Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

জন কীটস: ২৫ বছরের অমর জীবন

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জন কীটস: ২৫ বছরের অমর জীবন

পঁচিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে কবি জন কীটসের (১৭৯৫-১৮২১) প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা মাত্র ৫৪টি। তবে তার কিছু কবিতা দীর্ঘ এবং মহাকাব্যিক ধাঁচে রচিত। ‘এন্ডিমিয়ন’ নামে তার একটি কবিতার দৈর্ঘ্য ৪,০০০ লাইন। কবিতার সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও ইংলিশ কবিদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

তিনি প্রচলিত কাব্যধারাকে নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। কবিতায় সাংঘর্ষিক দিক ও শক্তিগুলোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ এনেছেন, কাব্যিক আত্মসচেতনতার সংযোগ ঘটিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিহাসমূলক বিষয়ের অবতারণাও করেছেন। রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীরা তার কবিতাকে আবেগের বাড়াবাড়ি সম্পন্ন ও রুচিহীন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ ধারণা ও অশ্লীল শব্দের সমাহার বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। সবকিছু সত্ত্বেও মাত্র পঁচিশ বছরের জীবনে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা তাকে কাব্য জগতে অমরত্ব দান করেছে।

এক দরিদ্র পরিবারে জন কীটসের জন্ম ১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর। তিনি জন্মগ্রহণ করেন নানা বাড়ির ঘোড়ার আস্তাবলে, যে আস্তাবলের দেখাশোনা করতেন কীটসের পিতা থমাস কীটস। তিনি যখন শ্বশুরের আস্তাবলের মালিকে পরিণত হন, তখন পরিবারটি সচ্ছলতার মুখ দেখে। চার ভাইবোনের মধ্যে জন কীটস সবার বড় ছিলেন। আট বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মধ্যে ১৮০৪ সালে তার পিতা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মারা যান। পরিবারে আর্থিক দুর্গতি নেমে আসে। কীটসের মা মায়ের বাড়ি চলে যান এবং আবার বিয়ে করেন। এই বিয়ে বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়। নতুন স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে তিনি সম্ভবত অপর এক ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। ১৮০৮ সালের মধ্যে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তিনি আবার মায়ের বাড়ি ফিরে আসেন। ওই সময়ের দুরারোগ্য যক্ষ্মা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

ভাইবোনদের মধ্যে বড় হওয়ার কারণে অল্প বয়সেই কীটসকে তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। শৈশবে তিনি যে যাতনাময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা তার আত্মিক বিকাশে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

জন কীটস তার স্কুলের হেডমাস্টার ও তার পুত্রের ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হন। মেধাবী ছাত্র হওয়ার কারণে তিনি হেডমাস্টারের প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন কীটস। স্কুলের ওপরের ক্লাসগুলোতে রচনা প্রতিযোগিতায় তিনি সব সময় প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। এমনকি তিনি ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেছিলেন। বলা যায়, সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ, উদারপন্থি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তার মাঝে এক ধরনের রাজনৈতিক রূপকল্পের সৃষ্টি হয়। স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই গ্রিক রূপকথার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং গ্রিক মহাকাব্য ‘অ্যানিয়েড’ (Aeneid)-এর অধিকাংশ অনুবাদ করে ফেলেন। ২০ থেকে ১৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে ‘পাবলিয়াস ভার্জিলাস মারো’ (Publius Vergilius Maro) নামে রোমের মহান কবি ‘অ্যানিয়াস’ নামে এক ট্রোজান বীরের বর্ণনা করেছেন, যিনি ট্রয়ের পতনের পর ইটালিতে চলে যান এবং রোমানদের পূর্বপুরুষে পরিণত হন।

পিতৃমাতৃহীন নিঃসঙ্গ বালক জন কীটসের জন্য সাহিত্য এক স্বপ্নের মতো আশ্রয়ের চেয়েও অধিক ছিল, যা পরবর্তী সময়ে তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। কীটসের বয়স যখন পনেরো বা ষোলো বছর, তখনো তিনি খুব গুরুতরভাবে ভাবেননি যে সাহিত্যই হবে তার কর্মক্ষেত্র। তিনি অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি পড়তে শুরু করেন। চিকিৎসকের পেশার চেয়ে সার্জনের কাজ তার কাছে সম্মানজনক ও যৌক্তিক মনে হয়েছিল। কারণ সার্জন ডিগ্রির জন্য তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ত না। পরীক্ষা দিয়েই সার্জন হওয়ার লাইসেন্স পাওয়া যেত। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে কাজটি শুরু করলেও ক্রমে তিনি উৎসাহ হারান, অস্থির ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন। এ সময় তিনি ‘অ্যানিয়েড’-এর অসম্পন্ন অনুবাদ শেষ করেন।

