
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৮ এএম

শাবিহ মাহমুদ
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
আমরা জানি মহত্বর সাহিত্য শেষ পর্যন্ত জনমানুষের অন্তর্গত অভীপ্সাকে আত্মস্থ করেই এগোয়। তা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সাহিত্যিকরা অতি ব্যক্তিগত ভালো ও মন্দের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এর পেছনে থাকে বৈষয়িক লাভালাভও। রাজশক্তির প্রশংসায় ‘মুখরা’ হওয়া সেসব সাহিত্যিককে ক্ষমতাশক্তি ‘বশীকরণে’র ফাঁদে ফেলে। স্বাভাবিকভাবেই তারাও সে মন্ত্রে প্রভাবিত করতে চান তাদের পাঠককে। সব দেশে সব কালেই এ রকম ঘটনা ঘটে। যদিও এর বাইরে অনেক লেখক ও পাঠক থাকেন সচেতনতার নিরাপদ দূরত্বে।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টালে দেখা যায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক রাজা-বাদশাহ তথা পেট্রনরা যুগে যুগে তাদের মর্জি অনুযায়ী সাহিত্য তৈরি করিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডা. শুশকিং বলেছেন, অতীত যুগের সাহিত্যের ইতিহাস হলো প্রধানত রাজা-রাজড়া ও অভিজাত ‘এ্যারিস্তোক্রাটদের’ কৃপা ও পোষকতার ইতিহাস। বাস্তবিকই সমাজ বলতে রাজা-বাদশাহ, সামন্ত প্রভুদের, জমিদার-জায়গিরদার, আমির-অমাত্যদের সমাজ। আধুনিক যুগে প্রকাশক-পেট্রনে পরিণত হয়েছেন। তখন প্রকাশকরাও নানাভাবে সাহিত্য ও সাহিত্যিকের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বর্তমানে প্রকাশক-পেট্রনের যুগ থেকে আমরা ধীরে ধীরে পাঠক-পেট্রনদের যুগে পৌঁছেছি। এ ধারা বিশ্বসাহিত্যে যেমন, বাংলাসাহিত্যেও তেমন।
এ বিষয়ে দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রাজসভার কবি ও কাব্য’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এতে সভাসাহিত্যের আদিযুগ, বঙ্গের সেন রাজসভার সভাকবি, সুলতানি আমলের পৃষ্ঠপোষকতা, মিথিলা, কুচবিহার, ত্রিপুরা, আরাকান, বিষ্ণুপুর, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান রাজসভার কবিদের কাব্য রচনা ও তৎকালীন সাহিত্য ধারার পরিচয় দিয়েছেন। এ ছাড়া বিনয় ঘোষ ‘জনসভার সাহিত্য’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে রাজসভার সাহিত্য-পেট্রনের যুগ, রাজসভা থেকে জনসভা, জনসভার সাহিত্য, পাঠকের যুগ নামাঙ্কিত শিরোনামের অধ্যায়ে উদাহরণসহ এ ধারার সাহিত্যের বিস্তারিত রূপ উপস্থাপন করেছেন। বিনয় ঘোষ তার আলোচনায় প্রাচীন ও মধ্যযুগকে পেট্রনের যুগ এবং আধুনিক যুগকে প্রকাশক ও পাঠকের যুগ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সামন্ততন্ত্রের যুগ থেকে আধুনিক গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগে উত্তরণকালে প্রকাশক-ব্যবসায়ীরা একটা যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সাহিত্য ও সাহিত্যিককে পেট্রন যুগের অচলায়তন থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর লোকসমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছেন প্রকাশকরা সর্বপ্রথম।’
অবশ্য মনে রাখতে হবে-প্রকাশক তাদের রুচি অনুযায়ী লেখকদের প্রভাবিত ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। এ ছাড়া গুণকীর্তনধর্মী এ জাতের সাহিত্যে প্রশংসার সবটুকুই যে মিথ্যা ছিল-তাও বলা যায় না। ‘ভারতীয় সূতরা (Court singer) অনেকটা পেশাদার স্তাবক ও ক্লাউনের মতন ছিলেন’ মন্তব্য করে বিনয় ঘোষ আরও লিখেছেন, ‘দীর্ঘকাল যে আমরা, সাহিত্যিকরা ও শিল্পীরা, রাজদরবারের বদান্যতার ছায়াতলে মানুষ হয়েছি, তা আজও আমরা ভুলতে পারিনি। টিউটন যুগের সূতরা (Court singer) আজও ‘লরিয়েট কবি’র মধ্যে বেঁচে রয়েছেন। রাজকীয় সম্মান, পদবি ও পুরস্কারে আজও যেসব সাহিত্যিক ও শিল্পীকে ভূষিত করা হয়, তারা তাদের রচিত সাহিত্যে-শিল্পে প্রজার চেয়ে রাজার রুচির খোরাক জোগান বেশি। তর্ক করে একথা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।’
০২.
