জনগণ কবে এক নম্বরে আসবে?
মোশাররফ হোসেন মুসা
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মাঝেমধ্যে কয়েকজন মান্যবর যুক্ত হন। তারা নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতি, দর্শন, ধর্মসহ সমাজের নানা বৈষম্য নিয়ে মতবিনিময় করেন। আড্ডার ঘটনাটি ছিল ২০১৬ সালের। আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আইনের সাবেক শিক্ষার্থী মো. সিরাজুল ইসলাম। তার মতে, মুসলিমপ্রধান দেশগুলো পাঁচটি শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়-১. পরাশক্তি; ২. সামরিক ও আমলা শ্রেণির শক্তি; ৩. ধণিক শ্রেণির শক্তি; ৪. ধর্মীয় শক্তি ও ৫. জনগণের শক্তি। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে এ পাঁচ শক্তির অপূর্ব সমন্বয়। পরাশক্তি হিসাবে রাশিয়া ও ভারত পক্ষে ছিল। সামরিক বাহিনী ১১টি সেক্টরে দেশকে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করে। উঠতি ধণিক শ্রেণি সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। সুফিবাদী ধর্মীয় শক্তিসহ সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ সমর্থন প্রদান করে।
জনগণ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়। যুদ্ধশেষে জনগণের ৫ নম্বর থেকে ১ নম্বরে চলে আসার কথা; কিন্তু তৎকালীন সরকারের শ্রেণিগত চরিত্রের কারণে জনগণকে ৫ নম্বরে রেখে দেওয়া হয়। যা হোক, স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিরোধিতা শুরু করে। পাকিস্তানফেরত সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তৎকালীন সরকারের জাতীয়করণ নীতি, ১০০ বিঘার জমি সিলিং ব্যবস্থা এবং বাকশাল ব্যবস্থার কারণে ধণিক শ্রেণি রুষ্ট হয়। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল নিষিদ্ধ থাকায় তারা জাসদ ও অন্যান্য দলে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। জনগণও সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। পরিণতিতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে পিতার পরিণতির কারণ বুঝতে পারেন। সেজন্য তিনি সব পরাশক্তির সঙ্গে মিত্রতা শুরু করেন। সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ধণিক শ্রেণিকে লুটপাটের সুযোগ করে দেন। হেফাজত দিয়ে ধর্মীয় শক্তিকে বিভাজন করে রাখেন। তবে তাদের একটি বড় ভুল ছিল, জনগণের শক্তিকে কোনো শক্তি মনে না করে ৫ নম্বরে রেখে দেওয়া (যেমন-সুষ্ঠু ভোট ব্যবস্থা না করা, খাদ্যদ্রব্যের দাম ক্রয়সীমার মধ্যে না রাখা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি)। শেখ হাসিনা তার সামন্তসুলভ মনোভাবের কারণে কারও পরামর্শ নিতেন না। দ্বিমত করা ব্যক্তিদের কোনো পদে রাখতেন না। ফলে দেশে তার একটি অনুগত বাহিনী তৈরি হয়। জন্ম হয় নয়া ফ্যাসিজমের। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি সামান্য ছাত্র আন্দোলন তাদের এভাবে বিদায় করে দিতে পারে।
এখন দেখা যাক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাঁচ শক্তির ভূমিকা। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে চলে যাওয়া মানে ইউরোপীয় শক্তিও বিরুদ্ধে চলে যাওয়া। ৩ আগস্ট সামরিক বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় তারা কারফিউতে রাস্তায় থাকবে; কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে কোনো শক্তি প্রয়োগ করবে না। তবে ধণিক শ্রেণি সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ধর্মীয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে। জনগণ রাস্তায় নামে। পরিণতিতে শেখ হাসিনার করুণ বিদায়। জনগণ এক লাফে ৫ নম্বর থেকে ১ নম্বরে চলে আসে। তারা বিজয় উল্লাস করে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর জনগণ আবার ৫ নম্বরে নেমে যায়, যার লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয়, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের মৌলিক বিষয় অর্থনৈতিক কমিশন ও ভূমি কমিশন গঠন করা হয়নি। বলা হচ্ছে, দেশকে ইউরোপ করা হবে। ফরহাদ মজহার বলেছেন, ইউরোপ না হোক অন্তত মালয়েশিয়ার মতো করা হোক। মনে রাখা দরকার, সেসব দেশে জনগণ ১ নম্বরে রয়েছে। নেতারা জনগণকে ১ নম্বরে নিয়ে আসার জন্য রাজনীতি শুরু করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম নেতৃত্ব ও রাজনীতি কোথায়?
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক