|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘একটা গাধা হয়ে তুমি এমন কাজ কীভাবে করতে পারলে? তোমার কী কমনসেন্স বলে কিছুই নেই?’- কথাগুলো খুব ঝাঁঝের সঙ্গে বলল একটা ষাঁড়। গাধা বেশ ভালো করেই জানে, যতই যুক্তি দেখাক না কেন, এ সময় ষাঁড়কে কিছু বলতে গেলেই উলটো আরও বিপদ বাড়বে। হয়তো রেগে-মেগে এমন এক গুঁতো দিয়ে বসবে, যে পেট ফুঁড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। তখন বাঁচা-মরা নিয়েই টানাটানি বেঁধে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো, খানিক বকাঝকা করে শান্ত হোক।
ঘটনাটা একটু খুলে বলা দরকার।
অন্যান্য দিনের মতোই গতকালও গাধাটা কাজে বের হয়েছিল। বনের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা এবড়োখেবড়ো উঁচু-নিচু পথ চলে গেছে। সেই পথের ওপরে অনেক গাছের ঝরা-পাতা যেখানে-সেখানে পড়ে আছে। এটা খুবই একটা সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু গোল বাধল হঠাৎ করেই একটা ইঁদুরের চিঁইই চিঁইই চিৎকারে। ইঁদুরটা সেই পথের ওপরে ঝরে পড়া পাতার নিচে ঢুকে হয়তো কিছু একটা করছিল। কী করছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ বন আইনে সব প্রাণীর জন্যই এভাবে রাস্তার পরে গিয়ে বসে থাকা কিংবা হাঁটাচলা ছাড়া অন্য কোনো কাজ সম্পূর্ণই নিষিদ্ধ। সে যা-ই হোক, পাতার নিচে বসে থাকার কারণে গাধাটা তাকে দেখতে পায়নি; দেখার কথাও নয়। এবং রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তার একটা পা ইঁদুরটার লেজের ওপর গিয়ে পড়ে। লেজটা অবশ্য একেবারে কাটা পড়েনি, কিন্তু এমনভাবে থেঁতলে গিয়েছে যে, যে কেউই থেঁতলানো লেজ দেখে তার প্রতি সহানুভূতিতে গদগদ হয়ে উঠেছে।
ব্যাপারটা নিয়ে একটা হলুদ রঙের পণ্ডিত শেয়াল একটা ছোট খাটো জ্ঞান-বৃক্ষের পাতায় দুকলম লিখেছেও। শিরোনাম দিয়েছে বেশ নজরকাড়া,
‘বড় গাধার মধ্যযুগীয় নির্যাতন!’
আলোচনা-অংশে লিখেছে, ‘বনরাজ্যে শুরু হয়েছে চরম অরাজকতা। কোনো গাধাই এখন আর বনের ছোট-খাটো কোনো সাধারণ পশুপাখি-জন্তু-জানোয়ারকে মূল্যায়ন করে না। তারই একটি চরম নজির গতকাল আবারও সাধারণ ছোট-খাট পশুপাখিরা দেখতে পেল। ঘটনা তদন্তে এবং বিভিন্ন পশু মুখে জানা যায়, চুঁনো নামে একটি ইঁদুর জরুরি প্রয়োজনে রাস্তা পার হচ্ছিল। এ সময় একটা গাধাও ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। ইঁদুরকে দেখেই গাধা বলল, তার আগে যেন ইঁদুর রাস্তা পার না হয়। ইঁদুরটা তার জরুরি কাজের কথা বলতেই গাধা খেপে গিয়ে নির্মমভাবে তার লেজ মাড়িয়ে থেঁতলে দেয়। ইঁদুরটি এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার লেজে পচন ধরে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে বলে কবিরাজ বানর জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইঁদুর নেতা ধেঁড়ে অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘উনি গাধা হয়েছেন, উনার দেহের আকার বড়। উনার পায়ে খুর আছে। তাই বলে কি উনিই সব সময় আগে আগে চলবেন? বনে কি এমন আইন আছে?’ ভুক্তভোগী চুঁনো ইঁদুর বলেন, ‘আমরা খুবই ছোট। আমরা এখন কার কাছে বিচার চাইব?’ সর্বশেষ জানা গেছে, চুঁনো ইঁদুরের পরিবারে এখন শোকের মাতম চলছে। চুঁনো সুস্থ না হওয়া পযন্ত তার পরিবারের আহার কীভাবে জোগাড় হবে, তা কেউ বলতে পারে না। চুঁনোর পঞ্চম স্ত্রী চারটি অসহায় শিশু-ইঁদুর নিয়ে পশ্যুতর জীবন কাটাচ্ছে।’
জ্ঞান-বৃক্ষের পাতায় এ খবর দেখামাত্রই সারা বনের সব পশুপাখি একজোট হয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিল। চুঁনো-ইঁদুর যে আইন ভঙ্গ করে ওখানে গিয়ে বসে ছিল, এটা এখন আর আলোচনাতেই আসছে না। গাধাটা অবশ্য মনে মনে ভাবছিল, লেজটা পুরো কাটা গেলেই ভালো হতো। কারণ কাটা-লেজের চেয়ে থ্যাঁতলানো লেজ দেখেই যে কোনো পশুর মনে মায়া জাগে বেশি। লেজ থেঁতলে যাওয়ার এ ঘটানাকে কেন্দ্র করে বনে-বনে একটা শোরগোল পড়ে গেল। একটা হুলো বিড়াল বলল, ‘আমরা আকারে ছোট হতে পারি, কিন্তু তাই বলে আমাদের ওপর এ অনাচার আর আমরা মানতে চাই না। গাধাদের গাধামি আর সহ্য করব না। পথ কি ওদের একার নাকি?’ কেউই আর ইঁদুরের কোনো দোষ নিয়ে আলোচনা করল না, লেজ থ্যাঁতলানোর করুণ দৃশ্য আর সব ঢেকে ফেলেছে। বনের অন্য পশুরাও ইঁদুরের পাশে এসে সংহতি জানিয়েছে।
বর্ণ-কানা ষাঁড় যখন এ খবরটি দেখল এবং অন্য দু-একটি পশুমুখে এ বিষয়ে জানতে পারল, সে তক্ষুণি গাধাকে ডেকে পাঠাল। এবং গাধার কাছে রাগে-রাগে ঘটনার বিষয়ে শুধু জানতে চাইল, ‘তুমি কি ইঁদুরের লেজ থেঁতলে দিয়েছ?’ গাধা একটু ভয়ে ভয়ে ঘটনাটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তাকে সে সুযোগ আর দেওয়া হলো না। এরই মধ্যে অন্য একটা ষাঁড় এসে পাশে দাঁড়াল এবং মন্তব্য করল, ‘আজকালকার গাধাগুলো কীভাবে যে পথ চলে, বুঝি না। এদের পথে উঠতে দেওয়াই ঠিক না।’ এরপরই প্রথম ষাঁড়টি ঝাঁঝের সঙ্গে ওপরের কথাগুলো বলে উঠল, ‘একটা গাধা হয়ে তুমি এমন কাজ কীভাবে করতে পারলে? তোমার কী কমনসেন্স বলে কিছুই নেই?’ গাধা চুপচাপ শুনল এবং অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়ে ভুল স্বীকার করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। ওইদিন বিকালেই একটা বনমোরগ এসে গাধাকে জানিয়ে দিল, ষাঁড় তাকে ওই পথ দিয়ে হাঁটতে নিষেধ করেছে। এখন থেকে তাকে অন্য পথ দিয়ে যাতায়াত করতে হবে।
এ ঘটনা গাধার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কারোরই জানতে বাকি থাকল না।
এক বয়স্ক গাধা এসে তাকে বলল, ‘তোমার আসলে একটু খেয়াল করা দরকার ছিল। কারণ পাতার নিচে দিয়েও তো অনেক ইঁদুর যাওয়া-আসা করতে পারে।’
প্রতিবেশী এক বুনোহাঁস একদিন কথায় কথায় প্যাক প্যাক করে বলল, ‘চলার সময় খুর দিয়ে মাটিতে শব্দ করে করে হাঁটলে তো আর এ ঘটনা ঘটত না। ইঁদুর শব্দ শুনেই সরে যেতে পারত।’
আরেক দিন একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয় মহিষের সঙ্গে দেখা হতেই বলল, ‘পথচলার সময় পা খুব আস্তে আস্তে ফেলতে হয়, যাতে পায়ের নিচে কেউ পড়তে গেলেও সে দ্রুত সরে যেতে পারে।’
অন্য একদিন এক শুভাকাঙ্ক্ষী গাধা বলল, ‘আরে বোকা, রাস্তাঘাটের যে দশা, তাতে এক পা এগোনোর পর আরেক পা পেছনে যেতে হয়। এভাবে না-চললে যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটবেই। এখন আর দ্রুত হাঁটার দিন নেই।’
গাধাটা তখন মনে মনে ভাবছিল, এক পা এগোনোর পর যদি আবার এক পা পেছনে যাই, তাহলে তো এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে পাগুলো বারবার সামনে-পেছনে ফেললে মনে হবে যেন হাঁটছে, আবার একইসঙ্গে পায়ের নিচে পড়ে কারও লেজ থেঁতলে যাওয়ারও ভয় নেই; এ কথা সে গাধা হয়েও বুঝতে পারল। গাধা তার শুভাকাঙ্ক্ষীর এ বুদ্ধিকে মনে মনে খুব তারিফ করল। সে যাই-ই হোক, গাধার ওই দিনের ঘটনায় নানা পশুতে নানা রকম ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করল। এবং সবই সঠিক বলে গাধা মেনে নিয়েছে। তার উপায় নেই। সত্যিই উপায় ছিল না।
দুই. একটা ষাঁড় মুখ নিচু করে ঘাস খাচ্ছিল। একটা হরিণের বাচ্চা তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে এসে হঠাৎ করেই সেই ষাঁড়ের ওপর এসে পড়ল। পড়বি পড়, তাই বলে সিংয়ের ওপর! ধারালো সিংয়ের খোঁচায় হরিণের পেছনের বাম পায়ে একটা ছিদ্র হয়ে গেল। সামান্য কিছুটা রক্তও ঝরল। যতটা না ক্ষতি হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেয়েছে হরিণ-শাবকটি। মহুম মহুম চিৎকার করতে করতে খানিক দূরেই ঘাসে-মুখ-দিয়ে-চলা তার মা-চাচি-মামা-খালু পর্যায়ের হরিণদের কাছে চলে গেল।
‘এমন নিরীহ একটা বাচ্চার গায়ে গুঁতো মেরে ষাঁড়টি তার ক্ষমতা দেখিছেয়ে, না?; বলল এক চাচা হরিণ। ঠিক কী যে ঘটেছিল, সে কথা বাচ্চা-হরিণটাও ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারছে না। সে শুধু তার পেছনের বাম পায়ের ব্যথা নিয়েই কাতরাচ্ছে। দোষ কার, সেটা এখন আর মুখ্য নয়। হরিণের বাচ্চাটারও মনে হচ্ছিল, ‘ষাঁড়টা ওখানে আসতে গেল কেন? তার কি ওখানে না এলেই চলত না?’
দাদা-হরিণটা একটু দূরে ছিল। সে যখন জানতে পারল তার নাতির আহত হওয়ার বিষয়টা, সে তখন বলল, ‘এই ষাঁড়টার কারণে এ এলাকায় অনেকেই বনের মাঝখানে নেমে ঘাস খেতে পারছে না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’
বন আইনে সব তৃণভোজী পশুদের বলা ছিল, কেউই তৃণভূমির মাঝখানে গিয়ে ঘাস খেতে পারবে না। সবাই একপাশ থেকে খাওয়া শুরু করবে। পেট ভরে গেলে চলে আসবে। এতে ঘাস-নিরাপত্তা নিশ্চিৎ হবে। ফলে ভবিষ্যতে কখনো ঘাসের সংকট হবে না। এ বিষয়ে দেখভাল করার জন্য এ ষাঁড়টিকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। কিন্তু মাঝখানের ঘাস বেশি সবুজ, বেশি ঘন এবং অল্প সময়ে খেয়ে পেট ভরা যায় বলে, মাঝখানে নেমেই ঘাস খাওয়ার জন্য প্রায় সব তৃণভোজী পশুই উন্মুখ হয়ে থাকে। এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে ষাঁড়ের সাঙ্গ কখনো কখনো অন্য তৃণভোজী কিছু পশুর টুকটাক বাকবিতণ্ডা হয়েছে বলেও জানা যায়। অবশ্য দুটো চতুর ঘোড়া সবার অলক্ষে তৃণভূমির মাঝখানে নেমেই ঘাস খায়, এটা অনেকেই জানে। কিন্তু ঘোড়ার অশ্ব-শক্তির কারণে কেউ ভয়ে মুখ খোলে না। একদিন তো এক বলদ নিজের চোখেই দেখে ফেলেছিল, একটা ঘোড়া সন্ধ্যার পর দুই আঁটি ঘাস নিয়ে ওই ষাঁড়ের ডেরায় দেখা করতে গিয়েছিল। ষাঁড়ও পরদিন ভোরে ?পুরো একঘণ্টা তৃণভূমির কাছে আসেনি। সেদিন ভোরে সেই ঘোড়াটাই বনের মাঝখানে গিয়ে ঘাস খেয়েছে। এটা একটা বানরও নিজের চোখে দেখেছে। এ নিয়ে বলদটা ষাঁড়ের বিরুদ্ধে গণ্ডারের কাছে নালিশও করেছিল। এবং সাক্ষী হিসাবে সেই বানরকে রেখেছিল।
গণ্ডার যখন ষাঁড়কে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ষাঁড় সরাসরি অস্বীকার করে বলল, ‘এটা বলদের ষড়যন্ত্র। তাকে অন্যায়ভাবে ঘাস খেতে দিই না বলে, সে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে।’
গণ্ডার বলল, ‘একটা বানর সাক্ষী আছে।’
বানরকে খবর পাঠানো হলো। বানর আসার সময় পথ চলতে চলতে ভাবতে লাগল, ‘কে কোথায় ঘাস খেল কি খেল না, তাতে তার কী যায় আসে? সে তো আর ঘাস খায় না।’ ?তা ছাড়া সে এও ভেবে দেখল, ‘বলদের চেয়ে ষাঁড়ের সিং বেশি ধারালো, শক্তিও অনেক বেশি।’
বানর আসার পর গণ্ডার তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এ ব্যাপারে কী জান?’
বানর নির্বিকারভাবে বলল, ‘আমি শুনেছি, বলদের সঙ্গে ষাঁড়ের একটা ঝগড়া হয়েছে। এর বেশি কিছুই জানি না। তা ছাড়া ওইদিন ভোরে তো আমি ওই এলাকায়ই ছিলাম না।’
শোনা যায়, মিথ্যা নালিশ করার দায় চাপিয়ে সেই বলদকে তিন দিনের জন্য ওই বনের ঘাস খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
তবে এবারের ঘটনা একটু ভিন্ন। সেই দাদা-হরিণের সঙ্গে গণ্ডারের অনেক দিন থেকেই বেশ দহরম-মহরম আছে। দাদা-হরিণ তাকে দুলাভাই বলে ডাকে। এ দুলাভাই ডাকার ঘটনা নিয়েও এ বনে কিছু কিছু পশুর আড়ালে-আবডালে বেশ রসালো আলাপ-আলোচনা করার গুঞ্জন কানে আসে। সে ইতিহাস অন্য আরেক দিন বলা যাবে। সেই দাদা-হরিণ গণ্ডারের কাছে গিয়ে বিচার চাইল, ‘এই ষাঁড়ের কারণে এলাকার সব তৃণভোজীরা মানুষের মতো অপাশবিক জীবনযাপন করছে। যে কোনো সময় সব পশু ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে। ওই ষাঁড় সব তৃণভোজীর সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। কারণে-অকারণে সে তার শিং এবং ধারালো খুরের ভয় দেখায়। গতকালও একটা মাছুম হরিণকে নির্মমভাবে গুঁতো মেরে তার পেছনের পা ফুটো করে ফেলেছে। মাছুম হরিণটার দোষ ছিল, সে বনের পাশে খেলা করছিল। কিন্তু সে কোনো ঘাস নষ্ট করছিল না। এ অবস্থায় আমরা এ বনের সব তৃণভোজী চাই, ওই ষাঁড়কে এ এলাকা থেকে সরিয়ে দিন। এবং একইসঙ্গে তাকে বনের ঘাস দেখভালের দায়িত্ব থেকেও বাদ দেওয়ার আকুল আবেদন করছি।’
অভিযোগ পেয়ে তিলমাত্র দেরি না করে গণ্ডার ষাঁড়কে ডাকল, ‘এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কী?’
ষাঁড় তার বক্তব্য পেশ করল। উত্তরে গণ্ডার বলল, ‘এটা কোনো যুক্তির কথা হলো না। বাচ্চা-হরিণ যত মাছুমই হোক, সে স্বেচ্ছায় তোমার শিংয়ের ওপরে গিয়ে গুঁতো খেয়ে আসবে, এটা অযৌক্তিক। তা ছাড়া তোমার ব্যাপারে আগেও আমি অভিযোগ শুনেছি। একটু ম্যানেজ করে না চললে বনে টেকা যাবে না। তুমি কি বোঝ, এ ঘটনাকে ইস্যু করে যদি এখন সব হরিণ তাদের শিং ব্যবহার করে, তাহলে কী হতে পারে? এটা জানো না, ওদের শিংয়েরও আবার কী পরিমাণ ডালপালা আছে ?’
