরই আকাশ কালো। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল।
একটু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বিষণ্ন সুন্দর আরেক রূপ ধরা দিল। আগের মতো এ মুহূর্তে সবকিছু নীলাভ নয়। তাতেও সুন্দরের কমতি নয়। আষাঢ়ে যেমন চিত্র হয় তেমন।
পাথুরে নদীতে মন চাইছে আরও থাকি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় ৫টা।
মেঘও সরে গেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পল্লব ডাকে। ভাই উঠে আসেন।
আমরা উঠে এসে পোশাক চেঞ্জ করি। ততক্ষণে ক্ষুধাও বেশ লেগেছে। অনেক অস্থায়ী দোকান যেমন খাবারের রেস্টুরেন্টও আছে। সন্ধ্যা হলেও একদম গরম খাবার। সাদা ভাত হাসের মাংস আর সবজি ভাজিতে পেট উদরপূর্তি করি।
এবার ফেরার পালা। এত সুন্দর মায়াময় প্রশান্তিময় ডে ট্রিপ। হয়তো সিলেট শহর থেকে একেবারে কাছে বলেই বারবার আসা যায়। পাহাড়, পানি, পাথর আর ভেসে যাওয়া মেঘের ভেলা। আকাশের ভিন্ন রঙের সাজ। আসলেই অনন্য এক রূপের রানি ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। সারা দিনে কোনো ক্লান্তি ভর করেনি। ভূতুড়ে সন্ধ্যা। দিনের সেই কোলাহল হই-হুল্লোড় নেই। আর কোনো ট্যুরিস্ট নেই। রাতে থাকতে পারলে দারুণ হতো। কিন্তু সেই ব্যবস্থা সেখানে নেই।
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যে কোনো জেলা থেকে গাড়িতে আপনাকে কদমতলী স্ট্যান্ডে আসতে হবে। ট্রেনে এলেও সেইম। এয়ারে এলে এয়ারপোর্ট রোড।
সিলেট নগরীর আম্বরখানা স্ট্যান্ড থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে সিলেট কোম্পানীগঞ্জ রুটে। ১২০ টাকা জনপ্রতি ভাড়ায় কোম্পানীগঞ্জের টুকের বাজারে নামাবে। ট্রলার ঘাট থেকেই ট্রলারে চলে যেতে পারেন সাদাপাথর। কোম্পানীগঞ্জ পৌঁছে টুকের বাজার ঘাট থেকে ট্রলারে সাদাপাথর পৌঁছাতে ২০-২৫ মিনিটের মতো সময় লাগবে। যাওয়া-আসায় নৌকা ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। এখানে নৌকা রিজার্ভ করে নিতে হয়। সিলেট থেকে। তবে এখানকার মূল সৌন্দর্য কেবল বর্ষাকালে মিলবে। তবে শরতেও কমতি নেই। শীতকালে নদীর পানি প্রবাহ কমে যায় বলে নৌকায় চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন সাদাপাথর এলাকায় যেতে হবে নদীর বুক দিয়ে হেঁটে।
আর খাবারের জন্য আশপাশেই অনেক হোটেল পাবেন।
যেহেতু শহরের একদম কাছে। সবাই শহরে এসে হোটেলেই থাকে।