
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৮ এএম

মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁস বলতে বোঝায় প্রাচীন যুগের গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ভাস্কর্যকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করা এবং এসবের ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করা। অর্থাৎ আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সামাজিক জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, তাকেই বলা হয় রেনেসাঁস। এটি ভারতবর্ষ তথা বাংলাকেও প্রভাবিত করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলার জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও শিল্প সংস্কৃতিতে যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা-ই সাধারণভাবে বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলন নামে পরিচিত। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, চিরবৈধব্য, পণপ্রথা, অবরোধ প্রথা, কৌলিন্য প্রথা, বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্যতার ছুঁতমার্গ, দাসপ্রথা, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন, মুমূর্ষু ব্যক্তিকে গঙ্গায় ডুবিয়ে মারা ইত্যাদি কুপ্রথা সমাজ জীবনকে কলুষিত করে ফেলেছিল। এসব নির্মূল করার আন্দোলনই ছিল বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলন। এ আন্দোলনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই স্যার আশুতোষ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সুনীতি ভূষণ কানুনগো’র নিবেদন ‘বাংলায় রেনেসাঁস আন্দোলন’।
প্রাক রেনেসাঁস যুগে সমাজ ছিল স্থবির প্রতিষ্ঠান। কুপ্রথা, কুসংস্কারে সমগ্র দেশ নিমজ্জিত ছিল। সমাজের মানুষ এগুলোকে আঁকড়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই সমাজের কুপ্রথা ও কুসংস্কার নির্মূল করার আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন ছিল একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা।
এ বইটিতে লেখক দেখিয়েছেন, রেনেসাঁস আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এমনকি সামাজিক আন্দোলনও নয়, এটি একান্তভাবেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই মূলত রেনেসাঁস-আন্দোলনের ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করা যায়। এর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকলেও সেটা মুখ্যভাবে নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার রাজনৈতিক গগন ছিল ঘোর তমাচ্ছন্ন। ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, লুঠতরাজ ইত্যাদি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রেনেসাঁস যুগের সমাজ-সংস্কারকরা সমাজে প্রচলিত কুপ্রথাগুলোর মূলোচ্ছেদ করতে সম্পূর্ণ সফল হন।
রেনেসাঁসের আগে বাংলা ভাষা অপরিণত অবস্থায় ছিল। শব্দচয়ন ও বাক্যগঠন-প্রণালি ব্যাপারে ভাষারীতি অনুসরণ করা হতো না। অফিস আদালতের ভাষা ছিল ফারসি তাই হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষ সবাইকে ফারসি শিখতে হতো। ফলে বাংলা ভাষা কোনো মহলেরই পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন’ মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করা হয়। এ সময়ে বহুসংখ্যক সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। সমাজ সংস্কারের জন্য গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংঘ ও সমিতি। রেনেসাঁসের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বিদেশি ভাষার প্রতি অনুরাগ। দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ভাষার প্রচলন হয় এবং এর দ্রুত বিস্তার ঘটে। এ দেশের বিশেষ করে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বহু ইংরেজি-বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এসব বিদ্যালয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় স্থাপিত হতো এবং প্রতিষ্ঠাতা নিজেই বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন।
অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ কানুনগো’ তার ‘বাংলায় রেনেসাঁস আন্দোলন’ বইয়ে স্থবির বাংলার গতিশীলতার আন্দোলন রেনেসাঁসকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি রেনেসাঁস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমকালীন মনীষী, কবি, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারকদের সংক্ষিপ্ত তালিকা ও তাদের অবদান কালানুসারে সন্নিবেশ করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁস ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গৌরবময় ঘটনা। বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলন বাংলার অগ্রসরতার নব দিক উন্মোচন করেছে।