মহাভারতের যুগে সূত ও মাগধদের পেশাদার স্বতন্ত্রশ্রেণি গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়। তখন পেশা ও বৃত্তিভেদে সামাজিক জাতিবিন্যাস ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত। মহাভারতে বলা হয়েছে, যে ব্রাহ্মণীর গর্ভে ক্ষত্রিয় সন্তানই সূত বলে পরিচিত হবে এবং তার পেশা হবে, রাজরাজড়া ও মহাপুরুষদের কীর্তিগাথা গান করা। বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়দের মিলনে মাগধের জন্ম এবং মাগধের কর্তব্য হলো, উচ্চকণ্ঠে স্তুতিগান গাওয়া। পালযুগে সে বংশের রাজা রামপালের কীর্তিকথাই ‘রামচরিত’ কাব্যে বর্ণনা করেছেন বাঙালি কবি সন্ধ্যাকর নন্দী। রামপাল-পুত্র মদনপালকে কবি বলছেন-হে ভূমিশ্বর (মদনপাল), পণ্ডিত ও বাগবিশারদ, তোমাকে নমস্কার করি; কারণ তুমি শুদ্ধ, মনোজ্ঞ ও বক্রিমকলাবিশিষ্ট এবং শব্দগুণ ও অলংকারে অদ্ভুত আমার এই প্রশংসিত রত্ন (কাব্য) তুমি কর্ণভূষণ করেছ। দেখা যাচ্ছে, কীর্তনে কবি আত্মমহিমা প্রচারেও পিছপা হয়নি।
সেন যুগেও সে ধারা চলমান ছিল। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেব মিশ্র, ধোয়ী, উমাপতি ধর, গোবর্ধন আচার্য প্রভৃতি বিখ্যাত ছিলেন। মূলত রাজার চিত্তবিনোদনের জন্য তারা তাদের কাব্যপ্রতিভা উৎসর্গ করেছেন বলে জানা যায়। জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের রাজসভার কালিদাস। জনশ্রুতি ছিল-তিনি গীতগোবিন্দের সুললিত পদ গাইতেন, আর পদ্মাবতী নাকি তালে তালে নাচতেন। অপর কবি ধোয়ীকে লক্ষ্মণসেন ‘কবিক্ষ্নাপতি’ বা কবিরাজ উপাধি দিয়েছিলেন। পুরস্কারস্বরূপ ও প্রতীকরূপে দিয়েছিলেন স্বর্ণাভরণমণ্ডিত হস্তিব্যূহ ও হেমদণ্ডযুক্ত দুই চামর। (জনসভার সাহিত্য, বিনয় ঘোষ)।
তবে মনে রাখতে হবে, হিন্দু রাজাদের অত্যাচারে সমতল থেকে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া বৌদ্ধ কবিদের রচিত প্রাপ্ত (এ যাবৎ) বাংলাভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’র গীতগুলোয় তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, তারা সে সময়ের রাজশক্তির প্রশংসা থেকে দূরে ছিলেন। এরপর পাঠান ও মোগল যুগে মুসলমান শাসনকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল, তা সবারই জানা। কবি কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বর জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-১৪৩১ খ্রি.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ‘রামায়ণ’-রচনা করেন। কাব্যখানি মহাকবি বাল্মিকীর সংস্কৃত ‘রামায়ণ’-এর ভাবানুবাদ। কবি বৃহস্পতি মিশ্রের মনীষা সুলতান জালালউদদীনের কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল।
শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় সিংহাসন অধিকার করেন। ষোলো শতকেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। হোসেন শাহের কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন কবি-পণ্ডিত সনাতন, রূপ, কেশব খান ছত্রী, রামচন্দ্র খাঁ, যশোরাজ খাঁ প্রমুখ। ‘মনসা মঙ্গল’-এর রচয়িতা বিজয় গুপ্ত ও বিপ্রদাস সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের প্রশস্তি রচনা করেছেন। ‘মহাভারত’ অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বরও সুলতান হোসেন শাহের প্রশংসা করেছেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর চট্টগ্রামের প্রতিনিধি পরাগল খানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ‘মহাভারত’-এর অনুবাদ করেন। জানা যায়, হোসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহের অনুগত ছিলেন ‘কবিশেখর’ উপাধিধারী দেবকীনন্দন সিংহ। নসরৎ শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ শ্রীধর ব্রাহ্মণকে দিয়ে ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য’ রচনা করেছিলেন। হোসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগলখান এবং তার পুত্র ছুটি খানও বাঙালি কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৬ ও ১৭ শতকের মুসলিম কবিদের কাব্যাদি আলোচনা করলে দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে রোমান্টিক ও অধ্যাত্ম প্রণয়কাহিনি। মুসলমান পূর্বযুগে বাংলাসাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের শুদ্ধসাধন পদ্ধতির কথা ও লৌকিক দেবদেবীদের ক্রিয়াকলাপ। কবিরা দেবদেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে থাকতেন, মানবীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনার কথা তাদের চিন্তায়ই আসেনি। তাদের কাছে সাহিত্যচর্চা মানেই ছিল ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা। কিন্তু মুসলিম কবিরা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কেবল ধর্মকেই প্রাধান্য দিলেন না, তারা মানবীয় কাহিনি নিয়েও সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন।
ড. এনামুল হকের মতে, বাংলাসাহিত্যে মানবীয় রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান ধারার পথিকৃৎ শাহ মুহম্মদ সগীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষী মুসলমানদের দেশি ভাষার সাহায্যে মুসলিম প্রণয়োপখ্যানে সিক্ত করা এবং বাস্তবতাবর্জিত পুঁথিসাহিত্য থেকে পাঠককে প্রকৃত সাহিত্য রসে ফিরিয়ে আনা। পরবর্তীকালে সে ধারায় অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। আর ১৭ শতকে আরাকান রাজ সাদ উমাদার (থদো মন্তির)-এর রাজত্বকালে তার প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে থেকে মহাকবি আলাওল তার অমর কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেছিলেন।
০৩.
উনিশ শতকের শুরুতে বঙ্গদেশে দুটি গুরুত্ববহ ঘটনা ঘটে। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয় এবং ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরির শ্রীরামপুর পদার্পণে ব্যাপটিস্ট মিশনের পত্তন হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেসব ইংরেজ সিভিলিয়ানকে এ দেশে পাঠাত, তাদের সর্বাগ্রে এ দেশীয় ভাষা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করত। ফলে উপর্যুক্ত কলেজের বিভিন্ন বিভাগে পণ্ডিত-মৌলবি নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি এ দেশি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ আরম্ভ হয়। ১৮১৯ সালে, ‘সমাচার দর্পণ’-এর সংবাদে উল্লেখ, ‘গত দশ বৎসরের মধ্যে আন্দাজ দশ হাজার পুস্তক ছাপা হইয়াছে।’ এতে বোঝা যায়, এরই মধ্যে কয়েক লাখ কপি মুদ্রিত বই বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজসভা থেকে বাংলা সাহিত্য জনসভামুখী হয়েছে। প্রচলিত অর্থে বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাঁ শুরু হয়ে যায় এসব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। একদিকে ধর্মসভার সংগঠকরা এবং অপরদিকে রামমোহন রায় ও হিন্দু কলেজের ডিরোজিওর ছাত্ররা, ইয়ং ক্যালকাটা বা ইয়ং বেঙ্গল দল এ আন্দোলন শুরু করেন। এসব ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত বইপত্র-পত্রিকা উভয় দলের নেতারা বিনামূল্যেও বিতরণ করেছেন।
তবে যতই জনমুখীনতার কথা বলা হোক না কেন, আগের পেট্রনযুগীয় স্বভাব লেখকদের পুরোপরি ছাড়েনি। নিচে আধুনিককালের সেসব কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই। রাজশক্তি বা ক্ষমতাশক্তি থেকে লেখকদের একটি অংশ বরাবরই ছিলেন আগ্রহী। জানা যায়, বাংলাদেশে প্রকাশকরা যখন আবির্ভূত হলেন, তখন তারা মধ্যযুগের পেট্রনের মতো পোষকতার ও দয়াদাক্ষিণ্যের মনোভাব নিয়ে এলেন; আধুনিক যুগের ‘এন্টারপ্রেনোর’ বা উদ্যোগী ব্যবসায়ীরূপে এলেন না। ‘জনসভার সাহিত্য’ গ্রন্থে উল্লেখ :
“মাইকেল মধুসূদন তার ‘ক্যাপটিভ লেডি’ প্রথমে জে আর নেলার নামে একজন প্রবাসী বন্ধুকে উৎসর্গ করেন, কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় মাদ্রাজের অ্যাডভোকেট-জেনারেল জর্জ নর্টনের নামে উৎসর্গপত্র লিখে দেন। পোষক ও পোষকতার সঙ্গে সাহিত্যিকের জীবনের যোগাযোগ কি রকম, তা বুঝতে হলে বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকে যে রকম সাহায্য পাওয়া যায়, এ রকম আর কিছু থেকে পাওয়া যায় না। মধুসূদন বন্ধুর বদলে পেট্রন নর্টনকে বই উৎসর্গ করেছিলেন।... ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ, ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক ও তার ইংরেজি অনুবাদ পাইকপাড়ার রাজাদের অর্থেই অনূদিত, রচিত ও মুদ্রিত হয়েছিল। পাইকপাড়ার ছোটরাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের অনুরোধেই তিনি ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে প্রহসন দুটি রচনা করেছিলেন এবং ১৮৬০ সালে রাজাদের ব্যয়ে বই দুটি প্রকাশিত হয়েছিল। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহকে তিনি বইগুলো উৎসর্গও করেছিলেন।” আরও জানা যায়, মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’-গ্রন্থটি ১৮৬০ সালে কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রথম সংস্করণ মুদ্রণের ব্যয়ভার বহন করায় তাকে ‘তিলোত্তমা-সম্ভব কাব্যে’র নিজ হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি উপহার দেন ও বইটি উৎসর্গ করেন। সমালোচকদের মতে, বাংলাদেশে বই প্রকাশের স্বাধীন ব্যবসার অবস্থা যে ১৮৬০-৭০ সাল পর্যন্ত কী ছিল, তা মধুসূদনের সাহিত্য জীবনের এ রাজপোষকতা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
রাজশক্তির আনুকূল্যের আরেকটি দৃষ্টান্ত এবার। ১৮৭৫ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার প্রথম পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলসখ্যাত অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড ভারতে আসেন। প্রিন্সের কলকাতায় আগমন উপলক্ষ্যে বাংলার বেশ কয়েকজন কবি প্রিন্সকে নিয়ে প্রশস্তি রচনা করেন। এর মধ্যে ছিলেন দেশের দুই শীর্ষকবি-হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেন। প্রিন্সকে স্তুতি করে হেমচন্দ্র লেখেন ‘ভারত-ভিক্ষা’ এবং নবীনচন্দ্র লেখেন ‘ভারত-উচ্ছ্বাস’ কবিতা। বলা প্রয়োজন, ব্রিটিশ উপনিবেশের দংশনে তখন ভারত-স্বাধীনের আকাঙ্ক্ষায় উদ্ভাসিত ও জর্জরিত। রেনেসাঁ যুগের এমন মুহূর্তে-যখন বাংলার লেখকরা চাইছেন স্বাধীনতা। নবীনচন্দ্রের ওই কবিতায় ছিল পরাধিনতার অন্তর্জ্বালা। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয়, তিনিই ‘ভারত-উচ্ছ্বাস’ কবিতায় প্রিন্সকে লিখছেন, ‘তোমার সাহিত্য, তোমার সঙ্গীত/তোমারই শিল্প, তোমারই আচার,/তব সভ্যতায়, ভারত প্লাবিত...’। এ কবিতার শেষ স্তবকের [২৫ সংখ্যক] শেষ শেষ চার পঙ্ক্তিতে কবি বলছেন, “যুবরাজ। যবে মাতৃসিংহাসনে/উজ্জ্বলিবে, যথা ওই শশধর;/স্মৃতিতে বিহ্বল, শুনিবে তখন,/“জয় ‘এডোয়ার্ড’ ভারত-ঈশ্বর”।” এ কবিতা লিখে নবীনচন্দ্র সেন পঞ্চাশ গিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন। [নবীনচন্দ্র সেন : চিন্তা দর্শন]
এমত বিষয়ে আমাদের সাহিত্যে আলোচনা-সমালোচনা অনেক রয়েছে। গত শতকের আটের দশকে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক থাকাকালে তৎকালীন স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদের কবিতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছিলেন। বিবিসি নিউজ বাংলা ১৪ জুলাই ২০১৯-এ ‘আপনার কবিতা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কি কোনো নির্দেশ আছে?’ শিরোনামের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বাসসের কূটনৈতিক সংবাদদাতা জাহাঙ্গীর হোসেন সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কী কোনো নির্দেশ জারি করা হয়েছে?’ বিব্রত এরশাদ বলেছিলেন, ‘আপনি যদি চান, আর ছাপা হবে না।’ জানা যায়, এ প্রশ্ন করায় তিনি পরে এরশাদের রোষের শিকার হয়েছিলেন। একটি গুজব ছিল, জেনারেল এরশাদের নামে ছাপা হওয়া এসব কবিতা লিখে দিতেন নামকরা কজন কবি।
ক্ষমতাকে প্রধান নিয়ামক মনে করে সাহিত্য অঙ্গনে আছড়েপড়া লেখকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল সব সময়ই। এভাবে ক্ষমতাশক্তির কাছে পদানত হয়ে সাহিত্যকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন কিছু লেখক; তেমনি কেউ কেউ বিবেকের কথাকে শুনেছেন হৃদয় দিয়ে।