Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

রূপসি বাংলার রূপের খোঁজে

Icon

গাজী মুনছুর আজিজ

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া-সত্যি তাই। ছোট্ট এ ছয় ঋতুর দেশের চারপাশেই আছে মুগ্ধ হওয়ার মতো নানা দর্শনীয় স্থান। আমাদের আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ বন ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। আছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৈকতপার কুয়াকাটা, বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ইতিহাস-ঐতিহ্য খ্যাত দর্শনীয় স্থান। পাশাপাশি আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্যের ভান্ডারে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘পর্যটন ও শান্তি’। আসুন জেনে নেই এ দেশের উল্লেখযোগ্য কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

ভ্রমণে বের হওয়ার আগে

সামনেই আসছে পর্যটন মৌসুম। আর তাই চাইলে এ মৌসুমে ভ্রমণ করে দেখে নিতে পারেন বাংলার রূপ-বৈচিত্র্য। তবে ভ্রমণে বের হলে সবার আগে ভাবতে হবে, হাতে সময় আর বাজেট কত? কারণ, সময় কম থাকলে আশপাশে বা দিনে গিয়ে ঘুরে আসা যায় এমন স্থানে ভ্রমণ করা ভালো। হাতে সময় থাকলে যেতে পারেন দূরে কোথাও। তবে ভ্রমণে বের হলে দলবেঁধে যাওয়া ভালো। এতে খরচ কম হয়। অন্যদিকে একা একা ভ্রমণের মজাও আলাদা। আর পারিবারিক ভ্রমণ তো অন্যরকম মজার।

ভ্রমণে বের হলে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-যেখানে আগে যাওয়া হয়নি সেই জায়গাটিকে প্রাধান্য দেওয়া। তবে যেখানেই যান, আগে সেখানকার থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত ব্যবস্থার সব ধরনের তথ্য জেনেই বের হওয়া উচিত। খুব ভালো হয়, যেখানে যাচ্ছেন সেখানে পরিচিত জনদের আগে কেউ গিয়েছেন এমন কাউকে সঙ্গে নেওয়া। অথবা সেখানকার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে সেখানকার তথ্য জেনে নেওয়া। এছাড়া ভ্রমণ তথ্য নিয়ে বাজারে অনেক বই আছে। চাইলে সেসব বই দেখেও জানতে পারেন। আর এখন তো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ইন্টারনেটে ভ্রমণের নানা তথ্য ও ছবি আছে। সেখান থেকেও তথ্য জেনে নিতে পারেন।

কোথায় ভ্রমণ করবেন

একেক জনের একেক রকম পছন্দ। কেউ দেখতে চান সমুদ্র, কেউ পাহাড়। আবার কেউ খোঁজেন পুরাকীর্তি। আবার কেউ ঘুরতে চান বন-বাদাড়। ফলে একেক জনের গন্তব্য একেক জায়গা।

সমুদ্র ভ্রমণ : যারা সমুদ্র দেখতে পছন্দ করেন, তাদের সবার আগে যাওয়া উচিত কক্সবাজার। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত। বিশাল এ সৈকতের পাশে দাঁড়ালে আপনার মনটাও বিশাল হয়ে যাবে; এমনটা বললে ভুল হবে না। আর সৈকতের পাশের মেরিন ড্রাইভটিও পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ। এ ড্রাইভ দিয়ে সমুদ্রের পাড় ধরে যাওয়া যাবে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত। কক্সবাজারে আরও আছে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান ও সৈকত, ইনানী সৈকত, রামু বৌদ্ধবিহার, সাফারিপার্কসহ নানা দর্শনীয় স্থান।

কক্সবাজারের বিশেষ আকর্ষণ সেন্টমার্টিন দ্বীপ। টেকনাফ থেকে জাহাজে যাওয়া যাবে প্রবাল এ দ্বীপে। দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। দ্বীপের আরেক দর্শনীয় স্থান ছেড়াদ্বীপ। কক্সবাজার ছাড়া সমুদ্র দেখতে যেতে পারেন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেশ কুয়াকাটা। এটিও দারুণ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকতও দেখতে পারেন। ঢাকা থেকে রাতের বাসে কক্সবাজার গিয়ে সারা দিন থেকে আবার রাতে ফেরা যাবে ঢাকার উদ্দেশে। তবে সেন্টমার্টিন গেলে আরও একদিন সময় লাগবে। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে দিনে গিয়ে দিনেই ফেরা যাবে। থাকতেও পারেন। কুয়াকাটা যেতে হলে প্রথমে লঞ্চে বা বাসে পটুয়াখালী। তারপর সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা। সরাসরি বাসও যায়।

পাহাড় : সমুদ্র দেখা হলে যেতে পারেন পাহাড়ে। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি সত্যিই সৌন্দর্যের আধার। পাহাড়, অরণ্য আর আদিবাসীদের বর্ণিল সাজে সজ্জিত এ জনপদ। চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি মনও জুড়াবে। পাহাড়ি এ অঞ্চলে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সকালে পৌঁছে সারাদিন ঘুরে আবার রাতে ফেরা যাবে ঢাকার উদ্দেশে। থাকতে চাইলে হোটেল-রিসোর্ট সবই আছে।

বন-বাদাড় : সমুদ্র কিংবা পাহাড় দেখা হলে যেতে পারেন বন-বাদাড়ে। আর বন দেখতে হলে প্রথমে আসতে পারেন সুন্দরবনে। এটি বিশ্বের একক বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। ঢাকা থেকে প্রথমে খুলনা, তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন ভ্রমণ পরিচালনাকারী সংস্থার মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারেন সুন্দরবনে। এছাড়া একা দিনে দিনে সুন্দরবনের স্বাদ পেতে যেতে পারেন করমজল। মোংলাঘাট থেকে ট্রলারে করমজল যেতে সময় লাগবে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। এছাড়া বিভিন্ন ভ্রমণ পরিচালনাকারী সংস্থার মাধ্যমে ঢাকা থেকে সরাসরিও আপনি সুন্দরবনের উদ্দেশে আসতে পারেন। অনেকেই ভাবেন, দেশের যে কোনো স্থানেই একা একা যাওয়া গেলে সুন্দরবন কেন যাওয়া যাবে না? আসলে সুন্দরবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে হলে আপনাকে কমপক্ষে তিন-চার দিন সময় নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে হবে। আর সুন্দরবনে কখনো একা প্রবেশ করা যায় না। তাই সুন্দরবনের মূল অংশে আপনাকে যেতে হলে ভ্রমণ পরিচালনাকারীদের সাহায্য নিতেই হবে। অথবা নিজেদের ভাড়া করা লঞ্চ বা বড় ট্রলারে যেতে হবে। এছাড়া লঞ্চ ছাড়া বন বিভাগ আপনাকে সুন্দরবনে একা প্রবেশের অনুমতিও দেবে না।

চা-বাগান : বন, সমুদ্র বা পাহাড় দেখা হয়ে গেলে আসতে পারেন সবুজ চা-বাগান দেখতে। সিলেট বিভাগজুড়ে রয়েছে অসংখ্য চা-বাগান। তবে সবচেয়ে বড় ও বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। রাতের ট্রেনে বা বাসে রওনা হয়ে সকালে নেমে সারাদিন চা-বাগান দেখে আবার রাতে ফেরা যাবে ঢাকায়। চাইলে শ্রীমঙ্গলে দিনে দিনে গিয়েও দেখে আসা যাবে।

হাওর : বাংলাদেশের বৃহৎ হাওরগুলো রয়েছে-সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ সিলেট অঞ্চলজুড়ে। হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, পাশুয়া, বাইক্কাসহ বিভিন্ন হাওর দেখতে আসতে পারেন এ অঞ্চলে। শীত মৌসুমে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির কলতানে হাওর হয়ে ওঠে অন্যরকম সৌন্দর্যের ভূমি। বর্ষায় হাওরের আরেক সৌন্দর্য। ঢাকা থেকে রাতে বাসে বা ট্রেনে রওনা হয়ে সারাদিন হাওর ঘুরে আবার রাতের গাড়িতে সকালে ঢাকা ফিরে আসা যাবে। সিলেট অঞ্চল কেবল চা-বাগান আর হাওর নয়, এ অঞ্চলজুড়েও রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য অরণ্য ও ঝরনা। এর মধ্যে মাধবকুণ্ড ঝরনা অন্যতম। এর পাশেই আছে পরিকুণ্ড ঝরনা। আরও আছে গহিন বনের হামহাম ঝরনা। দুটো ঝরনাই মৌলভীবাজারে। এছাড়া সিলেট অঞ্চলের পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরও দারুণ।

পুরাকীর্তি : ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা বা পুরাকীর্তি দেখার মজাও আলাদা। এটা দেখার মাধ্যমে ফিরে যাওয়া যায় অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির অজানা সব অধ্যায়ে। আর পুরাকীর্তি দেখার জন্য আসতে পারেন খুলনার ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদ, দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির, কুমিল্লার ময়নামতি, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড়, ফরিদপুরের মথুরা দেউর, রাজশাহীর সোনামসজিদ, তোহাখানা, পুঠিয়া রাজবাড়ি, নাটোরের রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি, গণভবনসহ নানা স্থানে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন।

আরও অনেক : হরিণের রাজ্য দেখতে আসতে পারেন নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ, পাখির রাজ্য দেখতে মৌলভীবাজারের বাইক্কাবিল, হাকালুকি হাওর, টাঙুয়া হাওর, ভোলা-নোয়াখালীর উপকূলের বিভিন্ন চরে যেতে পারেন। এসবের পাশাপাশি চাইলে সময় করে নিজের জেলাটাই ঘুরে দেখতে পারেন। কারণ, আমাদের প্রতিটি জেলারই রয়েছে নানারকম ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান।

বাংলার ছোট ছোট দ্বীপ

দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক দ্বীপ আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এসব দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারেন চলতি পর্যটন মৌসুমে।

হরিণের দেশ নিঝুম দ্বীপ : নোয়াখালীর হাতিয়ার সাবেক জাহাজমারা ইউনিয়ন এবং বর্তমানের ১১নং ইউনিয়ন নিয়ে নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের চারপাশেই মেঘনা নদী। পাশেই বঙ্গোপসাগর। দ্বীপের আয়তন ১৬ হাজার ৩৫২ হেক্টর। বিশাল ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে গড়ে ওঠা নিঝুম দ্বীপের প্রধান গাছ কেওড়া, গেওয়া ও বাইন। এ বনে প্রায় ২০ হাজার হরিণ আছে। বানরও আছে বেশ কিছু। বনের গাছে গাছে অনেক মৌচাকও দেখা যায়। আরও আছে বিভিন্ন প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির বসবাস। শীতের সময় এ দ্বীপের চারপাশে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। যা দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ।

২০০১ সালে নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৭ সালে সরকারি জরিপ অনুযায়ী নিঝুপ দ্বীপে ৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির পাখি, ১৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১ প্রজাতির গাছ ও ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম রয়েছে। এছাড়া গবেষকদের মতে, নিঝুম দ্বীপে খনিজসম্পদও রয়েছে। এখানকার সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দুটোই দারুণ।

সোনাদিয়া দ্বীপ : সোনাদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। অল্পসংখ্যক মানুষের বাস এখানে। তবে এখানকার অন্যতম আকর্ষণ নানা প্রজাতির পরিযায়ী সৈকত পাখি। এর মধ্যে অন্যতম চামচঠুঁটো বাটান; যা পৃথিবীতে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত।

দমারচর : দমারচর নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণে জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেল নামক মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা একটি চর। অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি দেখা গেলেও এখানকার অন্যতম বাসিন্দা দেশি-গাঙচষা।

চর শাহজালাল : ভোলার চরফ্যাশনের মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরের বয়স প্রায় ২০ বছর। এখানেও মানুষের বসতি নেই। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এ চরে একসঙ্গে প্রায় ৫০ প্রজাতিরও বেশি হাজার হাজার পাখি দেখা যায়। উপকূলের অন্য কাদাচরে একসঙ্গে এত বেশি পাখি খুব কমই দেখা যায়। এর মধ্যে অনেক দুর্লভ, বিপন্ন পাখিও রয়েছে।

মনপুরা ও চর কুকড়িমুকড়ি : মনপুরা দ্বীপের অবস্থান ভোলায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ দ্বীপটিও মেঘনার মোহনায় ও বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা। এখানকার বনাঞ্চলেও হরিণসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি, আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি রয়েছে। এ দ্বীপের পাশেই রয়েছে চর কুকড়িমুকড়ি দ্বীপ। এ দ্বীপেও আছে হরিণ, পাখিসহ নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য।

পাখি পর্যটন

শীত মৌসুম মানেই বাংলাদেশে নতুন পাখির আনাগোনা। দেশের নানা এলাকায় নানা পাখির দেখা মেলে। কোন এলাকায় কোন ধরনের পাখি দেখা যাবে, আসুন সেটাই জানি।

উপকূলীয় অঞ্চলের কাদাচর, সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল, হাইল হাওর বা হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন বিল, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া সৈকত এলাকা, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন কিংবা রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মার চর এলাকায় নানা ধরনের নতুন পাখি দেখা যায়। এ পাখিগুলো মোটেই অতিথি নয়, এরা আমাদের দেশেরই পাখি। যেহেতু পাখিগুলো পর্যটকের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাই এদের পরিযায়ী বলা হয়।

সাধারণত, চারপাশের গাছগাছালি, বন-বাদাড়ে, নদী-খালে, হাওর-বিলে অনেক পাখি দেখা গেলেও নির্দিষ্ট কিছু পাখির বসত ও খাবার নির্দিষ্ট স্থানেই হয়ে থাকে। তাই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়েই নির্দিষ্ট পাখি দেখতে হয়। বাংলাদেশেও একেক প্রজাতির পাখির বসত একেক স্থানে।

বাংলাদেশে আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে পাখির সংখ্যা প্রায় ৬৯০ প্রজাতির। এর মধ্যে আবাসিক ৩৩০ প্রজাতির। পরিযায়ী ৩৬০ প্রজাতির। এ ছাড়া অপ্রতুল তথ্যের ভিত্তিতে আরও ৩০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিযায়ী জলচর পাখিদের বিচরণ উপকূলের ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, রাজশাহী, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সুন্দরবন ও হাওরাঞ্চলের চর, বিল বা জলাভূমিতে।

সাম্প্রতিক সময়ে এক জরিপ অনুযায়ী শীত মৌসুমে বাংলাদেশের উপকূলের চর বা বিলে যেসব জলচর পরিযায়ী পাখি বেশি দেখা যায় তার মধ্যে আছে- দেশি কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, খয়রা চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পাতি শরালি, উত্তুরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুঁটি, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, ছোট পানচিল, ছোট পানকৌড়ি, জুলফি পানচিল, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিল, চামচঠুঁটো বাটান, খুন্তেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

উপকূলের চরের মধ্যে আছে হাতিয়ার দমার চর, নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারার চর, মোক্তারিয়ার চর, গাজীপুরা চর, মদনপুরা চর, মধুপুরা চর, দাশের হাটের চর, মনপুরার চর, তুলাতুলী চর, মাঝের চর, বালুর চর, বগার চর, হাজীপুর চর, রগকাটার চর, লতার চর, যাদবপুর চর, উড়ির চর, শাহজালাল চর, আমানত চর, ঢালচর, ঠেংগার চর, কালাকাইচ্ছা চর, পিয়াল চর, পাতাইলা চর, ছোট বাংলার চর, চর মোন্তাজ, কালাম চর, খাজুর গাইচ্ছা চর, সামছু মোল্লার চর, বোয়ালখালীর চর, বড় রানীর চর, ছোট রানীর চর, টেগরার চরসহ আরও অনেক নতুন নতুন জেগে ওঠা নাম না জানা ছোট-বড় চর।

অবশ্য সব চরে সব জলচর পরিযায়ী পাখি বিচরণ করে না। মূলত দেশে শীত মৌসুমে উপকূলের কাদাচর, হাওরের বিল বা জলাভূমি, পদ্মার চর বা সুন্দরবনের চরগুলোয় অল্প পানি থাকে। এ অল্প পানিতেই থাকে পরিযায়ী পাখিদের খাবার। আর খাওয়া শেষ হলে চর বা বিলের আশপাশের ঘাসের মাঠ, বালুর মাঠ, বনভূমি বা বন-বাদাড়ের নিরাপদ স্থানে এসব পাখি থাকে। এরপর গ্রীষ্ম মৌসুমে বর্ষার পানি বাড়তে থাকলে এসব চর ও বিল পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে পরিযায়ী পাখিরা তাদের খাবার আর খুঁজে পায় না, থাকার জায়গাও হারায়, তাই তারা খাবারের খোঁজে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায় অন্য দেশে।

কিছু পাখি অতি কাদাচরে থাকে। আবার কিছু পাখি একটু শক্ত কাদাচরে থাকতে চায়। জলচর হলেও এর মধ্যে আবার কিছু পাখিকে সৈকত পাখি বলা হয়। কারণ তারা সৈকতের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। উপকূলের চরগুলোয় বিচরণ করা পাখির মধ্যে রয়েছে-নোয়াখালীর হাতিয়ার দমার চরে বিশ্বের মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখি দেখা যায় মাঝে মধ্যে দুয়েকটি। দুর্লভ কালামাথা কাস্তেচরা পাখির অন্যতম বিচরণ ভূমিও এ চর। বিরল ইউরেশীয় চামচঠুঁটো পাখিও দেখা যায় এখানে।

এ ছাড়া এ চরে একই সঙ্গে অনেক প্রজাতির হাজারও পাখি দেখা যায়। যার মধ্যে অনেক দুর্লভ, বিরল, বিপন্ন প্রজাতির পাখিও আছে। হাতিয়ার জাহাজমারা মোক্তারিয়া চ্যানেলে এবং এর আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায় বিপন্ন দেশি গাঙচষা পাখি।

উপকূলে জলচর পাখিদের বড় একটি বিচরণভূমি হলো ভোলার চরফ্যাশন থানার মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর শাহজালাল। এ চরের বয়স ২০-২২ বছরের বেশি। শীত মৌসুমে এ চরে একসঙ্গে প্রায় ৫০ প্রজাতির হাজারও পাখি দেখা যায়।

পরিযায়ী জলচর সৈকত পাখির আরেকটি বড় অংশ দেখা যায় কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপসহ আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপে। এ দ্বীপেও প্রায় ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখিও আছে। এ পাখির জন্য দ্বীপটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। পাখি গবেষকদের মতে পৃথিবীতে চামচঠুঁটো বাটান পাখি আছে প্রায় ২০০। এর মধ্যে সোনাদিয়ার সৈকত এলাকায় পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ চামচঠুঁটো বাটান পাখি বসবাস করে। সোনাদিয়াদ্বীপসহ উপকূলের অনেক চরেই এমন অনেক বিপন্ন বা মহাবিপন্ন পাখির বসবাস রয়েছে। এ পাখির তালিকায় আছে-নর্ডম্যান সবুজপা, কালামাথা কাস্তেচরা, এশীয় ডাউইচার, কালালেজ জৌরালি, ইউরেশীয় গুলিন্দা, বড় নট, দেশি গাঙচষা ইত্যাদি।

উপকূল ছাড়া জলচর পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি বৃহৎ বিচরণভূমি সিলেটের হাওরাঞ্চল। বিশেষ করে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, বাইক্কাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ এর আশপাশের বিভিন্ন হাওর শীতের সময় পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়।

শীতের সময় এসব হাওরে যেসব পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে, এর মধ্যে আছে-ছোট ডুবুরি, বড় খোঁপাডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, উদয়ী গয়ার, দেশি কানিবক, ধুপনি বক, লালচে বক, বড় বগা, ছোট বগা, মাঝলা বগা, গো বগা, এশীয় শামখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি শরালি, মেটে রাজহাঁস, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, সিঁথিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, টিকি হাঁস, মরচেরঙ ভুতিহাঁস, কোড়া, ধলাবুক ডাহুক, পাতি মানমুরগি, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, নেউ পিপি, দল পিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, মেটেমাথা টিটি, হট টিটি, উত্তুরে টিটি, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, ছোট নথজিরিয়া, কেন্টিশ জিরিয়া, ছোট ধুলজিরিয়া, ছোট বাবুবাটান, পাতি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, কালালেজ জৌরালি, তিলা লালপা, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, বিল বাটান, বন বাটান, পাতি বাটান, লাল নুড়িবাটান, গুলিন্দা বাটান, ছোট চাপাখি, টেমিকেংর চাপাখি, খয়রামাথা গাঙচিল, কালামাথা গাঙচিলসহ বিভিন্ন পাখি।

হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কাবিলসহ এর আশপাশে যে হাওর রয়েছে তার মধ্যে ছোট-বড় অনেক বিল আছে। হাকালুকি হাওরের বিলগুলোর মধ্যে আছে-জলা বিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওরখাল, কোয়ার কোনা, মালাম বিল, গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম, বিড়াল খালসহ বিভিন্ন বিল। উপকূল ও হাওর অঞ্চল ছাড়াও সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে প্রায় ৩১৫ প্রজাতির পাখির বসবাস রয়েছে। রাজশাহীর পদ্মার চরাঞ্চলেও অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বসতি রয়েছে।

পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবনকে ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করা হয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়ার দমারচর, ভোলার চর শাহজালাল, কক্সবাজারের সোনাদিয়া, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিলসহ বেশ কিছু স্থানও পাখির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম