Logo
Logo
×

অল্পকথা

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

Icon

মোহাম্মদ জুলফিকার হায়দার

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দক্ষিণ ধর্মপুত্র গ্রামের পশ্চিম পাশে বয়ে যাওয়া মহুরি নদীর খেয়াঘাটের মাঝি আতর আলীর নাম অনেকেরই জানার কথা। তারই ছেলে আব্বাস আলী আমাদের সঙ্গে ১৯৯২ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে আমাদের বলেছিল, বন্ধুরা ‘আমাদের জীবন এখন Life হওয়ার সময় হয়েছে, তাই আমাদের আর দুষ্টামি না করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা উচিত।’ যদিও আব্বাস আলী এসএসসি পাশ করতে পারেনি, তবুও তার কথাটি প্রায়ই আমার মনে পড়ে; কারণ, তার মতে, এসএসসি পাশ করলেই জীবন খরভব হয়ে যাবে। আর আমার মতে, CA Qualify (পাশ) করলেই আমার জীবনটাও Life হয়ে যাবে। মাসিক বেতন দেড় লাখ থেকে তিন লাখ টাকা হয়ে যাবে। একটি গাড়ির বদলে দুটি গাড়ি হবে, লোকজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বলবে, আরও কত কী? এক্ষেত্রে আব্বাস আলী আর আমার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই, চ্যালেঞ্জও এক এবং স্বপ্নও এক, শুধু প্রত্যাশা-প্রাপ্তির পরিসর কিছুটা ছোট-বড়; কেননা, মানুষ তার আশার সমান বড়। হাসি-ঠাট্টার মতো করে যে কথাগুলো এতক্ষণ প্রকাশ করলাম, তার মর্মার্থ দাঁড়ায় : Academic ও Professional Exam পাশ করার মধ্যেই যে জীবনের সব সফলতা, তা কিন্তু নয়। সুশিক্ষা নিয়ে মানুষ হিসাবে বড় হওয়ার স্বপ্ন আমরা দেখতে শিখি না, শেখাইও না কেউ। আমরা সবাই যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাই, তবে রোগীর চেয়ে ডাক্তার বেশি হয়ে যাবে। ব্যবসায়ী বা শিল্প-কারখানার শ্রমিকের চেয়ে প্রকৌশলীর সংখ্যা বেশি হবে। তাতে করে Social Economic Imbalance হয়ে যাবে। তাই জীবনের লক্ষ্য স্থির করার সময় তা বাস্তবতার নিরিখে করা উচিত। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো।’ আরও একটি প্রবাদ আছে, ‘মা শিক্ষিত হলে সন্তান জ্ঞানী হয়।’ প্রতিটি শিশু স্কুলে যাওয়ার আগেই বিশ্বজুড়ে অবস্থিত যে বিশ্ববিদ্যালয়টি অতিক্রম করে, তা হলো তার পরিবার; ‘মা’ তার বিভাগীয় প্রধান আর বাবা হলো Vice-Chancellor, তাই স্বপ্নের প্রথম ফেরিওয়ালা হলো মা-বাবা। তারা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। তারা সবচেয়ে বেশি সময় একান্তে প্রত্যক্ষ করতে পারেন তাদের সন্তানের আগ্রহ-একাগ্রতা কীসে, কীসে তার তৃপ্তি-অতৃপ্তি, তারা অনুধাবন করতে পারেন, সন্তান আসলে কী হতে পারে। How to dream turn in to reality. How to touch the dream to make it successful. আর প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকরা যদি মা-বাবার মতো করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আগ্রহ, নিষ্ঠা, চিন্তা ও মননের নিরিখে ছাত্রছাত্রীদের সফলতার স্বপ্ন দেখান, তাতে করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থী জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারে এবং কেউ হতে পারে ব্যবসায়ী, কেউ সমাজসেবী বা জনপ্রতিনিধি, কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার অথবা জজ-ব্যারিস্টার। ফেরিওয়ালারা স্বপ্ন ফেরি করলে তাতে স্বপ্ন দেখাও যাবে, ছোঁয়াও যাবে, বাস্তবায়নও হবে। সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার কাছে নানা রঙের যে স্বপ্ন আছে, তাতে জয় করে নেওয়ার দুর্বার নেশা আছে, জয়ী হওয়ার প্রাপ্তির পূর্ণতা আছে, শিক্ষার জ্যোতি আছে, ব্যক্তিত্বের অহংকার আছে, নিজের সত্তার ওপর প্রবল আত্মবিশ্বাস আছে, জীবনবাজি রেখে চলার স্পৃহা আছে, ভালো লাগা আর মন্দ লাগার অনুভূতি প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, ভীষণ অসম্ভবকেও সম্ভব করার দুর্নিবার শক্তি আছে। যে এতসব স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ায়, সেই তো স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ডা. লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ দোতলা বাড়ির মতো, তার প্রথমতলায় থাকে জীবসত্তা আর দ্বিতীয়তলায় থাকে ব্যক্তিসত্তা। শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটে, নতুবা নিছক জীব হিসাবে তার পরিচয় রয়ে যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার শেষের কবিতায় বলেছিলেন, ‘কমল-হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভর আছে, আলোর আছে দীপ্তি।’ অন্য জায়গায় আবার বলেছেন, ‘দার্জিলিঙে জনতা আছে, মানুষ নেই।’ তার কথার সুর ধরে আমিও বলতে চাই, আজকাল বেশিরভাগ মা-বাবাই জাগতিক ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের তেমন সময় দেন না বরং তাদের সফলতার ভারটা প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর ছেড়ে দেন। আর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক নামের শিক্ষক আছে, কিন্তু স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নেই, আমরা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা চাই।

মোহাম্মদ জুলফিকার হায়দার : মহাব্যবস্থাপক, নিরীক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, যমুনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম