
অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
‘এ দৃশ্য আমাকে আমাদের ফ্রান্স ভ্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তোমার মনে পড়ে’?
‘আল্লাহর দোহাই, তোমার এই স্মৃতি রোমন্থন বন্ধ কর। আমি ভয় পাচ্ছি। স্রেফ ভাবো যে, সূর্য ডোবার আগে আমাদের বাড়ি পৌঁছা দরকার।’
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমি আমার বিরস বদন কল্পনা করতে পারি। তবে আমি বিচলিত নই।
আমরা শফি শামরন চেকপয়েন্টের কাছে পৌঁছে গেছি, আমার স্বামীর কথায় কষ্ট পাইনি আমি। নিশ্চয় সে আমাদের সময় নষ্ট হওয়ার কারণে বিরক্ত, আমরা এদিকে আসা একুশটা এবং বিপরীত দিক থেকে আসা আঠারটা গাড়ির লাইনের মধ্যে আটকা পড়েছি-বেড়ে চলা একঘেয়েমি কাটানর জন্য আমরা গণনা করে দেখেছি। আমরা যখন ট্রাফিক জ্যাম ছাড়িয়ে এগোচ্ছিলাম তখন আমাদের ছেলে গাড়িগুলো গোনার সময় বিড়বিড় করছিল-জ্যামটা যে কোনো সময় তীব্র হয়ে উঠতে পারে। সম্ভবত সৈন্যদের অ-শ্রদ্ধার কারণে আমার স্বামী পীড়িত বোধ করছে, তারা আমাদের আইডি এবং স্যুটকেসগুলোয় অর্থহীন অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল, তার রাগের আরও একটা কারণ সম্ভবত এই যে, সৈন্যরা আমাদের প্রায় সমবয়সি, বা হয়তো ছোটই হবে।
সে জানে আমি তাকে কতটা ভালবাসি, সেজন্যে সে তার কথার ধার নরম করার চেষ্ট করে, বলে: ‘ওই জঘন্য লোকগুলো কি ঘুমায় না? তাদের কাজটা যদি এতই আরামের হয়, তাহলে এখানে, যেখানে তারা দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে তাদের স্ত্রীদের রান্নার গন্ধ পায় না কেন?’
আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো আমার মনোবল বাড়ানর চেষ্টা করছে, বা সম্ভবত চেয়েছে আমাদের বসবাস এবং তার কর্মস্থলের দূরত্ব নিয়ে আমি আক্ষেপ করি যার কারণে আমাদের জেনিনের বাড়ি ছেড়ে রামাল্লাহ্য় বাসা ভাড়া নিতে হয়েছে। কিংবা সম্ভবত সে এখনো মাইগ্রেশনের কথা ভাবছে।
সম্ভবত সে স্বপ্ন দেখছে, যে স্বপ্ন সব ফিলিস্তিনিই দেখে, যে একদিন সব ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারী আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবে আর পশ্চিম তীরের সব শূন্য বসতি আবার আমাদের হয়ে যাবে। সে একদিন মজা করে আমাকে বলছিল, ‘আমি রামাল্লাহ্র কাছে বেইত্ আল্ বসতিতে একটা বাড়ি বেছে নেব, সেখানে আমরা অস্থায়ীভাবে বাস করব, বা সম্ভবত শফি শামরনের বসতিতে যেন সফরের সময় সেখানে বিশ্রাম নিতে পারি, কিংবা জেনিনের কাছে দুতান বসতিতে।’
তারপর সে জিজ্ঞেস করল, ‘জিহাদ কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
এটা জিজ্ঞেস করার কারণ, আমাদের ছেলের শ্বাস ছাড়ার শব্দ হচ্ছিল বাঁশির মতো জোরে, তার বাবার প্রশ্নের পর তার মায়ের নীরবতাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছিল।
সম্ভবত আমাদের ছেলেকে আমরা যেভাবে লালন-পালন করেছি তার জন্য সে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাইছিল। সম্ভবত সে বলতে চাইছিল যে, ছেলেটি যখন মহিলা সৈনিকের ট্রাউজার ধরে টান দিয়েছিল তখন সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। ‘সে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারত, ওই বর্বরটা। তারা নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করে, বিশ্বাস কর!’।
সম্ভবত সে আমার কাছ থেকে আমার স্বাভাবিক উত্তরের প্রতীক্ষা করছিল : ‘ছেলেটিকে তাদের ভয় দেখাতে থাক, দেখি কী করে আমরা দেশটাকে মুক্ত করতে পারি।’
সে মজা করতে লাগল, ‘সম্ভবত মেয়েটির চুল জিহাদের পছন্দ হয়েছে!’
আমার মনে হলো; সে সম্ভবত চাইছিল আমি ঈর্ষান্বিত হই বা সম্ভবত আমার আত্মবিশ্বাসী উত্তরের প্রতীক্ষা করছিল, ‘আমি ঈর্ষা করব? কাকে নিয়ে? একজন মহিলা সৈন্যের জন্যে?’
তারপর, অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, (সম্ভবত এ নীরবতার সময় কী বলবে সেটা নিয়ে ভাবছিল সে) ‘আগামী মাসে আমাকে কায়রোয় একটা সম্মেলনে অংশ নিতে যেতে হবে।’
আমি হাসলাম, সম্ভবত সে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে যে সে একজন শিক্ষিত মানুষ, সে উচ্চপদে আছে, আর সে কখনো কখনো তার নিজের কিছু-কিছু কাজ নিয়ে খুশি হতে পারে না। আমি তার দিকে আড় চোখে তাকালাম। ওই মুহূর্তে, সম্ভবত আমি তাকে বলতে চাইছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমি জানি তুমি এ রকমই।
আমার মনে পড়ে, তখন আমাদের দুজনেরই বয়স ষোল। আমাদের দেখা হয়েছিল ফ্রান্সে, সেখানে একটা বেসরকারি সংগঠনের আয়োজনে বিভিন্ন জাতীয়তার তরুণদের সঙ্গে আমরা আমাদের জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। আমরা তেল আবিবের লড বিমানবন্দর দিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা বয়সে তরুণ, ইসরাইলি বিমানবন্দরে আমরা সতেজ সবুজ খেজুরগাছের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমরা হচ্ছি পারসোনা নন গ্র্যাটা, অবাঞ্ছিত মানুষ, যাদেরকে সর্বত্র খুঁজে বেড়ান হয়-এমনকি তাদের দৃষ্টি, তাদের ঘ্রাণ-এক টুকরা কমলা বা একটা জলপাই বহনের জন্যে তাদের অভিযুক্ত করা যায়। আমার মনে পড়ে ইহুদি গ্রুপটার কথা, যারা প্যারিসের শহরতলীতে আমাদের ক্যাম্পের কাছে বসবাস করত। তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে ক্যাম্পগুলোর অবস্থান কাকতালিয় ছিল না, পরিকল্পিতভাবেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আমাদের সফর কেবল আমাদের জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে ছিল না। সুতরাং আমরা আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, যদিও তারা আমাদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করত। আমরা তাদের ক্যাম্প থেকে দূরে থাকতাম। আমার সুজানার কথা মনে পড়ে, পোলিশ বংশোদ্ভূত ইহুদি তরুণী। তার সঙ্গে সাক্ষাতের দিনটার কথা আমার স্মরণ হয়। একটা স্নিগ্ধ ভোরের কথা সেটা, আমার ঘুম আসছিল না। সেজন্য আমি হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি এ জাদুর দেশে আছি।
আমি ক্যাম্পের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। সেখানে দেখতে পেলাম একটা মেয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উৎসাহিত হয়ে তার কাছে গেলাম। এই হচ্ছে সুজানা। সে আমার হিজাব দেখেই বুঝেছিল আমি মুসলিম। তার দলের অন্য সবার মতো তার গলায় পরা ডেভিড-স্টার দেখে বুঝতে পারলাম সে ইহিুদ।
সুজানা ভাঙা ভাঙা আরবিতে কথা বলছিল। সে জেরুসালেমের একটা শিক্ষাকেন্দ্রে এটা শিখেছে, সে বলল সে প্রকৃতিতে একা-একা প্রার্থনা করতে পছন্দ করে। তার প্রার্থনা, তার বক্তব্য অনুযায়ী, ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যায় যাকে সে ভালোবাসে। কান্নার দেওয়াল বা তার ধর্মশিক্ষকের প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে সে ঈশ্বরকে খুঁজে পায় না।
সে ইউরোপীয়ানদের তাদের স্বাধীনতার জন্যে তার অন্তরে লালন করে এবং তার আশা কোনো একদিন পোল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে পাবে, যার সম্পর্কে তার জানা নেই কিন্তু ঈশ্বরের মতো তাকে ভক্তি করে। সে সাক্ষাতের পর থেকে আমি প্রত্যেকদিন ভোরে সুজানার সঙ্গে মিলিত হতাম। আমরা হ্যান্ডসেক করতাম এবং ব্রেকফাস্টেও সময় হওয়া পর্যন্ত একসঙ্গে থাকতাম। আমরা শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন এবং প্রেমের স্বীকারোক্তির কথা পরস্পরকে বলতাম।
আমি আমার স্বামীর শ্যামলা রঙের মুখের দিকে তাকালাম যা স্বর্ণকেশী সুজানাকে এত আকর্ষণ করেছিল, আহ! যদি সে টের পেত। সে জানলে কী হতো!
আমি অবাক হয়ে ভাবি, সুজানার কি আমার কথা স্মরণ হয়? তার কী হয়েছে?
সম্ভবত সে তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং পোল্যান্ড পাড়ি দিয়েছে। সম্ভবত সে এমন একটা সংগঠনের সদস্য হয়েছে যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য কাজ করে। সম্ভবত সে তার সরকারের বিরুদ্ধে লেখে এবং বিক্ষোভ করে... কিংবা সম্ভবত স্নিগ্ধ, সুন্দরী, স্বপ্নাতুর সুজানা কোনো একটা চেকপয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে, এ চেকপয়েন্টের এ স্বর্ণকেশী মহিলা সৈন্যের মতো, যে সুস্পষ্ট বিতৃষ্ণার সঙ্গে আমাদের পরিচয়পত্রের নম্বর পরীক্ষা করছে।
ইসরা কালাশ উদীয়মান ফিলিস্তিনি কথাশিল্পী। গাজায় বসবাস করেন। তার প্রথম গ্রন্থ ছোটগল্পের সংকলন খাতা মাতবাঈ। ২০১০ সালে ‘এ এম কাত্তান ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে।