
প্রিন্ট: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৬ পিএম

অহিদুজ্জামান মোস্তফা
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
বিল্লাল কাকুর মরার খবর শুনে আমরা মামাবাড়ি থেকে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। কথাটা যেন দুবছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরা শোরোর মেয়ের কবর থেকে উঠে আসা বা এখনো সে বেঁচে আছে-এমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। মা, ছোট দুই বোনসহ আমরা সবাই যেন দৌড়াতে শুরু করেছি। বিল্লাল কাকু অন্য সবার চেয়ে একেবারে আলাদা ছিল। কী যত্ন করত আমাদের। বাজার থেকে রাতে ফেরার সময় সে কখনো চকলেট, কখনো লজেন্স নিয়ে আসত। আমরা পুকুরে গোসল করতে গেলে বড়রা আমাদের পুকুর থেকে উঠিয়ে দিতে চাইলে কাকু বলত-না ওরা থাক। আমরা কাকুর কাছ থেকে লাই পেয়ে পেয়ে আরও বেশি করে পানি ঘোলাতে থাকতাম। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল না হলে আমরা পুকুর থেকে উঠতাম না। গলায় গলায় ভরে উঠেছে সব পুকুর। নতুন পানি আকাশ থেকে পড়েই পুকুরগুলো পোয়াতি নারীর মতো পেট পুরে আছে। আমাদের সব স্মৃতির মাঠে বিল্লার কাকুর অবাধ চলাফেরা আজ থেকে বন্ধ হবে, সেটা কীভাবে সম্ভব!
ওই তো কাকু সাইকেল চড়ে আসছে। আমাদের যাকে পাবে, তাকে সেখান থেকে সে সাইকেলে চড়িয়ে আনবে। যখন বিলে যাবে-চল আমার সঙ্গে। পাকা খেজুর পেড়ে খাওয়াব। পাকা-পাকা জাম হলে কে আমাদের জাম পেড়ে খাওয়াবে? কার সঙ্গে কালীবাড়ির মাঠে খেলা দেখতে যাব? বিকালে গরুর ঘাস না কেটে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে মায়ের হাতের মার থেকে কে আমাকে আগলে রাখবে? কাকু একবার এখান থেকে গেলে কি আর ফেরা যায় না? যায়। নিশ্চয় যায়। যাবে না কেন? আমি তো শুনিছি মানুষ মরে গেলে সে আবার পাখি হয়ে পৃথিবীতে আসে। যারা পাপকাজ করে, তারা বাদুড়, চামচিকা ইত্যাদি হয়ে যায়। আর যে নারীরা সুন্দরী থাকে, তারা প্রজাপতি আর ময়ূর হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কাকু তুমি কাক কিংবা ফিঙে হবা না, তুমি হবা মাছরাঙা না হয় টুনটুনি বা কোকিলও হতে পার। কারণ, বসন্তে যে কোকিল ডাকে, তারা ডেকে ডেকে সঙ্গীকে কাছে পেতে চায়। কাকুর সঙ্গে বনে গিয়ে বুজফল খাওয়া কি আর সম্ভব? যদি শ্যাওড়া গাছে ভূত থাকে? কে তবে আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে? খুব সকালে কার সঙ্গে পাকা তাল খুটতে যাব? এসব স্মৃতি আমার বুকের মাঝে খলসে মাছের মতো খলবল করে ওঠে। আর শোল মাছের মতো হৃদয়ের পাড়ে এসে গুঁতো মারে।