রাগান্বিত ভাবটা আরেকটু চড়িয়ে দিয়ে গণ্ডার আবার বলল, ‘যাও, কাল থেকে আপাতত কয়েক দিন তোমার কোনো কাজ নেই। পরে খোঁজ নিও, যদি অন্য কোনো বনে সুযোগ থাকে সেখানে তোমাকে পাঠিয়ে দেব।’
ষাঁড়ের বয়স একেবারে কম হয়নি। সে ভালোই জানে, এখন কিছু বলতে গেলে সবকিছু আরও বেশি মাত্রায় বিপরীতে যেতে পারে। তাই শুধু মুখে বারবার ‘জি মান্যরব, জি মান্যবর’ বলে সেখান থেকে উঠে এলো।
ষাঁড়ের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বিষয়টা জানতে পারল। পরিচিত মহলে যেটুকু ইজ্জত ছিল, তা মুহূর্তেই শেষ।
পরদিন ষাঁড়টি নদীর পাড়ে মন খারাপ করে বসে ছিল। একটা কুমির তাকে দেখতে পেয়ে আশপাশের জল ব্যাপক ঘোলা করে এগিয়ে এলো। বলল, ‘আমিও শুনেছি। মন খারাপ করো না। তবে তুমি তো মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে এদিক-ওদিক দেখে নিতে পারতে, আশপাশে কোনো মাছুম পশু আছে কিনা? এটা আসলে তোমার একটু ভুল হয়েছে।’
দ্বিতীয় দিন সকালে একটা ছাগল ম্যা ম্যা করে বলল, ‘আপনি এমন কাজ করতে পারেন, এটা আমিও প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। অল্পতেই রেগে যাওয়াটা আসলে বোকামি। আপনি এ সময় একটা ম্যাথোডে রাগ নিয়ন্ত্রণের ওপর একটা কোর্স করে ফেলতে পারেন। আমি করে বেশ ফল পেয়েছি। আমার তো এখন আর কোনো কিছুতেই রাগ হয় না।’
ওইদিন দুপুরে একটা ঘোড়া আফসোস করে বললে, ‘কী আর করবেন! তবে আপনার মতো ধারালো শিংওয়ালাদের আরও একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করা উচিত। এতটা বেখায়ালি হওয়াটা ঠিক হয়নি।’
বিকালের দিকে একটা পাতি শেয়াল হুক্কা হুয়া শব্দে হেসে-কেঁদে কী বলল, তা শোনার কোনো আগ্রহই ষাঁড়ের ছিল না। তবু যা বুঝল, তার মর্মার্থ হলো, ‘ভুলটা যখন তোমারই, তাহলে এত মন-খারাপ ভাব নিয়ে থাকার দরকার কী। আহত মাছুম হরিণের কাছে সরি বললে তো আর জাত যেত না। ভুল স্বীকার করলে প্রভুও তার ওপর খুশি হন।’
নানা পশুর নানা মন্তব্যে এক সময় ষাঁড়েরও ধারণা হলো, ভুলটা সে-ই করেছে।
এরও একদিন পর দুপুরের ঠিক আগ মুহূর্তে ষাঁড়টা একটা গাছের নিচে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিল। ওই সময় সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল সেই গাধাটা, যে কিনা একটা ইঁদুরের লেজে পা ফেলেছিল। গাধা হলেও ষাঁড়কে দেখেই চিনে ফেলল, এ সেই মান্যবর ষাঁড়। তারপর দুজনে একটু কুশলাদি জিজ্ঞেস শেষে বিদায় নেওয়ার সময় গাধাটা আবারও মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘আসলে কী আর বলব, মান্যবর! এ বন চলে মান্যবরদের ব্যাখ্যার ওপর। কোনো ঘটনা যে যেভাবে পারে, ব্যাখ্যা করে। যিনি যত বড় মান্যবর, তার ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। সে ঠিক-ভুল যা-ই হোক।’
মান্যবর ষাঁড় মনে মনে গাধার কথার ব্যাখ্যা করল, ‘তুমি আমারে ব্যাখ্যা শেখাও। কয়েকটা দিন যাক, তখন তোমারে ব্যাখ্যা কী জিনিস, শেখায়ে দিব।’ কিন্তু মুখে একটু হালকা হাসি নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, একদম খাঁটি কথাই বলেছ।’
গাধা জানতেও পারল না, বিপদে পড়লেও মান্যবরেরা তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা বদলায় না।
