Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নিঃসঙ্গ লেখকের বিশ্বভ্রমণ

Icon

সাইফুর রহমান

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিঃসঙ্গ লেখকের বিশ্বভ্রমণ

কল্পবিজ্ঞানের উপর বিশ্বের সর্বপ্রথম রচিত ও সর্বাধিক সাড়া জাগানো গ্রন্থসমূহের লেখক জুল ভার্ন। যে লেখকের নায়কেরা বিশ্বব্যাপী, আকাশে, পাতালে ভ্রমণ করেছেন অথচ নিজে কখনও ঘরের বাইরে পা দেননি, যিনি ৪০ বছর কাটিয়েছিলেন নির্জন চিলেকোঠায়।

এই আশ্চর্য মানুষ জুল ভার্নের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে আইনব্যাবসা করে উপার্জন করতে শিখুক। কিন্তু জুল ভার্নের আইন পড়ার দিকে আগ্রহ ছিল না। তার মনোযোগ ছিল সাহিত্যচর্চায়। এতে বাবা ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে অপদার্থ ছেলের মাসিক ভাতা দিলেন বন্ধ করে। অনেক কষ্টে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন জুলভার্ন। লেখালিখি করে একটা সময়ে অঢেল অর্থবিত্তের অধিকারীও হয়েছিলেন।

জুল ভার্নের হাতে তখন অনেক টাকা। তাই তিনি এবার চলে এলেন প্যারিস থেকে অ্যামিয়েনে। সেখানে এসে তৈরি করলেন সুন্দর এবং মজার নান্দনিক সৌন্দর্যের একটি বাড়ি। প্রকান্ড এই উচ্চ অট্টালিকার উপরে নির্মিত হলো একটি কক্ষ। সেই কক্ষটি দেখতেও অবিকল নাবিকদের কেবিনের মতো। আসলে এটাও ছিল একটি চিলেকোঠা, যে চিলেকোঠায় তিনি আবদ্ধ থেকেছেন সারা জীবন। এখানেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন তার জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর।

আরেক ঘরকুনো বিখ্যাত মানুষ ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি ‘রূপসি বাংলার কবি’ অভিধায় অভিহিত হয়েছিলেন। বুদ্ধুদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাকে বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি’।

জীবনানন্দ যে কীরকম ঘুরকুনো ছিলেন সে সম্পর্কে জানা যায় জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশের লেখা থেকে। তার লেখা মানুষ জীবনানন্দ বইটিতে তিনি লিখেছেন, জীবনানন্দ সমস্ত দিন ঘরে বসে টেবিলে মুখ গুঁজে লিখতেন। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ছিল লেখালিখি। লাবণ্য দাশ একটি স্কুলে পড়াতেন। সেই সঙ্গে নাটক-নভেল-থিয়েটার প্রভৃতি নানা শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। নাটকের রিহার্সেল শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক সময় বেশ রাত হয়ে যেত। বাড়ি ফিরে তিনি দেখতেন জীবনানন্দ লেখাতেই ব্যস্ত। লাবণ্য দাশের সঙ্গে বিয়ের আগে কণে দেখার দিন লজ্জায় লাবণ্যকে তেমন কোনো প্রশ্নই করতে পারেননি জীবনানন্দ। শুধু লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার নাম কী, আইএ-তে কী কী সাবজেক্ট নিয়েছেন এবং কোনটি আপনার বেশি পছন্দ। এতটুকুই।

এই জীবনানন্দই কৈশোরে প্রেমে পড়েছিলেন। যদিও তার প্রেম ছিল একতরফা। লজ্জায় প্রেমের কথা প্রেমিকাকে বলতেও পারেননি। তরুণ জীবনানন্দ প্রেমে পড়েছিলেন চাচাতো বোন শোভনা দাশের। কাকা অতুলচন্দ্র দাশের বাড়িটি ছিল কবির বাড়ির লাগোয়া। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভালোবেসে গেছেন তাকেই। হয়তো সমাজে লোকলজ্জার ভয়ে মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। তবে দিনলিপির পাতায় পাতায় বন্দি করে রেখে গেছেন সেই অস্ফুট দুঃখগুলোর কথা। জীবনানন্দ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে উদ্ধার করা দিনলিপির পাতায় পাতায় ‘Y’ নামে কোনো এক মেয়ের নাম লেখা আছে। দিনলিপিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জীবনানন্দ তার দিনলিপিতে সংক্ষেপ ব্যবহার করতেই পছন্দ করতেন। তাই শুরুতেই লিখে নিয়েছিলেন ‘Y = শচী’। জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহের মতে এই শচীই ছিলেন শোভনা।

শোভনা ছিলেন তরুণ জীবনানন্দের মুগ্ধ পাঠক ও শ্রোতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবি তার নিজের কবিতা পড়ে শোনাতেন শোভনাকে। নিতান্ত অখ্যাত এক তরুণ থেকে বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি হয়ে ওঠার দিনগুলোতে শোভনা ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। ১৯২৭ সালে কলকাতার থেকে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক শোভনাকেই উৎসর্গ করেছিলেন। কোনো কোনো জীবনানন্দ-গবেষকের মতে, এই শোভনাই ছিলেন বনলতা সেন!

এ পৃথিবী বড়োই রহস্যময়। ভরতবর্ষের একজন বিখ্যাত মানুষের স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে তিন সাগর বারো নদীর ওপারের কোনো এক বিখ্যাত মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে কীভাবে যেন হুবহু মিলে যায়। কবি জীবনানন্দের মতো জুলভার্নও ভালোবেসেছিলেন তার চাচাতো বোন ক্যারোলিনা ট্রনসনকে। ক্যারোলিন অবশ্য জুলভার্নের চেয়ে বছর দেড়েকের বড়ো ছিলেন। জুলভার্নও জীবনানন্দের মতো ক্যারোলিনাকে নিয়ে কবিতা লিখতেন এবং তাকে পড়ে শোনাতেন। কিন্তু লজ্জায় জুলভার্ন কোনোদিন ভালোবাসার কথা তাকে জোর দিয়ে বলতে পারেননি। ক্যারোলিনাও জুলভার্নের ভালোবাসার প্রতি কোনোরকম সাড়া দেননি। ১৮৪৭ সালে জুলভার্নের বয়স যখন ১৯ ক্যারোলিনার তখন ২০। ক্যারোলিনা তার চেয়ে ২৪ বছরের বড়ো এক লোককে বিয়ে করেন। জুলভার্ন যেন ভগ্ন হৃদয়ে পতিত হলেন শোকের সাগরে।

বাংলাসাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদও ছিলেন গর্তজীবী লেখক। হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক যিনি জীবনে যা চেয়েছেন তা-ই পেয়েছেন, যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন। পৃথিবীর খুব কম লেখকই জীবনে এত ভোগবিলাস করার সুযোগ পান। খুব কম লেখকই জীবনে তার যাবতীয় স্বপ্নকে সফল করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেছেন, জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন শরৎচন্দ্রের চাইতে বড়ো। মেরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। আর হুমায়ূন আহমেদের নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন হচ্ছে, আই অ্যাম রাইটিং ফর বাজার।’

হুমায়ূন আহমেদের একটা বড়ো সীমাবদ্ধতা ছিল তার লাজুকতা। নিজেকে ‘গর্তজীবী’ বলার মধ্যে কি আমরা মিসির আলির মতো রহস্যের গন্ধ পাই না? আজকালের লেখকরা তাদের লেখা নিয়ে যেভাবে প্রচার করেন, সমানে কলাম লিখেন কিংবা টকশোতে মুখ দেখাতে আর পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে মুখিয়ে থাকেন, তিনি ছিলেন তার উলটা। ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ূন আহমেদকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি বহুদিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায় এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান?’ উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেকদিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালিখি-জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না।’

আরেক বিখ্যাত ঘরকুনো লেখক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জন্ম ১৯১২ সালের ২০ আগস্ট বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। যৌবনে তিনি সাহিত্যচর্চার জন্য স্থায়ীভাবে চলে যান কলকাতায়। জ্যোতিরিন্দ্রের লেখার অনুরাগী ছিলেন বেশ কিছু বিখ্যাত লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে অভিহিত করেছেন লেখকদের লেখক হিসেবে। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তাঁর লেখা পড়ে লিখতে শেখা যায়।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছোটগল্প লেখায় মাস্টারপিস লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।’ তার বিখ্যাত দুটো উপন্যাস মিরার দুপুর ও বারোঘর এক উঠোন। এছাড়া তার হাত দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গিরগিটি, সিদ্ধেশ্বরের মৃত্যু, বন্ধুপত্নী প্রভৃতি কালজয়ী কিছু গল্প।

সমবয়সি অন্য শিশুদের মতো ছোটোবেলায় হইহই করে খেলাধুলো করা, বায়না ধরার ধাত জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মোটেও ছিল না। ছিল না মেলায় যাওয়ার উৎসাহ বা পুজোর সময় তিতাসের বুকে ভাসান অথবা পয়লা ভাদ্রে নৌকোদৌড় দেখার কোনো আগ্রহ। ভালোলাগা কাকে বলে, ভালো দৃশ্য কী, সেই কচি বয়সেই টের পেয়েছিল সে! ঘরে বসে বই পড়া আর আঁকাআঁকি এ ধরনের সৃজনকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বালক জ্যোতিরিন্দ্র।

কমলকুমার মজুমদার আর জ্যোতিরিন্দ্র ছিলেন সমসাময়িক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্র সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কমলকুমার সেই সময় ছিলেন ডাকাবুকো ধাতের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ আর জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ঘরকুনো, বর্ণচোরা ধরনের। দেশ পত্রিকার আমাদের সেই কার্যালয়ের উল্টোদিকে একটি নতুন চায়ের দোকান খুলল, সেখানে পরিবেশনকারিণী তিন-চারটি মেয়ে। কলকাতায় তখন এই রকম একটি হুজুগ উঠেছিল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আমায় একদিন বললেন, তোমায় একটা টাকা দিচ্ছি, তুমি ওই দোকানে গিয়ে চা আর কাটলেট খেয়ে একটু দেখে এসো তো, মেয়েগুলো কী করে। আমি সরলভাবে বললুম, আপনিও চলুন না! উনি প্রায় কুঁকড়ে গিয়ে বললেন, না না, আমার চা সহ্য হয় না। বাইরের খাবার খাই না। তাছাড়া ওইসব মেয়ে-টেয়ে, বুঝলে, তোমার কম বয়েস, তুমি বরং, বুঝলে...। সেই চায়ের দোকানে শেষ পর্যন্ত জ্যোতিদা বা আমি কেউই যাইনি, দোকানটিও অবিলম্বে উঠে যায়। কিন্তু চায়ের দোকান নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী অবিস্মরণীয় একটি গল্প লিখেছেন তার কিছুদিন পরেই।’

নিঃসঙ্গ কবিদের মধ্যে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ নিঃসঙ্গ কবি ছিলেন এলিজাবেথ ডিকেনসন। আশ্চর্য কবি। দেড় হাজার থেকে সতেরোশো কবিতা লিখেছেন ছাপ্পান্ন বছরের জীবনে কিন্তু জীবিতকালে ছাপা হয়েছে মাত্র গোটা সাতেক কবিতা। তাও কবির নাম ছাপা হয়নি। তার মৃত্যুর প্রায় সত্তর বছর পরে প্রামাণ্য কাব্যসংকলন ও পত্র-সংকলন বেরিয়েছে। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নিজের লেখা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। বাড়ির লোকে পর্যন্ত বুঝতে পারেনি একজন কবির জন্ম হচ্ছে সকলের অলক্ষে। টুকরো কাগজে, খাবারের ঠোঙায়, হিসেবের খাতায় ছোটো ছোটো পদ্য চোখে পড়ত। কিন্তু বাবা, ভাই বোন, কেউ গুরুত্ব দেয়নি ডিকনসনের সেসব লেখায়। কবি নিজেও দেননি। কবিতা লেখা হয়ে গেলে কাগজের টুকরোটা গোল করে পাকিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে টেবিলের দেরাজের মধ্যে রেখে দিতেন। মৃত্যুর আগে ছোটো বোনকে বলে গেলেন, এই কাগজগুলি পুড়িয়ে ফেলো।

পোড়াতে গিয়ে ঘাবড়ে গেল বোন ল্যাভিনিয়া। এ যে এক বিরাট স্তূপ! কী আছে এর মধ্যে? দুয়েকজন বন্ধুকে ডেকে দেখাল ল্যাভিনিয়া। তাদের পড়ে ভালো লাগল, এক কবির জীবনব্যাপী সাধনার ফল রক্ষা পেল আগুনের হাত থেকে।

ডিকেনসনের কবিতা সম্বন্ধে একজন সমালোচক বলেছেন যে, এঁকে একদিক থেকে লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দুজনেই এমনভাবে লিখেছেন যেন এদের আগে কেউ কবিতা লেখেনি। অর্থাৎ ডিকেনসন প্রচলিত কাব্যরীতির ঐতিহ্য অনুসরণ করেননি, পূর্বসূরিদের প্রভাব পড়েনি তার রচনায়। তার রচনা তাই মৌলিক, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কোনো কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না যে আলোচনা করে কাব্যরীতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবেন।

ডিকেনসনের পিতা হঠাৎ মারা যান। তারপর থেকেই ডিকেনসনের জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। মৃত্যু পর্যন্ত এলিজাবেথ ডিকেনসন বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরে পা বাড়াননি। বারো-তেরো বছর বাড়িতে বসে বই পড়েছেন, কবিতা লিখেছেন আর কখনও ইচ্ছা হলে বাগানে একটু বেড়িয়েছেন। অতিথি-অভ্যাগত বাড়িতে এলে কদাচিৎ তাদের সঙ্গে দেখা করতেন। নিঃসঙ্গতাই হয়ে উঠল তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। নিঃসঙ্গতা উপভোগ করবার ক্ষমতা না থাকলে হয়তো তার জীবনটা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠত। তিনি লিখেছেন, ‘I might be lonelier/Without the loneliness।

