
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৯ পিএম

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
তার জীবনের শেষ কয়েক দশকে দেশপ্রেম আর মানবতা বহুরূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবারই তিনি দেশপ্রেম আর মানবতাকে আরও উঁচুতে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না-তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক, একজন রক্ষক। সত্যের রাজ্যে একজন বীর, যার লড়াই শুধু নিজের মাতৃভূমিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অন্যদের জন্যও বিস্তৃত ছিল। তিনি শহিদ হয়েছিলেন সেই সাম্রাজ্যের হাতে, যে তার উত্তরাধিকারকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, তার নামকে বিস্মৃতির ছায়ায় দাফন করতে চেয়েছিল। ইরানি এ বীরের নাম-জেনারেল কাসেম সোলাইমানি; এমন এক যোদ্ধা, যার নাম বহু দেশে পরিচিত, যাকে একজন আন্তর্জাতিক বীর হিসাবে সম্মান জানানো হয়। বিশিষ্ট রুশ লেখক ও প্রযোজক ওলেগ রয় এ মহান ব্যক্তিত্বকে অমর করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- একজন মানুষ, যার উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গতিপথকে রূপ দিয়েছে। রয়ের উপন্যাস ‘জ্যাকেল’স ক্যান’নট ডিফিট আ লায়ন’-এর পাতায় পাতায় জেনারেল সোলাইমানির কাহিনি উঠে এসেছে কেবল যুদ্ধ ও প্রতিরোধের উপাখ্যান হিসাবে নয়, বরং মানুষের গভির আত্মা, অটল নিষ্ঠা, এবং সীমানা ছাড়িয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া ত্যাগের এক অনন্য প্রমাণ হিসাবে। অনেক বই যেখানে কাসেম সোলাইমানিকে কেবল ঐতিহাসিক দলিল বা ব্যক্তিগত জীবনী আকারে তুলে ধরে, সেখানে এ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে রচিত। এটি একটি সাহিত্যিক উপন্যাস-প্রতীক ও গল্পকথার বুননে গঠিত-যা জেনারেল সোলাইমানির জীবনকে এক গভীর ও ব্যতিক্রমী উপায়ে উপস্থাপন করেছে। ২৮৫ পৃষ্ঠার এ বইটিতে জেনারেল কাসেম সোলেইমানির কৈশোর থেকে শাহাদাত পর্যন্ত সময়গুলোর আকর্ষণীয় বর্ণনা রয়েছে। এ বইয়ের লেখক ওলেগ রয় ৯০টিরও বেশি উপন্যাস লিখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ লেখক তার বই প্রকাশের দিক থেকে রাশিয়ার শীর্ষ পাঁচের মধ্যে রয়েছেন এবং কথাসাহিত্য লেখকদের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন। তেহরান টাইমস ‘জ্যাকেল’স ক্যান’নট ডিফিট আ লায়ন’ উপন্যাসটি নিয়ে ওলেগ রয়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে। রয়ের সেই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন
এ উপন্যাসের গল্প কোথা থেকে শুরু হয়েছে?
: ‘জ্যাকেল’স ক্যান’নট ডিফিট আ লায়ন’ উপন্যাসের গল্প দুটি ভিন্ন সময়রেখা অনুসরণ করে- একটি বর্তমান সময়ে এবং একটি অতীতে। বর্তমান সময়ে, একজন আমেরিকান লেখিকা মার্গারিটা ভালডেনস্টেইন ইরানে আসেন জেনারেল সোলাইমানিকে সমালোচনামূলকভাবে নিয়ে একটি বই লেখার উদ্দেশ্যে। এ প্রক্রিয়ায় তিনি বুঝতে পারেন, বাস্তবতা তার পূর্ব ধারণার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সোলাইমানির ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে জানার পর মার্গারিটার দৃষ্টিভঙ্গিতে একেবারে আমূল পরিবর্তন ঘটে।
আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো সোলাইমানির জীবনী, যা তার ঘনিষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রিজমের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। এটি পাঠককে তার চরিত্র ও অভিজ্ঞতাগুলো আরও ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ দেয়-তাদের চোখ দিয়ে, যারা তার পাশে ছিলেন, যারা তার আপনজন ছিলেন।
উপন্যাসের মূল চরিত্র কারা এবং এ উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