দুই. বাড়ির সামনে শতশত মানুষের ভিড়। দূরে একটা পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। শালার এ দেশের পুলিশগুলো সারা বছর কোথায় থাকে? যখনই গ্রামে কোনো মানুষ বিষ বা গলায় দড়ি দিয়ে মরে, তখনই তারা দেবদূতের মতো হাজির হয়। এর আগে গ্রামে চোর-ডাকাতে মানুষ খেয়ে ফেললেও তাদের ছায়া খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আবার মরা মানুষ নিয়ে তাদের ব্যবসাও বেশ রমরমা। লাশ ঘর থেকে মর্গে যাওয়ার আগেই তাদের পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হয়। না হলে লাশের শরীরের সেলাইয়ের পরিধি বেড়ে যায়। একে তো মরা মানুষ, তার ওপর জখম! এটা নাকি ময়নাতদন্তের জন্য খুব দরকার! আমার মাথায় আসে না কেন এ কামে রাষ্ট্রের এত মাথাব্যথা! বেঁচে থাকতে যারা তদারকি পর্যন্ত করতে পারে না, তারা আবার মরার পর দায়িত্ব দেখায়। হায় সরকার তামাশা, হায় আইন তামাশা-সবকিছুতে শুধু প্রতারণা আর প্রতারণা।
যে কলপাড়ে দাঁড়িয়ে কাকু বিষ খেয়েছে, সেখানে রাতের রান্নাবান্নার তাবৎ হাঁড়িকুড়ি ময়লা অবস্থায় পড়ে আছে। তরকাড়ির হাঁড়িতে মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছে একটা সাদা-কালো বিড়াল। বালতিতে কাকু বিষ খাওয়ার আগে বোধহয় লুঙ্গি আর গামছা ভিজিয়েছিল। বালতির পানিটা কাপড়ের ময়লা খেয়ে খানিকটা ভারী হয়ে আছে। একজন মানুষ যখন মরে যায়, তখন কি তার সব মালামাল আমাদের অদরকারি হয়ে পড়ে? না তা হবে কেন? অনেক কিছু তো নড়ে-চড়ে ওঠে! তার হাঁটা, কথা বলা, হাসি-সব তো অবিকল থাকে।
উঠানের মাঝখানে একটা বেতের পাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিল্লাল কাকু। গায়ের ওপর ময়লা একটা কাথা দিয়ে মুখ অবধি ঢেকে দেওয়া। পেছনের দিকে পা দুটো বের হয়ে এ সমাজের মুখে একটা ভেংচিকাটা লাথি দেখিয়ে দিচ্ছে। মুড়ানো মুখের ওপর কয়েকটা মাছি এলোমেলোভাবে উড়াউড়ি করছে। হাত দুটো বুকের ওপর অসহায় ভঙ্গিতে পড়ে আছে। সে হাত আর কখনো আমাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেবে না। কাকুর মাথা বরাবর রান্নাঘরের দরজার একটা পাল্লা ভেড়ানো, আরেকটা খোলা। ইচ্ছামতো বাড়ির পোষা কুকুরটা ঢুকছে আর বের হচ্ছে। তার পেটে খুব ক্ষুধা! হাঁস-মুরগিগুলো সারা উঠানে প্যাঁচপুজ করে মল ত্যাগ করছে। কাকুর একমাত্র ফুপু মাছনা, খানপুর থেকে বিল্লাল বিল্লাল করতে করতে বাড়ির ভেতর ঢুকল। সে এসেই কাকুর বডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজন পুরুষলোক তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সে তার ভাই-ভাবিকে গালিগালাজ করতে থাকে। ‘মল্লোতো ছাবালডা, এবার তোরা জম্মের মতো সুকে থাকিস!’ তার কথাগুলো যেন বাতাসের সঙ্গে বাঁশির মতো বিঁধে যাচ্ছে খোলা আকাশের কানে। যদিও মনোহরনগর গ্রামে প্রতিমাসে একজন না একজন বিষ, তুতে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে মরে।
কাকু আর কখনো আমাকে বলবে না-‘এই বেটা তুই তো বড় হয়ে গেলি! তোরে বিয়ে দেব আমি, বুঝলি? আর আমিও গাল ভাঙ্গিয়ে বলতাম-এ্যাঁ..., নিজের বিয়ের গন্দবাতাস নেই, যতসব নঙ্গনসেল্লা দেখ। আর আমি কি একটা বিয়ে করব। বিয়ে করব তিনডে। কাকু, এই কাকু, আমার একটা বউ হবে ধবধবে সাদা, একটা কুচকুচে কালো আর একটা পাকা মরিচের মতো টুকটুকে। কাকু আমার কানে কানে বলত, তোর একটা কাকি আছে কিন্তু। নিয়ে আসব তাড়াতাড়ি। শুনে আমি মাকে সে কথা চালান করে দিই। মা কাকুকে নাকি বলেছে, এই বিল্লাল ভাই-তোমার কি কোনো পছন্দের মেয়ে আছে? তুমি নাকি তহিদরে কইছো তোর একটা কাকি আছে। এ কথাগুলো আমার মাথার ভেতরে দাসের মতো ভোঁ ভোঁ করছে। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। বেলা ১১টার মতো বাজে। ঘি ঢালা রোদে আমার শরীর থেকে নোনতা ধরনের স্যালাইন বের হয়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে ইংলিশ প্যান্ট। আমি কাকুর লাশের পাশে বসে থাকার মতো ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। এক দৌড়ে বানশালার কুটোর ঘরে গিয়ে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে থাকি।
তিন. কলপাড়ে এখনো কাকুর খাওয়া নারিকেলকুড়া দিয়ে আলোচাইলের ক্ষীর আর পাকা কাঁঠালের কোয়া পড়ে আছে। বিষ খেয়ে যখন বমি করছিল, সেসময় এগুলো কাকুর মুখ দিয়ে বের হয়। খানিক পরে নাকি নাকমুখ দিয়ে শুধু সাদা সাদা গ্যাজা বের হয়েছে। দাদির কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। বাড়িতে আস্তে আস্তে মহিলা ও শিশুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় পুরুষের হট্টগোল। দাদা এখনো বারান্দায় বসে আছে। কিছু টাকার বিনিময়ে পুলিশ আর কাকুকে থানায় নেয়নি। আশপাশের মহিলারা বিভিন্ন রকমের কথা চালাচালি করছে। তাদের ভেতর, কলকানদার সিরাজ কাকার মা মুখে করুণ একটা দৃশ্য নিয়ে বলে ওঠে-‘আরে মরবে নাতো কী করবে! বিষ খাওয়ার পরেও যদি নিজের মাতে কই তুই এখনো মল্লিনে। বিষ খাইছির তো মরার জন্যি! পিরো চাচার বউ খালা গলা লম্বা করে বলে ওঠে শুধু কি তাই। ‘তার মা কয়েছে তোর মতো ছাবাল মরে গিলি আমি কানবো না বলে দা দিয়ে ছাবালডার পিঠির উপর আচ্ছা মতো বাড়োইছে।
সঙ্গে সঙ্গে হাত ঝাঁকিয়ে সম্পদের মা বলে-ওরে বাবারে কি পাষাণ মা, ডাক্তার পর্যন্ত ডাকতি দিনি! ওকি মা, নাকি ডাইনি? তাদের সবার কথার সারসংক্ষেপ এরকম দাঁড়ায়-ছেলেটা কি এমন অন্যায় করেছে। বয়স হয়েছে বলেই তো বিয়ে করেছে। তাই না? তা তোরা কেমন বাপ-মা যে ছেলের বিয়ে দেওয়ার নামগন্ধ নিস না। চুরি করে কি ছেলেরা স্বাদে বিয়ে করে? পাশে থাকা সিন্টুর মা চাচি বলে-তা মেয়েটা কি খারাপ? কত সুন্দর। হলদির মতোন শরীর। কী লম্বা লম্বা চুল। দূবল ঘাসের মতো নরম। মুখের ওপর বড় বড় ডাগর চোখ। মফি ভাইয়ের মা মানে মসলেম চাচার বউ বলে-বাবারে বাবা যেমন বাপ তেমন মা! কেউ ছেলেডারে ম্যানে নিলো না। গেছে তো যমের বাড়ি! এখন তোমারা তোমাদের মান-সম্মান নিয়ে থাকো! তাকিয়ে দেখি আমার দাদি রুমিচা বেগমের দুচোখ দিয়ে হড়হড় করে জল পড়ছে। আর মুখে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের মতো অসহায় ছায়া নেমে আসে। ভাবা যায়! মানুষ অন্তত একটা জিনিসে মুক্তি পায়। সেটা হলো মরণ!