বাস্তব জীবনে কাউকে পেতে চাননি। নিঃসঙ্গতাই ছিল তার বিলাস। অথবা হয়তো নিজের চেহারা সম্বন্ধে হীনম্মন্যতার ভাব ছিল। পাছে এ জন্য কেউ প্রত্যাখ্যান করে সেই ভয়ে কোনো পুরুষের নৈকট্য কামনা করেননি। সতেরো বছরের একটা ছবি আছে; আর কোনো প্রতিকৃতি করাননি ডিকেনসন। অথচ তখনকার দিনে আমহার্স্ট শহরে ভ্রাম্যমাণ শিল্পীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত পোট্রেইট আঁকার জন্য। এমিলি জানতেন তাঁর চোখ-মুখ দেখতে ভালো নয়। তাই কোনো অতিথি বাড়ি এলে ফুল হাতে করে দেখা করতেন। হয়তো ভাবতেন তাহলে অতিথির চোখ যাবে সুন্দর ফুলের উপর; তার অসুন্দর মুখ ঢাকা পড়ে যাবে। এ সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলছেন : ‘I take a flower as I go,/ My face to justify./ He never saw me in this life-/ I might surprise his eye!’

এ কথা আমি পূর্বেই বলেছি যে, বরেণ্য কোনো মনীষীর জীবনের ঘটনার সঙ্গে আরেক মনীষীর জীবনের ঘটনা আশ্চর্য ও কাকতালীয়ভাবে কীভাবে যেন হুবহু মিলে যায়। ডিকেনসনের উপর্যুক্ত ঘটনার সঙ্গেও সমানভাবে মিলে যায় বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জীবনের একটি দিকের সঙ্গে। ডিকেনসনের মতো জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীও দেখতে ভালো ছিলেন না। বিয়ের আগে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর স্ত্রী পারুল দেবীকে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী যখন দেখতে গিয়েছিলেন তখন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গনেশ দত্তকে। গনেশবাবুর গায়ের রং ছিলো মিশমিশে কালো। বিয়ের পরে জ্যোতিরিন্দ্র পারুল দেবীকে বলেছিলেন, ‘ও পাশে থাকলে আমায় দেখতে একটু ভালো লাগবে সেটা ভেবেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম গনেশকে।’

সে যা হোক, এরা ছাড়া আরও বহু লেখক সাহিত্যিক ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকেই সাহিত্যচর্চা করতে বোধ করি বেশি পছন্দ করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাকে পূর্ণিয়া জেলার উইলিয়াম ফকনার বলে সম্বোধন করতেন সেই সতীনাথ ভাদুরী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি লেখক সাধারণত সভাসমিতি, বক্তৃতা ও লোকসমাগমে তেমন একটা যেতেন না। ‘গল্প কেন লিখলাম?’ এই নামে জগদীশচন্দ্র গুপ্তের একটি রচনা আছে। তাতে তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন, তার স্ত্রীর তাড়না থেকে বাঁচার জন্যই তিনি কলম ধরেছেন। তার স্ত্রী তাকে চুপ করে ঘরে বসে থাকতে দেখলেই হাতে পয়সা দিয়ে বলতেন বাজার থেকে কিছু কিনে আনতে। অনবরত বাজারে ছোটা এবং বউয়ের ফরমাশ খাটা এড়াবার জন্যই তিনি কলম হাতে নিয়ে লেখার ভান করতেন। ভান করতে করতে একদিন গল্প লিখে ফেললেন। এটা বেশ একটা ভালো ধরনের রসিকতা বটে। কিন্তু এই কাহিনির পেছনের মোরাল হচ্ছে, যে-কোনো উপায়ে লেখক যে ঘরে আবদ্ধ থাকতে চান সেটাই কিন্তু এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।

এ ছাড়া ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো ও গুস্তাভফ্লবের জীবনের অনেকটা সময় ঘরকুনো হয়ে কাটিয়েছেন। বিশেষ করে ফ্লবেরের শেষ জীবন একচ্ছত্রভাবে কেটেছে নিজ গৃহে। ভিক্তর হুগো তো রীতিমতো প্রকাশকের তাড়া খেয়ে রাতদিন ঘরে বসে লেখার জন্য নিজের সমস্ত পরিধেয় বস্ত্র অন্যত্র আটকে রেখে শরীরে শুধু ধূসর রঙের একটি শাল গায়ে জড়িয়ে লিখতে বসতেন, যাতে করে ইচ্ছে করলেই যেন ঘরের বাইরে বেরুতে না পারেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম