
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৯ এএম

দুলাল মাহমুদ
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
চারপাশের শোভায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে গড়ে ওঠা ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য পাহাড়ের সারি। নানা উচ্চতার। নানা অবয়বের। সব লেগে আছে গায়ে গায়ে। তার মাঝে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট ওপরে চন্দ্রগিরি পাহাড় থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে দেখা যায় কাঠমান্ডু উপত্যকার প্যানারমিক ভিউ। কেবল কারের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে যে রিসোর্টে এসেছি, তার নান্দনিক সৌন্দর্য চমৎকার। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য কোনো কমতি রাখা হয়নি। এত দুর্গম এলাকায় কীভাবে এমন একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিলাম।
এমন সময় কারও মিষ্টি কণ্ঠস্বরে খানিকটা চমকে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, শ্বেতকায় এক নারী হাসিমুখে মোবাইল ফোন হাতে ফটো তুলে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুবই ক্যাজুয়াল সাজগোজ। হালকা নীল জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে সাদা টপস। পায়ে কেডস। ছেঁটে দেওয়া খোলা চুল নেমে এসেছে কাঁধে। আলগা কোনো ঠাটবাট নেই। মুখের গড়নে পাশ্চাত্যের প্রভাব থাকলেও পূর্বদেশীয় একটা ছাপ আছে। ভাসা ভাসা গভীর কালো চোখ। স্বপ্নমাখা। বয়স ত্রিশের এপাশ-ওপাশ হতে পারে। এ নারী আমার অপরিচিত নয়। এআইপিএস এশিয়ার কংগ্রেসে যোগদানের জন্য যারা কাঠমান্ডুতে এসেছে, সে তাদের একজন। একই হোটেলেই অবস্থান। দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কথা হয়নি। দুজনের স্বভাবের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে অনেকটা অভিন্নতা। চুপচাপ ধরনের। মেলামেশায় সাবলীল নয়। কোলাহল থেকে দূরে থাকাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। মেলামেশা না করে একজন নারীকে কতটাই আর চেনা যায়। প্রাথমিকভাবে একজন মানুষের স্বভাবগত কিছু বিশেষত্ব এমনিতেই ফুটে উঠে তার চেহারায়। একাধিকবার দেখা হলে আরও বেশি করে বুঝতে পারা যায়। দীর্ঘ সময় সম্মেলনের বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিয়েছি। কাছাকাছি বসে খাওয়াদাওয়া করেছি। কখনো সখনো চলাফেরা একই মাইক্রোবাসে। নিভৃত স্বভাবের লোকেরা সাধারণত বিচরণ করে কল্পলোকে। মনে মনে হিসাব মেলানোর চেষ্টা থেমে থাকে না। তার মনমেজাজ খানিকটা হলেও বুঝেছি। সেও হয়তো আমার সম্পর্কে ধারণা করে নিয়েছে। তার নাম যেহেতু জানা নেই, আপাতত তাকে চন্দ্রিমা নামে সম্বোধন করলে কেউ নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না।
সাইটসিয়িংয়ের অংশ হিসাবে এআইপিএস এশিয়ার ডেলিগেটদের নিয়ে যাওয়া হয় চন্দ্রগিরি পাহাড়ের রিসোর্টে। আশপাশটা প্রাকৃতিক রহস্য দিয়ে মোড়ানো। অফিশিয়াল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে অনেকেই তুলতে থাকে বিভিন্ন স্টাইলের ছবি। মোবাইল ফোনও ব্যতিব্যস্ত। চন্দ্রিমাকে ছবি তোলার ব্যাপারে নিরাসক্ত মনে হয়েছে। এখন নিজ থেকেই ছবি তুলতে চাইছে! এ মুহূর্তের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তার মনে হয়তো দোলা দিয়েছে। নিঃসীম ঝকঝকে নীল আকাশ। ভেসে চলছে সাদা সাদা কারুকাজ করা মেঘ। একটু নেমে এলেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়। হাজার হাজার মাইল নিচে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বিন্দুর মতো ঘন জনবসতি। রিসোর্টের সুইমিংপুলটি পাহাড়ের কিনারঘেঁষে এমনভাবে নির্মাণ করা, তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুইদিকে মেলে দিলে মনে হয় উড়ন্ত মানব। দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে চন্দ্রিমার একের পর এক ছবি তুলতে থাকি। ফটোগ্রাফিতে মোটেও সিদ্ধহস্ত নই, তাতে কী। ভেতরের তাগিদ থেকে মনের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে এমনভাবে নিমগ্ন হয়ে যাই, যেন সেরা ছবি তুলতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যাবে এ জীবন। কত কত অ্যাঙ্গেলে কত কত ছবি। কেন জানি চন্দ্রিমাও ছবি তুলতে কোনো কার্পণ্য করে না। ছবি তুলতে তুলতে একপর্যায়ে কিছুটা দূরে চলে যাই। কতটা সময় পেরিয়ে এসেছি, সেদিকে কোনো হুঁশ ছিল না। এমন সময় একজন লিয়াজোঁ অফিসার এসে লাঞ্চের জন্য ডেকে নিয়ে যায়। মজার বিষয়, দুজনে এতটা সময় কাছাকাছি থাকলেও ছবি তোলার বাইরে অন্য কোনো আলাপন হয়নি। এমনকি চেনা-পরিচয়ও। তবে চন্দ্রিমা যে ক্রীড়া সাংবাদিক, তা তো বুঝতেই পারছি। না হলে এ কংগ্রেসে আসার কথা নয়।
এবারের এআইপিএস এশিয়ার কংগ্রেসে যে কজনকে লিজেন্ড অব এআইপিএস এশিয়া সম্মানে ভূষিত করা হয়, তাদের মধ্যে রয়েছে আমার নাম। জমজমাট অনুষ্ঠানে নাম ঘোষণার সময় স্ক্রিনে ভেসে উঠে পরিচিতি। সম্মাননা ট্রফি হাতে স্টেজ থেকে নেমে আসার পর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে চন্দ্রিমা। তার উচ্ছ্বাস দেখে ভেবেছি, আমাকে সম্মানিত করায় বোধকরি খুশি হয়েছে; কিন্তু সে বিষয়ে আগ্রহ না দেখিয়ে জানতে চায়, ডু ইউ নো মাই মাদার?
হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, কে তোমার মা?
এইমাত্র স্ক্রিনে যে ছবিগুলো দেখানো হয়েছে, তার একটিতে আপনার পাশে বসা নারী, আবেগময় কণ্ঠে বলে চন্দ্রিমা।
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি অ্যাথেনার মেয়ে?
অশ্রুমাখা চোখে চন্দ্রিমা মাথা দোলাতে থাকে।
মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে যায় পরিপার্শ্ব। প্রায় তিন দশক আগের কথা। তখন আমি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগের অংশ হিসাবে ক্রীড়া সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (এআইপিএস) সদস্যপদ অর্জনের জন্য নানাভাবে দেনদরবার চলতে থাকে। সে লক্ষ্যে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এআইপিএস কংগ্রেসে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাই। অ্যাথেন্স এয়ারপোর্ট থেকে একই বিমানে ইস্তাম্বুল যাওয়ার সময় পরিচয় হয় অ্যাথেনার সঙ্গে, কংগ্রেসে গ্রিসের ডেলিগেটদের একজন। কাজ করে একটি স্পোর্টস দৈনিকে। দুর্দান্ত সুন্দরী বললেও তার সৌন্দর্যকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলা যায় না। স্মার্ট অ্যান্ড স্টাইলিশ। মেদহীন ধারালো ফিগার। নীল মিনি স্কার্ট আর সাদা শার্টে সোনালি চুলের মেয়েটিকে ফাটাফাটি লাগে। বয়স আমার কাছাকাছি হতে পারে। চোখে-মুখে লেগে আছে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। খুবই চটপটে। কথায় কথায় তাকে আসার কারণ জানালে আগপাছ না ভেবেই বলে, তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না।
একই হোটেলে রাখা হয় ডেলিগেটদের। বসফরাস প্রণালির তীরঘেঁষে গড়ে তোলা হোটেলটি অসাধারণ। মোটামুটিভাবে কংগ্রেসের সবাই অ্যাথেনার চেনাজানা। চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুত ফুড়ুত করে উড়তে থাকে। ডেলিগেট না হয়েও কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। বাংলাদেশকে সদস্য করাটা মানমর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এত পথঘাট মাড়িয়ে এসেছি, দেশের সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে লজ্জার সীমা থাকবে না। মনের মধ্যে তীব্র অস্থিরতা চলতে থাকে। কংগ্রেস উপলক্ষ্যে আয়োজনের কোনো খামতি রাখেনি স্বাগতিকরা। খানাপিনা, গানবাজনা, বেইলি ড্যান্স, ফ্যাশন শো, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন সব মিলিয়ে এলাহি কাণ্ড। তাতে মন বসে না।
অ্যাথেনা যতই ছোটাছুটি করুক না কেন, আমার খোঁজখবর রাখতে তার ভুল হয় না। দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে। কংগ্রেসের ফাঁকে ফাঁকে অ্যাথেনা টুকটাক কেনাকাটার জন্য আমাকে নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরতে বের হয়। ঐতিহ্যবাহী গ্র্যান্ড বাজার থেকে নকশাকাটা এক সেট গহনা কিনে দিই। খুব খুশি হয়ে সেটটি যত্ন করে হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়ে বলে, এটা প্রিয় মানুষের দেওয়া উপহার। আমার যদি কখনো মেয়ে হয়, তাকে এ গহনা দিয়ে সাজাব।
এর মধ্যে জানতে পারি, বাংলাদেশ থেকে দুটি আবেদনপত্র আসায় ভালো রকম প্যাঁচ লেগে গেছে। কেউ কেউ সদস্যপদ দেওয়ার বিপক্ষে। শুনে মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। গভীর হতাশা গ্রাস করে। অ্যাথেনাকে বিষয়টি অবহিত করলে সে আমার ঘাড়ে দুই হাত রেখে বলে, তোমার কি আমার প্রতি কোনো আস্থা নেই? আস্থা না থাকার কারণ দেখি না। সবার সঙ্গে যে রকম খায়খাতির, তার ভালোই প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। তবুও মনের মধ্যে ধুকপুক করতে থাকে।
ডেলিগেটদের সম্মানে আয়োজিত বসফরাস ক্রুজে অ্যাথেনা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয়। হয়ে উঠে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সেদিন তাকে অবিকল কোনো গ্রিক দেবীর মতো লাগতে থাকে। তার পরনে অফ-হোয়াইট টিউনিকের সঙ্গে ঝুলানো স্বর্ণের ফিতা, গহনার মুকুট, গলায় নেকলেস, হাতে সোনার চুড়ি, কোমরে বেল্ট, পায়ে গ্ল্যাডিয়েটর স্টাইলের স্যান্ডেল। ঢেউ খেলানো বেণি করা চুলে নানা শিল্পকর্ম, সোনালি আইশ্যাডো, লিপস্টিকের হালকা প্রলেপ। সবাই তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল। হঠাৎ নৃত্যের ভঙ্গিমায় এক পাক খেয়ে অ্যাথেনা বলে, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজকে যে সাজে সেজেছি, তা আমার বাংলাদেশের বন্ধুর সৌজন্যে। সে বহু দূর থেকে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এখানে এসেছে। নিশ্চয়ই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেব না। এআইপিএস পরিবারে আমরা নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে বরণ করে নেব। তার কথায় সবাই করতালি দিলে অ্যাথেনা জোরালো কণ্ঠে বলে উঠে, থ্রি চিয়ার্স ফর বাংলাদেশ। সবাই একযোগে বলেন, হিপ হিপ হুররে। দারুণ দক্ষতায় অ্যাথেনা অনেকটাই দূর করে দেয় সংশয়ের কালো মেঘ। চোখে চিক চিক করতে থাকে আনন্দাশ্রু। সেদিন সঙ্গের ইয়াসিকা ক্যামেরায় তার সঙ্গে কয়েকটি ছবি তুলে রাখি।
কংগ্রেসে যথারীতি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সদস্যপদ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। অ্যাথেনা আমার কাছে এসে বলে, কী বন্ধু, সেলিব্রেশন হবে না? বললাম, হবে তো বটেই। কিন্তু কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। অ্যাথেনা চোখ টিপ দিয়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলে, সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। সেদিন ডিনার শেষে মনের মধ্যে অস্বস্তি নিয়ে হোটেল রুমে যাই। অ্যাথেনার জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে যখন ভাবছি, ঠিক তখন এক বোতল রঙিন পানীয় নিয়ে রুমে আসে। যদিও এতে অভ্যস্ত নই, সেদিন আর কোনো কিছুতে না বলতে ইচ্ছে করেনি। কখন যেন ডুবতে থাকি গভীরতর আদর-ভালোবাসায়, তাতে দুজনের কারোই কোনো লাগাম ছিল না।
ঘোর কাটার পর দেখি, চন্দ্রিমা আপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গলায় স্মৃতিচিহ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে নকশাকাটা সেই হার। পাশের সিটে বসিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারি দুলিয়া। শুনে চমক লাগে। গ্রিক ভাষায় এর অর্থ পূজা, ভক্তি বা শ্রদ্ধা। বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলে, আই লাভ চাইল্ড। বাবার কথা কিছুই জানি না। আমাকে জন্ম দিতে গিয়েই মা নাড়ির বাঁধন কেটে চিরতরে চলে গেছেন। তার সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই আমার। তার ছবিগুলোই একমাত্র সঞ্চয়। মায়ের পথ অনুসরণ করে আমিও বেছে নিয়েছি ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে। এর ভেতর দিয়ে মাকে নিরন্তর খুঁজি। ছবি দেখে মনে হলো, আপনি মায়ের পরিচিত। আপনার সঙ্গে কি তার কোনো স্মৃতি আছে?
আমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু। তাতে দুলিয়া কী বুঝল, জানি না। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিজেকে আড়াল করার উপায় খুঁজতে থাকি। মনে মনে বলি, তুমি যে জ্যান্ত স্মৃতি হয়ে বিচরণ করছ দুলিয়া, এটাই তো জানা ছিল না। মুখ ফুটে কেন কিছু বলতে পারছি না? সত্যটুকু স্বীকার করে নেওয়ার মানসিক শক্তি কি আমার নেই?