চার. এক সপ্তাহ আগে কাকু বাড়িতে একটা মেয়েকে নিয়ে আসে। বাড়িতে বাপ-মার ভয়ে ছোট বাবু মানে বজলু দাদার ঘরে তোলে। আমরা ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন অন্য দাদারা বসে একটা শলাপরামর্শও করেছে। কিন্তু কিছুতেই জাহাতাপ দাদার মন গলাতে পারিনি। এমনকি দাদির মনও না। তাদের এককথা-এ বউকে আমরা মানি না। কোথা থেকে কোন পথের মেয়েকে নিয়ে এসেছে তার ঠিক নাই। ছোট লোকের ঘরের এ মেয়েকে আমাদের ঘরের বউ করা সম্ভব না! বিল্লাল কাকার তিন বোন। তিনটাই তাদের বাপ-মার দলে। কাকু বাদে আরও তিনটা ভাই। তারাও বাপ-মার গলায় গলা মিলিয়ে কথা বলে। কেউ তার পক্ষে নাই। তাদের বাড়ি ছাড়া সারা গ্রামের মানুষ কাকুর পক্ষে। ছেলে মরলে তাদের দুঃখ নেই; কিন্তু বংশের মান তাদের রাখতেই হবে।
একদিন সকালে দাদা উঠানের মাঝখানে একটা চেয়ারে বসা। এমন সময় বজলু দাদা বিল্লাল কাকুকে বলে-‘যা তোর আব্বার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নে।’ সবাই খুব ভয়ে ভয়ে আছে। ভেবেছিলেন রাগ কমলে মেনে নেবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে যেমনি কাকু দাদার পা ধরেছে, সঙ্গে সঙ্গে পা ছাড়িয়ে নিয়ে ধপাধপ বিল্লাল কাকুর মাথায়, পিঠে যাচ্ছেতাই ভাবে লাথি মারতে শুরু করে। এক নাগাড়ে মারতে থাকলে কাকু উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কেউ ঠেকাতে সাহস পায় না। মরে গেল বলে, আমি কাকুর গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার চিৎকার-চ্যাঁচামেচিতে বাড়ির অন্য মহিলাসহ আমার মা এগিয়ে আসে। সরদার গুষ্টিতে শ্বশুরদের মুখের ওপর কথা বলার সাহস একমাত্র আমার মায়ের আছে। কারণ, যে সাহস তা নয়। সবাই মাকে খুব ভালোবাসে। মায়ের বিবেক-বুদ্ধিতে সবাই মুগ্ধ। আমার মা, কাকুকে উঠাতে গেলে বিল্লাল কাকুর মা এক দৌড়ে বারান্দা থেকে লাফিয়ে এসে জোর গলায় বলে- ‘যাও, যাও আমার ছাবালরে তোমরা নিয়ে যাও। ছাবালডারে তোমারাই তো নষ্ট করিছ। এখন আবার ঠেকাতে আইছ।’
আমার মায়ের সঙ্গে যোগ হয় আমার দাদি রুমিচা বেগমের গলা। ‘তা তোমার কি ছ্যামড়াডারে বাঁচতে দিবা বিল্লালের মা? মারো, তোমাদের ছাবাল তোমারা মাল্লি আমাদের কী? কিন্তু শুনে রাহো জীবনে তো কম ছাবালমায়ে মানুষ কল্লাম না, তো তোমার মতো মা আমি জীবনে দেহিনি। এত জল্লাদ নারী আল্লায় যেন দুচোহে না দেহায়।’ চুলার আগুনে পানি দিলে যেমন ছপ করে নিভে যায়। বিল্লাল কাকুর মার গলা তেমনি বসে যায়। দাদা এখনো চেয়ারে বসে আছে। দাদাকে এখনো বাঘের মতো ফুঁসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। মা তবুও কারও দিকে না তাকিয়ে কাকুকে ধরে আস্তে আস্তে বজলু দাদার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। ওপরে জামরুল গাছ। বেশ জামরুল ধরেছে। সাদা সাদা ফলে গাছটার আগা-মাথা ভরে আছে। এ গাছের তলায় কাকুর দাদা আইনুদ্দিন সরদারের মাটি দেওয়া। কবরের ওপর জামরুলের বড় বড় পাতাগুলো শুকিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দূর থেকে কোঁকড়ানো এক একটা পাতাকে এক একটা কবর বলে ভ্রম হয়। গাছ থেকে সদ্য ফুল থেকে ফল হয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। অবুঝ কিছু পোলাপানে সেগুলো খুঁটে খুঁটে পায়জামায় মুছে মুখে চালান করে দিচ্ছে। আর পুরা উঠানজুড়ে বরইপাতার মিছিল। এরা কি আগে থেকেই মানুষ মরার খবর পায়! না হলে এভাবে ঝরবে কেন? উঠানের আশপাশে তিনটা বরই গাছ। লাল-হলুদ বরইগুলোয় নানারকম পাখিরা এসে আয়োজন করে ঠোঁট বুলিয়ে যাচ্ছে। পোকা ধরা আর বেশি পাকা কুলগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওই তো বিল্লাল কাকা ঝরে পড়া বরই কুড়িয়ে বলছে-এই বেটা এই নে বরই। কী টকরে বাবা। এত টক বরই কীভাবে যে খাস তুই! আমার সঙ্গে আরও যারা বরই খুঁটতে যেত, তারা আমার ওপর রাগ করত। তাদের অভিযোগ ছিল কাকু তো শুধু তোরে বরই দে। আমাদের কি দেয়। আমরা আর তোর সঙ্গে বরই খুঁটতি যাবো না! এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। আমার মন ভিজে ওঠে। শরীরের লোমগুলো উজান দিয়ে উঠে। শীত শীত লাগে। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। নিজে হেরে যাওয়ার চেয়ে কাউকে হারানোর বেদনা যে অনেক বেশি, তা আমার মর্মে মর্মে উপলব্ধি হচ্ছে। মৃত্যুকে মেনে নিতে হয় কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু যে উপহাসের ডানা মেলে হাসতে থাকে। সেসব সামলানোর ক্ষমতা কি সবার থাকে?
পাঁচ. দাদা যে চাকরিটা করে তাতে তাদের নয়জনের সংসার ভালোভাবে চলে না। দাদার যে সম্পত্তি আছে, তাতে সারা বছরে যা ধান পায়, তা দিয়ে ছয় মাসের খরচ চলে। বাকি ছয় মাস তাদের কিনে খেতে হয়। বাধ্য হয়ে তাই বিল্লাল কাকু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামে। তা না হলে টেনে পড়া আলমগীর, এইটে পড়া রবিউল, সিক্সে পড়া ইরানি ও নূরানি, থ্রিতে পড়া খুরশিদ আর ওয়ানে পড়া মিনির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। না আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না-এমনটাই ভেবেছিলেন বিল্লাল কাকু। তা না হলে কে ছেড়ে দেয় নিজের পড়াশোনা। তাছাড়া কাকুই সবার বড়। সংসারের যারা বড় হয়, তাদের যেন শুধু দিয়ে যেতে হয়। কেউ তাদের কথা ভাবে না। সবাই তার কাছে আবদার করে। কেউ ভাবে না সে যে কারও কাছে আবদার করতে পারে! অবশ্যই বিল্লার কাকুর লেখাপড়া করার মতো মাথা ছিল, সে গল্প আমি কোনোকালে শুনিনি। আবার একেবারে যে হগা ছিল, সেটাও শোনা যায় না। বাড়ির পাশে সীমান্ত বর্ডার। সেজন্য আমাদের এলাকায় অনেক মানুষ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেউ এক বস্তা চিনি এনে পুরো এক সপ্তাহ পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে খায়। আনিছের খালু মানে সাজ্জাদ ভাইয়ের বাপ তো সারা জীবন এভাবে পার করে দিল। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে শোনা যেত তার সাইকেলসহ চিনির বস্তা খোয়া গেছে। মানে বিডিআরে ধরে ফেলেছে। পাচারের মাল বলে কথা। আনিছের আব্বাও কয়েকদিন গিয়ে ধরা খেল। আর যায়নি সেদিকে। আসলে রিস্ক না নিলে গেম দেওয়া যায় না পৃথিবীর কোনোখানে। কেউ কেউ শুধু দুই বস্তা লবণ নিয়ে আসে। কিন্তু বিল্লাল কাকা তা কিছুদিন করে আর করল না। কাকু বলল, এটা যে গুরুতর অন্যায়। এভাবে চুরি করে মাল নিয়ে আসব, আবার পুলিশে ধরা খেলে চালান-পুঁজি সব শেষ। এ ঘটনা হওয়ার পর থেকে কাকুর প্রতি আমার বেশ দরদ জমে গিয়েছিল। তাকে আর যাই মনি করি না কেন, সে আমার কাছে একজন সত্যিকারের খাঁটি নায়ক বনে গেল।
বৃষ্টি হলেই আমি আর কাকু কীভাবে ঘুঁনি দিয়ে মাছ মারা যাবে, সে ফন্দি এঁটে মাছ ধরতাম। এত কষ্ট করে মানুষটা কীভাবে এত মজা করতে পারত, তা আমার ছোট মাথায় ঢুকত না। সারা দিন পোলাপানের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করে কাকু বিকিয়ে দিত কত বিকাল। এ দিকে খুব রসিক মানুষ হিসাবে খ্যাত কসিম দাদা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বলত-কীরে, মধুর বড় ছেলে কি বাড়ি আছে? সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন একটা অলৌকিক আওয়াজ আসত-‘দাদা আমি তো তোমার বাজার করা থলের ভেতর!’ কছিম দাদা হাসতে হাসতে বলে-‘দেখিছো ও মাঝে (মেঝো) বউমা, তোমার ছেলের কাণ্ড। কত বড় পোঙ্গা-পাকা ছেলে তোমার! শালার সাথে আমি পারি না! যাক, নসিম মরে গেলেও দুঃখ নেই। তুই তো আসিছ। আমার নামটা বাঁচায় রাখিস দাদা! নিজের লেখাপড়া শিকেয় তুলে কাকু পুরা সংসারে হাল ধরল। বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মাইল সাইকেল চালিয়ে কাকু কখনো আটার-ময়দা আবার কখনো কাঁচামালের ব্যবসা করত। কী কষ্ট করত কাকু। কাকুর লাশের পাশে বসে আমার এসব ছবি যখন মনে পড়ে, তখন নিজেকে আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। নিজেকেও কাকুর সঙ্গে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
ছয়. কাকুর কবর দেওয়া হলো সন্ধ্যার আগে। বাড়িতে মহিলাদের কান্নার শব্দে আকাশটা যেন ছোট হয়ে এলো। বিকালটা যেন কাকুর শোকে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামিয়ে দিল। সূর্যটাও আর মুখ দেখাল না। আমি কাঁদতে কাঁদতে দুপুরে খেতে পারিনি। যদিও পড়শিরা কেউ কেউ জোর সেধেছিল। আমি তাদের বেশ গালাগালি করলে সবাই যার যার মতো কেটে পড়ে। কাকুকে ছাড়া প্রথম সন্ধ্যায় আমি কিছুতেই কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। কতকাল এভাবে কেটে গেল জানি না। আমি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন জাহাতাপ দাদা রাতের বেলায় স্বপ্নে দেখে খুব জোরে চিৎকার করে ওঠে। আশপাশের সবাই ছুটে চলে আসে। আমি ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে এক দৌড়ে দাদার খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। কারও কোনো কথার উত্তর দেন না। রাতের নীরবতা ভেঙে দাদা বলতে শুরু করে-‘ওরে আমার বি..ল..লা..ল রে তুই কোথায় গেলি? তুই আমারে নিয়ে যা বাবা! এসব বলতে বলতে দাদা মহিলাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।