সরকারি হাসপাতালের সংস্কার চাই

আহাম্মদ উল্লাহ
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রবাদ আছে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। যে দেশের জনগণ চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির দিক থেকে যত এগিয়ে, সেই দেশ তত সমৃদ্ধ। একটি রাষ্ট্রের কাছে জনগণের যে চাহিদাগুলো থাকে, তার অন্যতম হলো স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ এবং বছরে ২৪ কোটি মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা নিতে আসে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বারবার আসে তা হলো, এসব হাসপাতাল সেবা প্রদানে কতটুকু কার্যকর? স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এ খাতে আশানুরূপ সংস্কার দেখা যায়নি। সরকারি হাসপাতালগুলোর স্তরে স্তরে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার চিত্র ভেসে আসে। ওষুধ সংকট সরকারি হাসপাতালের একটি প্রাথমিক চিত্র। বিবিএসের তথ্যমতে, দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে প্রয়োজনের মাত্র ১.৬২ শতাংশ ওষুধ পায় রোগীরা এবং ৯৬.৪৬ শতাংশ ওষুধই কিনতে হয় বাইরের দোকান থেকে। এতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে যেখানে নিম্নআয়ের মানুষ অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে, সেখানে ওষুধের পেছনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। ওষুধ সংকটের পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে সচল ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এক্স-রে, এমআরআই, ইসিজি যন্ত্র, আলট্রাসনোগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রগুলো বিকল, নেই আইসিইউ। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া যন্ত্রপাতির হিসাবে দেখা যায়-সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং জেলা পর্যায়সহ মোট ৮৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৩১টি যন্ত্র অচল অবস্থায় পড়ে আছে এবং ৯৩৩টি যন্ত্র নষ্ট হয়ে আছে, যেগুলো আর মেরামত করা যাবে না। ফলে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে না পেরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হন রোগীরা। রাজধানীসহ প্রতিটি জেলা শহরের এটি এক সাধারণ দৃশ্য। চড়া মুনাফার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এছাড়াও ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস, ল্যাব-টেকনিশিয়ানসহ নানা পদে সংকটের কারণে আগত রোগীর দুর্ভোগ বাড়ছে। কেউ সেবা পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। ডিউটি টাইমে ডাক্তারের অনুপস্থিতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, রোগীর দেখভালে নার্সদের অবহেলা, ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে নার্সের কাজ চালিয়ে নেওয়া, নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ নানা অভিযোগে ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের ভরসার কেন্দ্র সরকারি হাসপাতালগুলো। হাসপাতালের প্রবেশ গেট থেকে শুরু করে কেবিন ও বেড পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে একশ্রেণির দালাল। নানা প্রলোভন, যেমন দ্রুত ডাক্তারি সেবা পাইয়ে দেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধ, থাকার কেবিন ইত্যাদি দেখিয়ে তারা দরিদ্র ও সহজ-সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একরকম সর্বস্বান্ত করে চলেছে রোগীদের। এ বাস্তবতায় সরকারি হাসপাতালের আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি। বাজেট বৃদ্ধি, চিকিৎসক সংকটের সমাধান এবং শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, অচল যন্ত্রপাতি মেরামত এবং যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল, ল্যাব পরিচালনাকারী এবং টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিতে হবে। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়দের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। হাসপাতালের আশপাশে থাকা দালালদের ধরে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে যদি অবিলম্বে যথাযথ সংস্কার না করা হয়, তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি সোনার হরিণের মতো অধরাই রয়ে যাবে।
আহাম্মদ উল্লাহ : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