Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

জ্যোৎস্না অরণ্য

কবি হৃদয়ের বিজ্ঞপ্তি

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বদলে যাওয়া একাকিত্ব আরও বহুমাত্রিক এক ছকে ‘যুগধর্ম’ হয়ে প্রবেশ করেছে ব্যাধির মতো। কবি লুব্ধক মাহবুব সেই যুগধর্মের হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে আপন হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে একত্রিত করেছেন তার নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’-তে। ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’ শিরোনামেই এক অনন্য অনুভবের দিগন্ত উন্মোচন করে। নামেই যেন জাগে স্বপ্ন ও স্বরূপ-জ্যোৎস্না, যেখানে কোমলতা ও রহস্য; অরণ্য, যেখানে নির্জনতা ও অগাধ বিস্তার। কবির পূর্ববর্তী কাজের তুলনায় এটি আরও গভীর, আরও প্রতীকময়। প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, সময়, আত্মোপলব্ধি, সমাজ ও রাজনীতি-সব মিলেই এখানে তৈরি হয়েছে এক বহুমাত্রিক কাব্যভুবন। ভাষা যেমন তীব্র, তেমনি স্পর্শকাতর। কখনো তা যেন সংগীতের মতো গীতল, আবার কখনো খণ্ড খণ্ড চিত্রের মতো ভাস্বর।

মাহবুবুর রহমান ভূইয়া, কবি নাম লুব্ধক মাহবুব; তার ‘অস্পৃশ্য অনুভূতি’ ও ‘বসন্ত বেলা’ কাব্যগ্রন্থ পাঠকপ্রিয়তা লাভের পর এবার প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’, যার ইংরেজি নাম ‘Frost-Kissed Wilderness’। আসছে প্রজন্মকে উৎসাহিত করার জন্য এ বইয়ের কবিতাগুলো ইংরেজিতেও করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেটা পাঠককে চমৎকৃত করবে সত্যি। কবির আশা এ বইয়ের কবিতাগুলো দিয়ে প্রিয় পাঠক ও আসছে প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকতে পারবেন অনন্ত নক্ষত্রবীথির আলোতে।

‘জ্যোৎস্না অরণ্য’ হতে পারে এক ধরনের কনট্রাস্ট-আলো ও অন্ধকারের সহাবস্থান। বইটির কবিতাগুলোও সেই দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের রূপকথা। লুব্ধক মাহবুব প্রকৃতিকে কেবল দৃশ্যের জন্য ব্যবহার করেন না, বরং তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের অনুবাদ। ‘জ্যোৎস্না’ তার কাছে এক ধরনের ভেতরের আলোকচ্ছটা-আশা, প্রেম, স্মৃতি বা আত্মদর্শনের রূপ। অন্যদিকে ‘অরণ্য’ হয়ে ওঠে দিগন্তব্যাপী নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা, আবার প্রতিবাদের এক অব্যক্ত কণ্ঠ। প্রেম এখানে কেবল রোমান্টিক নয়-এটি অস্তিত্বগত, বোধের, কিংবা মানবিক বন্ধনের ভাষা। অনেক কবিতায় প্রেম যেমন এসেছে আশ্রয়ের মতো, তেমনি আবার ধ্বংস ও শূন্যতার পূর্বসংকেত হিসাবেও। ‘জোৎুা অরণ্য’ শিরোনামের কবিতা তেমনটিই মনে করায়-‘জ্যাঁ কার্ডিয়ে সেতুর এপাশের/ প্রেইরীর খাঁদে,/ চকচক করছে ম্যাপেল গাছগুলি!/ যেন প্রমত্তা রূপসা নদীর/ উপর অসংখ্য শঙ্খচূড়ের/ ভয়াল ফণা।/ এক, ভয়াবহ হিমঝড়!/ নক্ষত্রগুলোকে হিমায়িত/ মনে হয়, আকাশকে মনে হয় নিথর,/ লা রোঁন্ডেড় ঝকঝকে চরকিতে/ স্ফটিক তুষার।/ শীতের শেষে এটাই/ নাকি বসন্তের পদধ্বনি।/ আরেক প্রান্তে আমি।/ অজস্র মানুষের ভয়ে বসন্ত/ নিয়েছে বিদায়।’

সময়ের সংবেদনশীল সুর ধরা আছে এ বইয়ের অনেক কবিতায়। বিশেষ করে মানবিক সংকট, চেপে বসা একাকিত্ব, নিপীড়িত মানুষের আর্তি-এ সবই ফুটে ওঠে কিছু কবিতার পরতে পরতে। তবুও কবি সরাসরি স্লোগান উচ্চারণ করেন না, বরং একটি ব্যথিত অথচ সংযত কণ্ঠস্বর রেখে যান। যেমন ‘নকল জীবন’ কবিতায় বলেন-‘ধূসর আকাশ,/ ধূসর পথ, ধূসর মুখ,/ ধূসর দৃষ্টি। গাড়ির হর্ন,/ মানুষের চিৎকার,/ শহরের প্রতিটি মুহূর্তে/ বিষণ্নতার বার।/ অফিসের টেবিলে একাকী বসে,/ কম্পিউটারের স্ক্রিনে,/ মুখ গুঁজে।/ কাজের চাপে,/ হারিয়ে যায়,/ নিজের স্বপ্ন, নিজের আকাঙ্ক্ষা।/ রাত নামলে,/ নগরী জ্বলে ওঠে,/ আলোর ঝলকানিতে,/ মন উতলা হয়।/ কিন্তু একাকীত্বের/ বেড়াজাল,/ ছিনিয়ে নেয়,/ সকল আনন্দ।’

অনেকটা একই ধরনের কণ্ঠ শোনা যায় ‘আমি দুর্বল নই, ক্লান্ত’ শিরোনামের কবিতায়-‘হ্যাঁ, ক্লান্ত আমি, ভালোবাসার নামে/ অবিরাম লড়াই, অবিরাম ব্যথা।/ অবহেলা অবহেলায় ভরা/ এই স্বার্থপর সমাজ,/ যেখানে ভালোবাসা হারিয়ে গেছে/ লোভের খেলায়।/ দখলদারি প্রতিটি সম্পর্ক এক যুদ্ধক্ষেত্র,/ যেখানে জয় শুধু নিজের ইচ্ছার।/ কিন্তু আমি দুর্বল নই,/ আমার ভালোবাসা শুধু একটি বন্দি নয়,/ এটি মুক্তির ডাক।/ সত্যের আলো এ অন্ধকারে জ্বলবে/ সত্যের আলো,/ সার্থের মুখোশ উন্মোচিত হবে সকলের কাছে।/ নতুন ভোর/ নতুন ভোর আসবে/ অবশ্যই, যেখানে ভালোবাসা/ জয়ী হবে সকল অত্যাচারে।’

এ বইয়ের প্রতিটি কবিতার শিরোনাম পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের দাবিদার-জোৎস্না অরণ্য, ফাগুনের স্পন্দন, অসময়ের ফুল, সময়ের বাগানে, নিষ্কাম ভালবাসা, প্রেমের পোস্টমর্টেম, স্বপ্নের এক জগত, মরা কবি, কাছাকাছি দূরত্ব, মিশ্রিত প্রশ্ন?, সুরিয়েলিস্টিক অভিযাত্রী, সন্ত্রস্ত পাখি, কপি পেস্ট, অবিরাম অপেক্ষার গান, আধুনিকতার প্রেত, কবিতার শেষ সুর, মানুষ খুঁজি, নকল জীবন, আমি দুর্বল নই, ক্লান্ত। এ বইয়ের কবিতাগুলো জানিয়ে দেয় কবি হৃদয়ের বিস্তার!

সম্পর্কের রূপান্তর এবং অভ্যন্তরীণ নৈঃশব্দ্য বয়ান হতে পারে ‘প্রেমের পোস্টমর্টেম’-এর মতো কবিতাগুলো-‘হোক না কয়েক পলক হোক কিছু সময়/ তবুও প্রেম থাকুক বেঁচে, লোমকূপে ছুঁয়ে যাওয়া/ ছোট্ট প্রহর এতটুকুই চাই, শুধু সুখকে যেচে।/ আমি তো তোমার জন্য জীবন রেখেছি বাজি।/ তুমি চাইলে স্বর্গের সুখ, পাতালের সুর, বিসর্জন দিতে পারি।/ প্রতিদিন চাঁদটা তোমার জন্য হাজির করতাম।/ আর তুমি কিনা এক ফালি জোছনাতেই খুশি।/ কতদিন তোমার অপেক্ষায় আছি।/ তোমায় বিষের বীণে আমার হৃদয় ফালি ফালি হবে/ আর তুমি কিনা কোলে তুলে নিলে?/ কেবল হৃদয় নিয়েছ নারী?’ জীবনের অনিবার্য ভাঙন এবং তা মেনে নেওয়ার কিছু কবিতায় বিক্ষোভের প্রকটতা নেই সত্যি তবে বিরহের টান স্পষ্ট। ‘মরা কবি’ কবিতা যেমন বলে-‘যদি কখনো/ সাধ জাগে কবিতায়/ ডুবে মরবার,/ শেষ রাতের ফুরফুরে বাতাস/ আর ফুলের গন্ধ/ গায়ে মেখে একটুখানি কান পেতো/ কবিতার জলোচ্ছ্বাস তোমাকে ভাসিয়ে নেবে।/ অবিরাম, যেনো রক্তের ছিটে,/ যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ,/ ভালোবাসার মতো,/ যেমন শিশু, মৃত্যুর মতো,/ অনিঃশেষ বৃষ্টি।’

প্রকৃতপক্ষে, ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’ বইটির শরীরজুড়ে আছে কবি হৃদয়ের স্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি: যেখানে পুড়ে যাচ্ছে হৃদয়; অথচ কোথাও আগুন নেই! আছে জ্যোৎস্নার ইন্ধন। চারু পিন্টু’র প্রচ্ছদ ভাবনায় আশিটি কাব্যের এ গ্রন্থটি পঁচিশের বইমেলায় এনেছে সৃজন প্রকাশনী। মূল্য : ৪০০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম