
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:২৫ এএম

অপূর্ব চৌধুরী
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
জীবন, বিশেষ করে মানুষের জীবন, একইভাবে সরল এবং জটিল। বাইরে থেকে যতটা সরল, ভেতরে তার চেয়ে জটিল। জীবনের সরলতা না হয় বাদ দিলাম। জীবনের জটিলতাগুলো কী কী তাহলে! জীবন জটিলতার অনেক প্রশ্নের একটি হলো-বুদ্ধিমত্তা। বুদ্ধিমত্তা কী তাহলে?
বুদ্ধিমত্তা কী জ্ঞান, নাকি একটি বিশেষ গুণ বা ক্ষমতা!
বুদ্ধিমত্তা হলো চিন্তা, বোঝার ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধান করার এক ধরনে দক্ষতা। শুধু বইয়ের জ্ঞান বুদ্ধিমত্তা নয়। বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় প্রকাশ পায় বুদ্ধিমত্তায়। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি দ্রুত শেখেন, তাড়াতাড়ি ধরতে পারেন, নতুন তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বুদ্ধিমত্তার মধ্যে থাকে যুক্তি, বুদ্ধিমত্তায় থাকে সৃজনশীলতা, অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা এবং অন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়া।
মোটা দাগে বুদ্ধিমত্তা দুভাবে প্রকাশ পায়। একটি হলো যুক্তিগত বুদ্ধিমত্তা (IQ)। এমন বুদ্ধিমত্তায় গণনা, বিশ্লেষণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বোঝায়। আরেকটি হলো মানসিক বা সামাজিক বুদ্ধিমত্তা (EQ)। নিজেকে এবং অন্যদের আবেগ বুঝে সম্পর্ক গঠনের দক্ষতায় এমন বুদ্ধিমত্তা কাজ করে।
বুদ্ধিমত্তার এমন সরল পাঠে মনে হয় বুদ্ধিমত্তা তাহলে এত জটিল কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে কি আসলেই তাই!
এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষ হাজার বছরের ইতিহাস, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য এবং সমাজতত্ত্বের সহায়তা নিয়েছে।
বাহ্যিক সাফল্য, সম্পদ বা সামাজিক মর্যাদাই কি প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার কিংবা বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি! নাকি প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা আরও অনেক বেশি গভীর।
বুদ্ধিমত্তা মানুষের অভ্যন্তরীণ একটি শক্তি। বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা সমাজকে পাঠ করি, জীবনকে পাঠ করি; সে জীবনের অনিশ্চয়তা, পরিবর্তন এবং প্রতিকূলতা মোকাবিলা করি।
একটু পেছন দিকে যাই। প্রাচীন দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক চিন্তাধারা পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তার ধারণা অনেকবার বদলেছে। প্লেটোর ‘গুহার রূপকথা’ তত্ত্ব বুদ্ধিমত্তা তত্ত্বের অন্যতম একটি। বাস্তবতার অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্লেটো দেখান যে-আমরা যা কিছু দেখি বা যা কিছু উপলব্ধি করি, তা কেবল বাস্তবতার ছায়া মাত্র, প্রকৃত বাস্তবতা নয়। আমাদের সত্যিকারের বুঝটুকু তৈরি করতে হলে এ ছায়ার বাইরে গিয়ে আসল সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আর এটাই মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা তার ক্ষমতা।
প্লেটোর মতো স্টোইক দার্শনিকরা বুদ্ধিমত্তার গভীর অর্থ সম্পর্কে ভিন্নভাবে আলোচনা করেছেন। স্টোইক ফিলোসফার সেনেকা জীবন এবং বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘জীবনের অর্থ বোঝা হলো নিজের সঙ্গে সৎ থাকা এবং প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নেওয়া।’ স্টোইকরা বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা হলো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এবং জীবনের পথে স্থির থাকা। এ ক্ষমতা ধীরে ধীরে অর্জিত হয়।
আরেক স্টোইক দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস বুদ্ধিমত্তার অনুসন্ধানে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য এবং স্থিতিশীলতার কথা বলেছেন। তার লেখা ‘মেডিটেশনস’ আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে জীবনযাপন করতে হয় কেমন করে, পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া দরকার কেন এবং প্রতিকূলতাকে নীতির সঙ্গে অতিক্রম করতে হয় কীভাবে। এমন ভারসাম্যটাই মার্কাসের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমত্তা।
প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা তাই জ্ঞানী হওয়ার চেয়ে অধিক কিছু। বুদ্ধিমত্তা তার চারপাশের অতিরিক্ত থেকে অপরিহার্যকে আলাদা করার ক্ষমতা রাখে, অস্থায়ী বিষয়ে আটকে না থেকে চিরন্তন সত্যকে গ্রহণ করার সাহস দেখায় সে। ইমানুয়েল কান্টের ‘নীতিশাস্ত্রের দর্শন’ আরও এক ধাপ এগিয়ে দেখায় যে, প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা কেবল জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে। তার মতে, ‘বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত পরীক্ষা হলো, এটি নৈতিক চিন্তা এবং কর্মের মাধ্যমে কীভাবে প্রকাশিত হয়।’
মনোবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড গার্ডনারের বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব বুদ্ধিমত্তার ধারণাকে একেবারে নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। গার্ডনার বলেন যে, মানুষ কেবল একটি নির্দিষ্ট ধরনের বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল নয়। তার মতে বুদ্ধিমত্তা অন্তত আটটি ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়, যেমন-ভাষাগত, গাণিতিক, স্থানিক, সংগীতময়, শারীরিক, আন্তঃব্যক্তিক, অন্তঃব্যক্তিক এবং প্রাকৃতিক। তার এই তত্ত্ব মতে-প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব ক্ষমতার মাধ্যমে বিশেষ কিছু করতে পারে। একজন সংগীতজ্ঞ যেমন সুরের মধ্যে গভীরতা খুঁজে পান, তেমনি একজন দার্শনিক নিজের চিন্তার মধ্য দিয়ে সত্যের সন্ধান করেন।
ড্যানিয়েল গলম্যানের ‘আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব’ একটু অন্যভাবে বলেন যে, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও বুদ্ধিমত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গলম্যানের চিন্তাধারা হলো, ‘সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষ কেবল নিজের আবেগ বুঝতে সক্ষম নয়, সে তা অন্যের জন্যও ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারে।’
মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স বুদ্ধিমত্তা প্রসঙ্গে আত্ম-বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। তার মতে, একজন ব্যক্তি যখন সত্যিকারের নিজের প্রতি সৎ থাকে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে নিজের বিকাশের পথ হিসাবে গ্রহণ করে, তখনই সে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার শীর্ষে পৌঁছায়।
সামাজিক প্রাণী হিসাবে মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। পিয়েরে বোর্দিউ তার সাংস্কৃতিক মূলধনের তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, বুদ্ধিমত্তা কেবল জ্ঞানের পরিমাপ নয়; এটি সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতির ওপরও নির্ভরশীল। তার মতে, ‘বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত মূল্য বোঝা যায় তখনই, যখন একজন মানুষ নিজস্ব সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে।’ সমাজের অনেক রীতি কখনো কখনো অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা হলো সেই রীতিগুলোকে বোঝা এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক সাহস থাকা।
সমাজতাত্ত্বিক এরিক ফ্রম এ ব্যাপারে বলেন যে, বুদ্ধিমত্তা মানে কেবল মানিয়ে নেওয়া নয়। প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করা। তার বই ‘ম্যান ফর হিমসেলফ’ আমাদের শেখায়, ‘যদি একজন ব্যক্তি তার মানবতার প্রতি সত্য থাকে, তবে সে সমাজের রীতিনীতি অতিক্রম করেও সাফল্য অর্জন করতে পারে।’
ইতিহাসে দেখা যায় প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা আসলে এক ধরনের অভিযোজন যোগ্যতা। রেনেসাঁ যুগের উত্থানে ইউরোপের মানুষ পুরোনো বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন চিন্তার পথ খুঁজে পেয়েছিল। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এবং গ্যালিলিওদের মতো মানুষদের অবদান মানব সভ্যতাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের বুদ্ধিমত্তা সময়ের সেই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে পেরেছিল।
অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে আমরা দেখি যে, কীভাবে নৈতিক বুদ্ধিমত্তা একটি জাতিকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। গান্ধীর নেতৃত্বে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার এবং মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
সাহিত্য আমাদের জীবন এবং বুদ্ধিমত্তার অন্য আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। ভিক্টর হুগোর ‘লেস মিজারেবলস’ বা দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’-এর মতো ক্লাসিক সাহিত্যে দেখা যায় যে, মানুষের নৈতিক সংগ্রাম এবং আত্ম-উন্নতির মধ্য দিয়ে বুদ্ধিমত্তার আসল রূপ ফুটে ওঠে। শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ পড়লে বুঝতে পারি মানুষের চিন্তার গভীরতা কেবল সমস্যার সমাধান নয়, বরং আত্মার গভীর সংগ্রামেরও প্রতিফলন।
আজকের যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজতর করেছে। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের মনোযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড্যানিয়েল কানেম্যান তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বর্তমান যুগে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বই ‘থিংকিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ বুদ্ধিমত্তার দুটি দিকের কথা বলে-একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং অন্যটি চিন্তাশীল বিশ্লেষণ।
আমাদের বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত পরীক্ষা হয় তখন, যখন আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গভীর বিশ্লেষণের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারি।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত লক্ষণ হলো কল্পনার ক্ষমতা।’ এ কল্পনা শুধু সৃজনশীলতার পথ দেখায় না, এটি অনিশ্চয়তার মধ্যেও নিশ্চয়তা তৈরি করে।
প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা কোনো বাহ্যিক অলংকার নয়; এটি মানুষের অন্তর্গত শক্তি। বুদ্ধিমত্তা কেবল জ্ঞান বা তথ্যের ভান্ডার নয়, এটি সেই ক্ষমতা, যা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। বুদ্ধিমত্তা আমাদের শেখায় কীভাবে প্রতিকূলতার মুখেও স্থিতিশীল থাকা যায়। কীভাবে জীবনের জটিলতাকে চিন্তাশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়।
প্লেটো, কান্ট কিংবা গান্ধীর দর্শন থেকে শুরু করে গার্ডনার এবং গলম্যানের তত্ত্ব পর্যন্ত, সবাই এ একটি সত্যের প্রতি একমত: প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা জীবনের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে, সেগুলোকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং আত্মার গভীরতায় আলোকিত হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
‘প্রতিদিন মানুষের জীবনে কিছু না কিছু অন্ধকার আসবেই, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যিনি তার অন্তরের আলো জ্বালিয়ে অন্ধকারকে তুচ্ছ করতে জানেন।’