: বইটির প্রধান চরিত্রদের মধ্যে রয়েছেন মার্গারিটা ভালডেনস্টেইন এবং ফেরেশতে কেরমানি-বেতানি যিনি ইরানের একজন পুলিশ অফিসার, যে তার বড় পরিবার নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কঠিন সময় পার করেছেন। এ ছাড়া ইরানি জনগণকেও বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এটা বলাই বাহুল্য যে পুরো গল্পটি কাসেম সোলেইমানিকে কেন্দ্র করেই রচিত।
আর কি আমাকে এ উপন্যাস লিখতে অনুপ্রাণীত করেছে? অবশ্যই দুটি বড় অপরাধ যা দুবছরের ব্যবধানে সংঘটিত হয়েছিল-কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ড এবং তার মৃত্যুর দ্বিতীয় বার্ষিকীতে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল এ বিষয়টি যে, সেই সন্ত্রাসী ঘটনার শিকার ছিল সাধারণ মানুষ যারা কাসেম সোলেইমানিকে শ্রদ্ধা জানাতে তার কবরের কাছে গিয়েছিল-তারা স্বেচ্ছায় এসেছিল, পুরো পরিবার নিয়ে।
এটাই প্রকৃত ভালোবাসা-এমন এক ভালোবাসা, যা এক মুহূর্তের অসহায় রাগে সন্ত্রাসের মাধ্যমে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল। অবশ্যই, আমি আগে থেকেই তার সম্পর্কে কিছুটা জানতাম, কিন্তু এ ঘটনার পর আমি সত্যিই অনুভব করলাম, প্রতিটি যুগে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম এবং তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা উচিত।
উপন্যাসটি কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে। একজন রুশ লেখক হিসেবে, এ ঘটনাটি আপনার লেখায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণ কী ছিল?
: ইরানিদের কাসেমের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা (এগুলো খালি কথার ফুলঝুরি নয়; এটি বাস্তবতা) এবং এ ভালোবাসার সামনে পশ্চিমাদের অসহায় রাগের মধ্যকার বিপরীতধর্মী চিত্র আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল- রাশিয়া ও ইরানের মানুষ, যদিও ধর্ম ও ইতিহাসগত দিক থেকে ভিন্ন, তবু আত্মিকভাবে অনেক কাছাকাছি। আমাদের মধ্যেও রয়েছে আমাদের বীরদের সম্মান জানানোর ঐতিহ্য। আমাদের ‘অমর রেজিমেন্ট’ যা শুধু পূর্ব পুরুষদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং প্রজন্মগত ধারাবাহিকতার একটি ভিত্তি। ঠিক তেমনি, ইরানিদেরও রয়েছে তাদের নিজস্ব ‘অমর রেজিমেন্ট।’
উপন্যাসটি কীভাবে রাশিয়া ও ইরানের আত্মিক ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরে?
: আসলে, আমি ইরানিদের সঙ্গে আমাদের বহু সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছি এবং যত গভীরভাবে লেখার মধ্যে প্রবেশ করেছি, ততই আমি বুঝতে পেরেছি যে, রাশিয়ান ও ইরানিয়ানরা আত্মিকভাবে খুব কাছাকাছি। আমি কাসেম ও আমাদের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের বর্ণনা খুব সাহসিকতার সঙ্গে দিয়েছি (এই সাক্ষাৎ সত্যিই হয়েছিল, যদিও এর বিস্তারিত তথ্য গোপন রাখা হয়) এবং এ অধ্যায়টিই আমাদের জনগণের আত্মিক ঘনিষ্ঠতার মূল সারমর্ম।
আপনি কীভাবে উপন্যাসে বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিদের চিত্রায়ণের জন্য গবেষণার প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেছেন?
: আমার ইরানি বন্ধুদের কাছ থেকে আমি অনেক সাহায্য পেয়েছি। তারা এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছে, যারা কাসেমকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং অনেক নথি সরবরাহ করেছেন-এর মধ্যে কিছু আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, বাস্তবের জীবিত বা মৃত ব্যক্তিদের কোনো বইয়ের নায়ক হিসাবে চিত্রায়ণ করা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। এ কারণেই বইয়ের প্রধান চরিত্রগুলো (ফেরেশতে ও তার পরিবার) এবং কিছু প্রতিপক্ষ চরিত্র আসলে বিভিন্ন মানুষের গঠিত সংমিশ্রিত রূপ। তবে বইয়ের কয়েকটি চরিত্র বাস্তব-এমন ব্যক্তিত্ব, যাদের উল্লেখ এড়ানো সম্ভব ছিল না।
সংবেদনশীল উৎসগুলোর প্রতি সম্মান বজায় রেখে আপনি কীভাবে ইতিহাসের যথার্থতা নিশ্চিত করেছেন?
: আমি যতটা সম্ভব কাসেমের প্রকৃত জীবনী অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি-কোনো রকম রূপান্তর বা বিকৃতি ছাড়াই-তার প্রতি এবং যারা তাদের স্মৃতিগুলো আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন, তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে। কিছু উৎস বর্তমানে প্রকাশযোগ্য নয়-যেমন, ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বা ইরান-ইরাক যুদ্ধে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জড়িত থাকার বিষয়টি। তবে আমি একথা বলতে পারি : উপযুক্ত যোগ্যতা-সম্পন্ন স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মতে, উপন্যাসে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তা বাস্তবতার সবচেয়ে কাছাকাছি। যেমন এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, ইতিহাস গণিতের মতো; যে কোনো সমীকরণ অন্য সমীকরণের মাধ্যমে যাচাই করা যায়, আর যদি ওই সিস্টেমের একটি সমাধান থাকে, তবে বোঝা যায় সমীকরণটি ভুল ছাড়াই গঠিত হয়েছে।
আপনি আপনার মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির চিত্রায়ণের মাধ্যমে আপনার দেশের পাঠকদের কী বার্তা দিতে চান?
: একজন বিখ্যাত ব্যক্তি একবার বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য হলো মানবতার ‘সূর্যকোষ’। এটি তিনটি প্রধান বিশ্বধর্মের জন্মভূমি এবং বহু দেশের ভূরাজনৈতিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে, তার প্রভাব সারা বিশ্বের ওপর পড়ে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি নয়, বরং আরেকটি বিষয়। আমরা বর্তমানে ইরানের সঙ্গে খুব ভালো, পারস্পরিকভাবে উপকারী সম্পর্ক গড়ে তুলছি। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। আমি চাই এ ধরনের সম্পর্ক-শুধু ইরানের সঙ্গে নয়, বরং অন্যান্য মহান সভ্যতার সঙ্গেও দীর্ঘমেয়াদে গড়ে উঠুক। ইরানের জনগণের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল রয়েছে, ইতিহাসের দিক থেকে এবং মানসিকতার দিক থেকেও। তদুপরি, ইরানিদের জাতীয় চরিত্র সম্মানযোগ্য এবং তাদের অনেক গুণকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি-যেমন, সব বিষয়ে তাদের আন্তরিকতা। অবশ্যই আমি চাই আমাদের মধ্যে শক্তিশালী, ফলপ্রসূ এবং প্রকৃত ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এর ভিত্তি হওয়া উচিত আমাদের জনগণের পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
আমি চাই পাঠকরাও এ সাদৃশ্য, এ আত্মিক ঘনিষ্ঠতাকে উপলব্ধি করুক, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের দুই জাতির মধ্যে এক আন্তরিক ও স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে।
যদি জেনারেল সোলেইমানিকে একটি বাক্যে বর্ণনা করতে হয়?
: কাসেম সোলেইমানি ছিলেন একজন বীর, একজন মহান যোদ্ধা এবং তার ধর্ম, মাতৃভূমি ও জনগণের রক্ষক। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন স্নেহশীল পুত্র, ভাই এবং পিতা-এ দিকগুলো একে অপর থেকে আলাদা করা যায় না।
আমার বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দিই : ‘তুমি বলছ কাসেম তোমার জন্য কোনো আদর্শ নন, কোনো বড় ভাই নন-তাহলে কে? এ ভালোবাসা কোথা থেকে আসে? একজন রাজনীতিবিদকে ভালোবাসা যায় হয় ভয়ে, নয় মূর্তির মতো দূরত্বে রেখে-তিনি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকেন।’
‘কাসেম এমন ছিলেন না,’ ফারেশতে ধীরে বলল। ‘এইটাই বিষয়-তিনি কখনো দূরে ছিলেন না। তুমি হয়তো তাকে ‘বড় দাবার ছক’-এ এক বিশাল চরিত্র হিসাবে দেখ, একটি প্রতীক বা এক কার্যকরী রূপ হিসাবে দেখ, কিন্তু আমাদের জন্য তিনি একজন পিতা।’ কাসেম সোলেইমানি ছিলেন এক অসাধারণ সাহস ও ভালোবাসার মানুষ। তার হৃদয় ছিল এত বড়, যা পুরো ইরানকে ধারণ করত। যিনি বহু বছর ধরে তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তিনি আমাকে এ কথা বলেছিলেন। এবং সত্যি বলতে, সোলেইমানি সম্পর্কে এ কথাগুলোই আমার সবচেয়ে বেশি মনে থাকে।
সূত্র : তেহরান টাইমস