ডায়াবেটিস জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে গেলে হার্টের রোগ, কিডনির রোগ এবং স্নায়ুর ক্ষতির মতো গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। দেশে ডায়াবেটিস উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যার কারণগুলো হচ্ছে-অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম না করা এবং স্থূলতা। ডায়াবেটিস এখন আর শুধু কোনো একটি বিশেষ দেশের সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক মহামারির রূপ নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬৪ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে তা পৌঁছবে প্রায় ৭৮ কোটিতে। ২০২১ সালের হিসাবমতে, বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ, যা বিশ্বে ৮ম। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪৫ সালে দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ২০ লাখে, যা বাংলাদেশকে ৭ম অবস্থানে নিয়ে যাবে।
আমরা জানি, বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয় ১৪ নভেম্বর। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না কেন এই দিনে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। এ দিনটি হলো কানাডিয়ান চিকিৎসক স্যার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিন। তিনি এবং তার ছাত্র চার্লস বেস্ট মিলে কুকুরের অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। তারা একটি কুকুরের গায়ে সেই ইনসুলিন ইঞ্জেক্ট করে দেখতে পেয়েছিলেন, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে এসেছে। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে তারা দুজনই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের লোগোর মাঝে আমরা একটি নীলবৃত্ত দেখতে পাই। নীলবৃত্তটি হলো ডায়াবেটিস সচেতনতার বৈশ্বিক প্রতীক, যা ডায়াবেটিস মহামারির প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস সম্প্রদায়ের ঐক্যকে নির্দেশ করে।
প্রতিবছর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের ক্যাম্পেইন একটি থিমের ওপর ফোকাস করে হয়ে থাকে, যা এক বা একাধিক বছর বজায় থাকে। এ ধারাবাহিকতায় আগামী তিন বছরের জন্য থিম নির্ধারণ করা হয়েছে : ‘Diabetes and well-being’, অর্থাৎ ‘ডায়াবেটিস : সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।
অসংখ্য ডায়াবেটিক রোগী তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রতিদিন জীবনের বিভিন্ন কাজে যেমন-বাড়ি, কর্মস্থল ও স্কুলে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তাদের অবশ্যই দৃঢ়, সংগঠিত ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় প্রভাব ফেলবে। ডায়াবেটিস কেয়ার মূলত রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে করা হয়। তবে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও ডায়বেটিস কেয়ারের ক্ষেত্রে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য লক্ষ্যগুলো হলো : ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীকে রোগ নির্ণয়ের আওতায় আনা; ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা; ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা; ৬০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী, যাদের বয়স চল্লিশের বেশি, তাদের স্ট্যাটিনজাতীয় ওষুধ পাওয়া নিশ্চিত করা।
প্রতিপাদ্য বাস্তবায়নে ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্কের (এনএইচএন) ভূমিকা : ১০০ শতাংশ টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীর জন্য ডায়াবেটিস চিকিৎসার ইনসুলিন সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এর পাশাপাশি ব্লাড সুগারের সেলফ মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। এনএইচএন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, যা আটটি হাসপাতাল ও ২৩টি বহির্বিভাগের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। সেবার মান আরও সহজ করার জন্য ডিজিটালঅ্যাপস ও কল সেন্টারের সুবিধা সংযোজন করার কাজ এগিয়ে চলছে। কাজগুলো সম্পন্ন হলে আশা করা যায়, এনএইচএন তার প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।
আসুন, আমরা সবাই আগামী তিন বছর এ প্রতিপাদ্য ‘সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’ বাস্তবায়নে কাজ করি এবং ডায়াবেটিস মহামারি নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা রাখি।
ডা. এম এ সামাদ : কনসালটেন্ট এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট