
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৯ পিএম

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
জন্মগতভাবে শিমুলের ডান পা ছিল বাম পায়ের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি ছোট। হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়ে কোনো মাংস ছিল না। উটের মতো চিকন পায়ের হাড় পাতলা চামড়া দিয়ে আবৃত। শিমুলের ডান পায়ে শক্তি ছিল না বললেই চলে। হাঁটার সময় সে প্রথমে বাম পা সামনের দিকে এগিয়ে নিত। তারপর ডান পা ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে আসত সামনের দিকে। অসম পা দুটোর জন্য তার সমতল পথ চলাও ছিল বন্ধুর প্রকৃতির। শিমুলের প্রতি পদক্ষেপ দেখে মনে হতো সে কোনো উঁচু ঠিলা থেকে নিচের দিকে নামছে। হাঁটার সময় ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠত তার সারা দেহ। তনুর ভারসাম্য রক্ষা করতে তাকে চলতে হতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
শিমুলের ডান হাত ছিল তরুলতার মতো চিকন। হাতের হাড় ধনুকের মতো বাঁকা। কব্জি অস্বাভাবিক রকমের শক্ত। সহজে নড়াতে-চড়াতে পারত না। আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বাম হাত ভালো থাকলেও শিমুল কাজ করত ডান হাত দিয়ে। মুখের বাম পাশের চোয়াল বাঁকা ছিল ডান দিক পর্যন্ত। স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারত না সে। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে তার অধিকাংশ কথায় বুঝা যেত না। ঠোঁট দুটো মোটা হওয়ায় সব সময় হাঁ করে থাকত কার্গো মাছের মতো। কথা বলার সময় ডান দিকের নিচের ঠোঁটের কিনারা বেয়ে লালা বের হয়ে গাল পর্যন্ত চলে আসত। শিমুল সন্তর্পণে তা ডান কাঁধের শার্টে মুছে নিত। মুখের লালায় ডান কাঁধের শার্টের অংশ থাকত ভেজা। এমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তোয়াক্কা করেনি শিমুল। প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করে সে ভর্তি হয়েছিল স্বপ্নপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরিচিতি ক্লাসে আমার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধুত্বসুলভ আচরণে আমি প্রথম দিন থেকেই মুগ্ধ ছিলাম। দিনে দিনে তার সঙ্গে আমার সখ্য বাড়তে থাকে। ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে শিমুল অনেক প্রিয় ছিল। হাসি মুখে কথা বলে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। ক্লাস শুরুর আগে আমরা প্রায়শই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতাম। শিমুল আসতে দেরি হলে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম তার জন্য। শিমুল ছাড়া আমাদের আড্ডা ভালোভাবে জমে উঠত না। হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠীদের মধ্যে কেউ কেউ বলে উঠত, এই যে শিমুল আসছে।
আমরা সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। শিমুল বইগুলো বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে তার নিজের ভঙ্গিতে হাসিমুখে শ্রেণিকক্ষের দিকে এগিয়ে আসত। বিশেষ সমস্যা ছাড়া সে ঝড়-বৃষ্টির দিনেও উপস্থিত থাকত স্কুলে। আমাদের স্কুলের মূল ভবনটা ছিল সমতল মাঠ থেকে একটু উঁচুতে। তিনটা সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে মেঝেতে উঠতে হতো। আমরা চোখের পলকেই উঠে যেতাম। অথচ এ সিঁড়িগুলো বেয়ে উঠতে শিমুলের অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু শিমুল কোনোদিন কারও সাহায্য নিত না। কেউ এগিয়ে গেলে সে হাসিমুখে তা প্রত্যাখ্যান করে বলত, আমার পক্ষে মাউন্ট এভারেস্ট বিজয় করা সম্ভব নয়। এটা জয় করত সুযোগ দাও।
আমরা তার কথা শুনে চুপ হয়ে যেতাম। শিমুল সিঁড়ির ধাপগুলো পার হয়ে হাঁপিয়ে যেত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলত, যুদ্ধটা আমার একা। দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে স্কুলে আসতে হয়। এখানে এসে কারও সহযোগিতা নিলে নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলব। সারা জীবন আমার এভাবেই চলতে হবে।
আমাদের মনে শিমুলের এসব কথা তীরের মতো বিদ্ধ হতো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সবাই দলবেঁধে ক্লাসে ঢুকে যেতাম।
শিমুল অধিকাংশ সময় বসত প্রথম বেঞ্চে। আমরা ক্লাসে অনেক সময় অমনোযোগী ছিলাম। শিমুলের মধ্যে কখনো তা লক্ষ করিনি। প্রতিটি ক্লাস করত সে অনেক আগ্রহ নিয়ে। ক্লাস শিক্ষক ব্ল্যাক বোর্ডে কিছু লিখলে আমরা মন চাইলে লিখতাম। না চাইলে খাতা আঁকাআঁকি করে লেখার অভিনয় করে ক্লাসের সময় পার করে দিতাম। কালো বোর্ডে সাদা চক দিয়ে স্যারের লেখা প্রতিটি শব্দ শিমুল লেখার চেষ্টা করত। প্রথমদিকে শিমুল যখন লিখত আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। লেখার জন্য কত কষ্ট করত শিমুল। তার অচল ডান হাতকে সচল করার দৃশ্য বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতাম। স্যার চক নিয়ে বোর্ডে কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিমুলের প্রস্তুতি শুরু হতো। ঝুলে থাকা বিকলাঙ্গ ডান হাতকে সে বাম হাত দিয়ে ধরে খাতার ওপর রাখত। তারপর বৃদ্ধ আঙুলের মাঝে কলম মুষ্টিবব্ধ করে ধরে লেখা শুরু করত শিমুল। লেখার সময় তার মাথা ঝুঁকে থাকতে ডান কাঁধের দিকে। মুখে অদ্ভুদ রকমের অঙ্গভঙ্গি করতে করতে লিখে যেত শিমুল। এভাবে লিখতে গিয়ে অনেক সময় তার মুখ থেকে টুপ করে লালা পড়ে ভিজে যেত নিউজ প্রিন্টের খাতা।
একদিন স্কুল ছুটির পর শিমুল আমাকে নিয়ে স্কুলের মাঠে গিয়ে বসল আমাকে কিছু বলার জন্য। আমি আগ্রহ নিয়ে তার মুখ পানে চেয়ে রইলাম।
শিমুল বলল, আমি প্রায়ই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। গতকাল রাতে দেখলাম আমি সুস্থ হয়ে গেছি। আমার ডান পা অন্যদের মতো স্বাভাবিক। হাত দুটো ঠিকঠাক। মুখের বাঁকাটাও নেই। আনন্দে বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়াচ্ছি। আমার পরিচিতরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ বলাবলি করছিল শিমুল ভালো হয়ে গেছে। আমি দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি। গিয়ে থামলাম স্বপ্নপুর বাজারের খেলার মাঠে। তখন মাঠে ফুটবল খেলার প্রস্তুতি চলছিল। আমি গিয়ে বললাম আমাকে খেলায় নিতে।
আমাদের ক্লাসের সিহাবও ছিল সেখানে। সে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল, কিরে তুই ভালো হয়ে গেলি কেমনে?
অন্যরাও চিনত আমাকে। তারাও আমাকে ঘিরে ধরল। ঘটনা কী বল।
আমি বললাম, স্বপ্ন থেকে উঠে দেখি সুস্থ হয়ে গেছি। এক দৌড়ে চলে এলাম।
সিহাব হাসি দিয়ে বলল, গাঁজাখোরি গল্প বাদ দে। নিশ্চয়ই ভালো চিকিৎসা করিয়েছিস। ঘটনা যাই হোক। তোকে সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। চল খেলা শুরু করি।
খেলা শুরু হলো। আমি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে বল লাথি দিলাম।
তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেলে। স্বপ্নে অচল পা দিয়ে লাথি দিয়েছি টেবিলে। শিমুল তার প্যান্ট হাঁটুর ওপরে তুল আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দেখাল।
দুই.
প্রায় দেড় যুগ পর হঠাৎ সেদিন ভোরে শিমুলের ফোন। অপরিচিত নম্বর দেখে ঘুমের ঘোরে বেশ কয়েকবার ফোন কেটে দিলাম। পরে কল ব্যাক করি।
পরিচয় জানতে চাইলে ওপাশ থেকে হেসে বলে, আমি শিমুল।
আমার চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে শিমুলের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হয়নি।
আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম কোন শিমুল?
আমি তোমার প্রতিবন্ধী বন্ধু শিমুল।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
কেমন আছ বন্ধু? আমার ফোন নম্বর পেলে কোথায়?
শিমুল বলল, আমাদের ক্লাসের বাদলের কাছ থেকে নিয়েছি।
অনেকক্ষণ কথার পর শিমুল বলল, বন্ধু গতকাল রাতে আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছি।
আমি জানতে চাইলাম কোনটা?
শিমুল বলল, ওই যে আমি স্বপ্নে দেখি ভালো হয়ে গেছি।
শিমুল হাসি দিয়ে বলল, বন্ধু এবারের স্বপ্নটা দারুণ ছিল। আমি এবার দেখলাম তুমি আমাকে ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছ। তারপর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি।
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তখন শিমুল বলল, বন্ধু সবাই এত স্বপ্ন পূরণের কথা বলে। আমার স্বপ্নটা পূর্ণ করবে কে?