কোটা সংস্কার আন্দোলন
ঢাকায় ভাইকে আনতে গিয়ে গুলিতে নিহত ডা. সজিব
উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার

রায়পুরা (নরসিংদী) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মাদ্রাসা পড়ুয়া ভাইকে আনতে গিয়ে ১৮ জুলাই ঢাকার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নরসিংদীর রায়পুরার বাসিন্দা চিকিৎসক সজিব সরকার। ওইদিন রাতেই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন তার লাশ নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঘটনার সপ্তাহ পেরোলেও থামেনি স্বজনদের শোক-আহাজারি। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজিবের মৃত্যুতে এখন অথৈ সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার। নিহত সজিব রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো. হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের লেকচারার ছিলেন। বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিতেন। তিনি তিন ভাই এক বোনের মাঝে সবার বড় ছিলেন। নরসিংদীর ভাড়া বাসায় রোববার গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে মা ঝর্ণা বেগম এখন পাগলপ্রায়, অসুস্থ হয়ে অক্সিজেন নিচ্ছেন। ছেলের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করে মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলছেন, সজিব সবসময় আমাকে ছোট্ট সন্তানের মতো আগলে রাখত। আমিসহ সবার খরচ জোগাত। ১৮ জুলাই ১১টায় বাসা থেকে ছোট ছেলেকে আনতে বের হয়। বেলা সাড়ে ৪ থেকে ৫টার মধ্যে আজমপুর পৌঁছে ফোনে কথা হয়। রাত ১টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসেছিলাম। আমাদের যা ছিল সব ছেলেকে চিকিৎসক বানাতে ব্যয় হয়েছে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আমার ছেলে হত্যার বিচার কিভাবে পাব সেটাই চাইব। সবাই যাতে জানে সজিব ডাক্তার নির্দোষ। সজিব যেন আজীবন সবার মাঝে বেঁচে থাকে এমন কিছু একটা নামকরণ করা হোক।
সজিবের বোন সুমাইয়া সরকার স্বর্ণা বলেন, ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরার রাজলক্ষ্মীর একটি কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে বের হন সজিব। তুমুল আন্দোলনের সময় আজিমপুরে গিয়ে বাস থামে। বিকাল ৫-৬ মধ্যে আজমপুর বাস থেকে নেমে রাজলক্ষ্মী মাদ্রাসায় যাওয়ার উদ্দেশে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকেন। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। সন্ধ্যা ৭টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে ভাই নিখোঁজের খবর পাই। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। জানতে পারি আজমপুরের রাস্তায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
সজিবের ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদ্রাসায় এলে সর্বশেষ দেখা হয়। আর বলে যান ১৮ তারিখ মাদ্রাসা ছুটি হলে আমাকে নিতে আসবেন। দীর্ঘ বছর মাদ্রাসা থেকে বাড়ি আসার যাওয়ায় একা বের হতাম না। ভাই আনা নেওয়া করতেন। ওইদিন বিকালে তিনবার ভাইকে ফোন করে না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে ভাইয়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকি। রাত ৯টায় পরিচিতজন মাদ্রাসায় এসে বলল, তোমার ভাই হাসপাতালে অসুস্থ। এসে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। ভাইয়ের লাশ রাতেই উত্তরার একটি মসজিদে গোসল করাতে গিয়ে কাপড় সরাতেই দেখি ভাইয়ের বুকের সামনে অংশে গুলির বড় গর্ত হয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। দুই পাশ দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। সজিবের বাবা মো. হালিম সরকার বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। ২০২০ সালে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাশ করে। যা সহায় সম্বল ছিল সব ছেলেকে ডাক্তার বানাতে ব্যয় করেছি। আমি আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ছেলে খুব ধার্মিক ছিল। ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না, রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলে হত্যার বিচারটা করে, তা হলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাব।’