Logo
Logo
×

খবর

আদালতের স্থগিতাদেশ ও সাক্ষীর অনুপস্থিতি

১০ বছরেও শেষ হয়নি রানা প্লাজা ধসের বিচার

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসে সহস াধিক প্রাণহানির ঘটনায় দায়ীদের বিচার কাজ শেষ হয়নি ১০ বছরেও। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে নয়তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়ে। এতে এক হাজার ১৩৬ জনের মারা যাওয়ার ঘটনায় ‘অবহেলা ও ত্র“টিজনিত’ অপরাধের অভিযোগ এনে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্নজনের নামে মোট পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক তিনটি মামলা করে। এত প্রাণহানির পেছনে যাদের দায়, তাদের বিচার শেষ হয়নি গত এক দশকেও। ফলে বিচারপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষত। অনেক শ্রমিক চিকিৎসার অভাবে স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কর্মক্ষমতা হারিয়ে পঙ্গু জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। আহত শ্রমিকদের খোঁজ নেন না মালিকপক্ষের কেউ, এমনকি শ্রমিক সংগঠনগুলোও।

এদিকে রানা প্লাজা ধসে পড়ার বার্ষিকীতে সোমবার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রোববার সন্ধ্যায় ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে মোমবাতি প্রজ্বালন শেষে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ দাবি জানান।

ইতোমধ্যে হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর বাদী ও অন্যদের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হলেও ইমরাত নির্মাণ আইনের মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় আটকে আছে বিচারকাজ। এদিকে বিচারে কিছুটা গতি এলেও মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে আপিল বিভাগে সেই জামিন স্থগিত থাকায় এখনো তিনি মুক্তি পাননি।

ধসে পড়া নয়তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজা ভবনটির তৃতীয়তলা থেকে নবমতলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। এতে প্রায় চার হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ করতেন। ভবন ধসে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে চাপা পড়েন ভাগ্যাহত এই শ্রমিকরা। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। যাদের বেশির ভাগই পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ভয়াবহতম এই ট্রাজেডিতে এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়।

ভবন ধসের ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলা ও ত্র“টিজনিত হত্যা’র অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। পরে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা গেছেন। অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল­াহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। তাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতসহ রুল ইস্যু করা হয়।

উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। পরে মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এই মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এএইচএম হাবিবুর রহমান ভ‚ঁইয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত এক বছরে মামলাটিতে ৪৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় ছয় বছর উচ্চ আদালতের আদেশে এই মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছিল। প্রতি মাসেই তারিখ হচ্ছে। আমরা ১০-১৫ জন সাক্ষীর প্রতি আদালত থেকে সমন ইস্যু করছি। অনেক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার সময় তাদের যে বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল তারা এখন সেই ঠিকানায় নেই। অনেকে অসুস্থ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে আদালতে আসতে পারছেন না। তবুও প্রতি তারিখে অন্তত ৫-৭ জন সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সাক্ষী এলে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এই মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ৫৯৪ জন। স্বাভাবিকভাবে বিচার শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি শেষ করার বিষয়ে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আমরা দ্রুত শেষ করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আসামি সোহেল রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় সাত বছর আগে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে যান। এদের মধ্যে সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল­াহর পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতাদেশ থাকায় ইমরাত নির্মাণ আইনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হচ্ছে না।

এদিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন রানা প্লাজার ভবন মালিক সোহেল রানা। যদিও গত ৯ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী সেই জামিনের আদেশ স্থগিত করে দেন। আগামী ৮ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। অন্যদিকে, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল­াহর পক্ষে উচ্চ আদালত মামলাটির ওপর এক বছরের স্থগিতাদেশ দেন। তাই দীর্ঘদিনেও মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি বলে জানান ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল।

তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় চার্জ গঠনের সাত বছরেও মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি। এই মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দাখিলের জন্য সোমবার (২৪ এপ্রিল) দিন ধার্য রয়েছে।

এখনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন শ্রমিকরা : সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য মতে, রানা প্লাজা ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ এখনো কর্মহীন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের শারীরিক অবস্থা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় বাধা। এতদিনেও বেঁচে যাওয়াদের শারীরিক অবস্থার উলে­খযোগ্য উন্নতি দেখা যায়নি।

একই দাবি করছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। এক দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে সোমবার রানা প্লাজার সামনের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শ্রমিক সংগঠনগুলো ও আহত শ্রমিকরা। সংগঠনগুলোর মধ্যে উপস্থিত ছিল গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। এ সময় চার দফা দাবি জানান বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। দাবিগুলো হলো-শ্রমিকের এক জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, স্থায়ী পুনর্বাসন, বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসা ও রানা প্লাজার মালিকের দ্রুত বিচার।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন বলেন, রানা প্লাজার ঘটনা পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। সারা দুনিয়ার কারখানার ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা। এই দুঃসহ স্মৃতি আমরা কখনো ভুলতে পারব না। অবিলম্বে রানা প্লাজার দোষীদের শাস্তি এবং শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে আইন বদল করতে হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম