বন্ধু কবি মুকুল চৌধুরী
বাদ প্রতিবাদ দিয়ে শুরু রৌপ্য পদক দিয়ে শেষ
মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পরিচয়ের সূত্রটাই ছিল একটি বিষয়ে ধাক্কাধাক্কির পথ ধরে। আমি তখন ২২ বছরের তাগড়া যুবক। জাতীয় তরুণ সংঘ করি ১৯৭৭ সাল থেকে। কিশোরগঞ্জ থানা শাখার আমি সেক্রেটরি। একুশ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘একুশের উত্তরসূরী’ নামক লিটল ম্যাগ। সে বছর থেকেই জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে আমার লেখা প্রকাশের পথ ধরে বলতে গেলে আশির দশকেই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সাহিত্যের মাঠে আবির্ভূত হই। কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলের মহাব্যবস্থাপকের একান্ত সহকারী হিসাবে আমার কর্মজীবন শুরু। অফিস টাইম শেষ হলেই চলে যাই শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে। সব কটা পত্রিকার সাহিত্য পাতাই আমার মূল টার্গেট।
১২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সাহিত্য পাতায় বেশ বড় একটা আর্টিকেল চোখে পড়ল। আর্টিকেলটির শিরোনাম ‘সিলেট একাডেমি পত্রিকা এবং একটি গবেষণা প্রবন্ধ’ (অসমাপ্ত)।
তার সে লেখাটি পরবর্তী কয়েক সংখ্যা শুক্রবার সংগ্রাম সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। ১৫ অক্টোবর, ১৯৮২ সংখ্যায় ছাপানো অংশসহ পুরো লেখাটি মনযোগের সঙ্গেই আমি পাঠ করি। এ লেখার সূত্র ধরেই ‘মুকুল চৌধুরী’ নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তবে কবি মুকুল চৌধুরী নয় গদ্য লেখক, গবেষক হিসাবেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। লেখাটিতে তিনি সিলেটের লোকসাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একপর্যায়ে উল্লেখ করেন-‘সুদূর অতীত থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কাল পর্যন্ত অসংখ্য বাস্তব ঘটনাভিত্তিক সিলেটের বুকে যত গীতিকা রচিত হয়েছিল সেগুলো শুধু সংখ্যাতেই যে বেশি তা নয় গুণের দিক থেকেও বাংলাদেশের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকার হয়তো সবই আসলে সিলেট গীতিকা।’ আমি তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে না পেরে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক বরাবরে একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবাদী লেখা পাঠাই এবং তার এ যুক্তি খণ্ডন করি। দৈনিক সংগ্রাম আমার এ লেখাটি নতুন একটি কলাম সৃষ্টি করে ‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ নামে অক্টোবর. ১৯৮২-এর পরবর্তী সংখ্যায় ছেপে দেন। আমি তাকে আমার লেখায় লোকসাহিত্যের ঘটনার বিবরণে স্থানীয় কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাযুজ্য পাওয়ার এবং একইসঙ্গে লোকসাহিত্যেও ভাষার ক্ষেত্রে সিলেট ও ময়মনসিংহের ভিন্নতার প্রসঙ্গ টেনে তার সে দাবি ও যুক্তি খণ্ডন করি। আমি আমার লেখায় তাকে সিলেটি নাগরী নিয়ে গবেষণা করার পরামর্শ দেই।
১৫ আগস্ট, ১৯৯১-এ আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের মুখপত্র ‘কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ পত্রিকায় ‘কিশোরগঞ্জের লোক সাহিত্যঃসংশয় নিরসন’ শিরোনামের লেখায় তার এ প্রসঙ্গটিকে আরও বিশদভাবে খোলাসা করি। ১৯৯৩ সালে এনবিআর এর অধীনে চাকরির সুবাদে ঢাকায় চলে আসার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন হেড অফিস, বায়তুল মোকাররমে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। সেই থেকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে পরে বেশি দেখা হতো মগবাজরে কবি আসাদ-বিন-হাফিজের ‘প্রীতি প্রকাশ’ এ। একদিন পুরানা পল্টনের ফুটপাতে আমার কাঙ্ক্ষিত একটি দুষ্প্রাপ্য বই কেদারনাথ মুজমদারের ১৯০৪ ও ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ’ গ্রন্থটির একটি কপি পেয়ে যাই। বিক্রেতা অত্যন্ত চালাক। আমার কাছে বইটির দাম হাঁকল ৩০০ টাকা। আমি বললাম এত দাম। বিক্রেতা বলল স্যার এটা নিতে চাইলে ৩০০ টাকাই দিতে হবে। আমি বললাম বইটি আপাতত পেছনে রাখ। ২ ঘণ্টার মধ্যে আমি না আসলে বিক্রি করবে। আমি দ্রুতলয়ে চলে গেলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিসে। দেখলাম মুকুল চৌধুরী সাহেব নোট লিখছেন। তার হাতের লেখা এত সুন্দর ঝরঝরে কেউ না দেখলে আন্দাজ করতে পারবেন না। তার নোটিং, নিশান লাগিয়ে ফাইল সাজানো অনুসরণ করার মত (আমি নিজে পলিটেকনিক থেকে সেক্রেটরিয়েল সাইন্সে প্রথম শ্রেণি পাওয়া লোক)-এর পরও তাকে আমার কাছে অফিস নোটিং-এর ব্যাপারে অনুকরণীয় আদর্শ মনে হলো। যাক আমি গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম মুকুল ভাই আপনার হাতে কি কিছু টাকা হবে। তিনি বললেন কি বই পেয়েছেন। আমি আশ্চর্য হলাম। তিনি কেমন করে বুঝতে পারলেন যে আমি কোন বই কেনার জন্য তার কাছে টাকা আছে কি না জানতে চাইছি। সম্ভবত একেই বলে ‘জহর চিনে জওহরি’। আমি বললাম কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ’। তিনি বললেন, বইটির নাম শুনেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কত লাগবে? আমি বললাম ৩০০ টাকা। তিনি বললেন এত টাকা চাইছে। আমি বললাম জি। বিক্রেতা এ দামে অনড়। তিনি তখন পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বল্লেন দ্রুত যান কিনে ফেলুন। আমি তৎক্ষণাৎ গিয়ে বইটি কিনে নিলাম। তাকে দুদিন পরই টাকাটা ফেরত দিই। তাকে নিয়ে অনেক স্মৃতির মধ্যে এটিও একটি।
১৯৯৬ সালে আসাদ বিন হাফিজের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ‘রাসূলের শানে কবিতা’। এ সময়টায় মগবাজারে তার সঙ্গে ঘনঘন দেখা হতো। রাসূলের শানে কবিতা বাংলা সাহিত্যে একটি মৌলিক সিরাত সাহিত্য সংকলন। তিনি পরে এ বিষয়ে আরও কাজ করেন এবং সিরাত বিষয়ে মোট ৫টি বই লিখেন। যে কাজের মূল্যায়নে ২০২০ সালে কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে জাতীয় পর্যায়ে ‘সিরাতুন্নবি (সা.) রৌপ্য পদকে’ সম্মানিত করি। এর মাধ্যমেই মুকুল চৌধুরী সাহেবকে আমার সীমানায় জীবদ্দশায় সম্মানিত করার একটি সুযোগ গ্রহণ করি। আশির দশকের কাব্যাঙ্গনে ডানধারায় বাঁক পরিবর্তনে কবি মুকুল চৌধুরী শীর্ষস্থানীয় কবিদের একজন। কবি মুকুল চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ২২ আগস্ট সিলেট জেলার সদর উপজেলার খালপার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মঞ্জরুল করীম চৌধুরী। পিতার নাম মরহুম বদরুল রাজ্জাক চৌধুরী, মাতার নাম মরহুমা সালেহা চৌধুরী। ১৯৬২ সালে বিশ্বনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ১৯৭৩ সালে লালা বাজার হাইস্কুল থেকে এস. এস. সি এবং ১৯৭৫ সালে সরকারি এম. সি. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এম.সি. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অনার্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এস.এস ডিগ্র লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সালে অবসরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ অনুষ্ঠান সংগঠক থেকে শুরু করে উপ-পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মাসিক অগ্রপথিক, ত্রৈমাসিক ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকার সম্পাদনায় এবং দৈনিক দিনকালের সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক যুগভেরিতে কবিতা প্রকাশের পথ ধরে তার লেখালেখির জগতে প্রবেশ। সারা জীবনের সাহিত্য সাধনায় তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো; কবিতা : অস্পষ্ট বন্দর (১৯৯১), ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল (১৯৯৪), চা বারান্দার মুখ (১৯৯৭), সোয়াশ’ কোটি কবর (২০০৩), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০১০), অপার্থিব সফরনামা (২০১১), মাটির ঘটনা (২০১২) এবং কবিতা সমগ্র মুকুল চৌধুরী (২০১৮)। প্রবন্ধ/গবেষণা গ্রন্থ : ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ আফগানিস্তান (১৯৮৩), কবি ও কবিতার প্রতি রসূল (সা.)-এর অনুরাগ ও উৎসাহ (২০০৩), পথিকৃৎ দশ মণীষী (২০০৪), বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৬), আফজাল চৌধুরী : কবি ও কবিতা (২০০৮), কথাশিল্পী শাহেদ আলী : জীবন ও সাহিত্য (২০১৬), তিন কবি : কবিতার অনুধ্যান ও ঐতিহ্য চেতনা (২০১৭) আরও তিন কবি : ঐতিহ্যের মেধাবী উত্তরাধিকার (২০২০), গ্রন্থমুক্ত কথামালা (২০২১)। কিশোরগ্রন্থ : চাঁদের কথা (১৯৯৪), মানুষের চন্দ্র বিজয় (২০০৩), সেই দীপ্ত শপথ (২০০৩), সোনালী বিশ্বাস (২০০৪), ইসলামের প্রথম মিছিল (২০০৪)। সম্পাদিত গ্রন্থ : আমাদের মিলিত সংগ্রাম মওলানা ভাসানীর নাম-(যৌথ) (১৯৮৬), অগ্রপথিক সংকলন : ভাষা আন্দোলন (১৯৯৩), রাসূলের শানে কবিতা (যৌথ) (১৯৯৬), সাহিত্য সংস্কৃতি ও মহানবি (সা.) (২০০৫), মহানবি (সা.)কে নিবেদিত কবিতা (২০০৫), বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে নিবেদিত কবিতা (২০১০) ফররুখ আহমদ সংকলন (১৯৮৭), আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা (১৯৮৩), ঐতিহ্য চিন্তা ও রাসূল প্রশস্তি, কিশোর সাহিত্যে চাঁদের কথা (১৯৯৪), মানুষের চন্দ্রবিজয় (২০০৩), সেই দীপ্ত শপথ (২০০৩) এবং নাত যুগে যুগে। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন রাসূল (সা.)কে নিবেদিত সাহাবি কবিসহ ৪০৫ জন কবির কবিতা সংকলন এবং ভাষা আন্দোলন (১৯৯৩)।
তিনি বি এন এস এ ইংল্যান্ড, বুক অব দি ইয়ার এচিভম্যান্ট এওয়ার্ড পান ১৯৯১ সালে। তিনি বাংলা একাডেমির সদস্য এবং সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আজীবন সদস্য। ২০০৮ সালে সৌদি আরব সফর করেন। সিরাতবিষয়ক একাধিক গ্রন্থ রচনা ও সংকলন প্রকাশে এবং সিরাত সাহিত্যে মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ তাকে ‘সিরাতুন্নবী রৌপ্য পদক-১৪৪২ হিজরি ( ২০২০ ঈসায়ী) তে সম্মানিত করে। ২০২৪ সালে সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রবর্তিত কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম প্রহরে তিনি নিজ জেলা সিলেটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। জাতি কবি মুকুল চৌধুরীকে তার কর্ম গুণে চিরদিন স্মরণে রাখবে।