সাহিত্যবিষয়ক কোনো শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি। তা সত্ত্বেও এখনো তাকে কল্পকথার জাঁকজমকের বাইরে মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা ও যাতনার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার সেরা কবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তার কাব্যিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সনেট রচনায় তাকে তুলনা করা হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সঙ্গে।

তার বন্ধু চার্লস ব্রাউনের বিশ্বাস, ‘আঠারো বছর বয়সে কীটস যখন প্রথম ষোড়শ শতাব্দীর কবি এডমুন্ড স্পেনসারের কবিতা পড়েন, তখন তিনি প্রথম যৌবনে পা দিয়েছেন। তখন থেকে তার মধ্যে সৌন্দর্যের চেতনা তীব্রভাবে স্থান করে নেয়; সে সৌন্দর্য ফুল, গাছ, আকাশ বা প্রাণীজগৎ, যাই হোক না কেন। স্পেনসারের মহাকাব্যিক রচনা ‘ফেইরি কুইন’ (Fairy Queen) কীটসের প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে, এর মধ্যে তার এতটাই মগ্নতা ছিল, যেন তিনি নতুন এক পৃথিবীতে নিশ্বাস গ্রহণ করেছেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হন। শিগ্গির তিনি কবিতায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তী দুই-তিন বছরের মধ্যে কবিতাই তার পেশা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিও তার জীবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের ওই সময়ে বিরাজমান উত্তাল পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

১৮১৭ সালের মার্চ মাসে জন কীটসের কবিতার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে অনেকে সমালোচনা করেন, অনেকে তাকে উদীয়মান কাব্য প্রতিভা বলে প্রশংসাও করেন। কিন্তু তার কবিতার বই মাত্র গুটিকয়েক কপি বিক্রি হয়। যারা কিনেছিলেন, তাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, বইটি ভুলে ভরা।

তিনি ব্যঙ্গবিদ্রুপ শিকার হয়েছিলেন যে, যারা বইটি কিনেছিলেন তাদের কেউ কেউ বইটি ফেরত দিতে বাধ্য হন। ক্রমে তার মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ১৮১৯ সালের শীত মৌসুমে তিনি কবিতা লেখা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তিনি বেপরোয়া হয়ে পড়েন এবং তার মনে হয়, ফ্যানি ব্রোন নামে যে মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছেন, তাকে বিয়ে করা তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। তার স্বাস্থ্য ও মন ভেঙে পড়ে।

১৮২০ সালে তার ফুসফুসে রক্তক্ষরণের ফলে তার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি মারা যাচ্ছেন। তার বন্ধু চার্লস ব্রাউন বলেছেন, ‘একদিন রাত এগারোটার দিকে তিনি আমার বাড়ি আসেন। তাকে দেখে মাতালের মতো মনে হচ্ছিল। তার এ অবস্থা আমার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল।’ ব্রাউন যখন তাকে বিছানায় শুইয়ে দেন তখন তার শরীরে জ্বর ছিল। আমি তাকে বলতে শুনি, ‘আমার মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে-ব্রাউন, মোমবাতিটা এনে দাও এবং রক্ত দেখতে দাও।’ তিনি আমার মুখের দিকে তাকান এবং শান্তভাবে বলেন, ‘আমি এই রক্তের রং চিনি-এটা ধমনী থেকে এসেছে। এই রং আমাকে প্রতারণা করতে পারে না। রক্তের এই ফোঁটা আমার মৃত্যু পরোয়ানা এবং আমি মরতে যাচ্ছি।’ এর এক বছর পর ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রোমে মারা যান।

জন কীটসের কবিতা:

“দিনের অবসানে বিদায় নিয়েছে দিনের মধুরতাও,

মধুর কণ্ঠ, মিষ্টি ঠোঁট, নরম হাত ও কোমল স্তন

উষ্ণ নিশ্বাস, হালকা ফিসফাস, কোমল অস্ফূট কণ্ঠ,

উজ্জ্বল চোখ, নিখুঁত অবয়ব এবং কামনাময় কোমর!

-আজ আমি যখন প্রেমের পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেছি,

উপবাস ও প্রার্থনায় দেখে সে আমাকে ঘুমোতে দেবে।”

না, -তবুও অবিচার, তবুও অপরিবর্তনীয়

আমার খাঁটি প্রেমের পাকা স্তনের ওপর বালিশ চাপা

অনন্তের হালকা পতন ও ফুলে যাওয়া অনুভব করতে

মধুর অস্থিরতায় অনন্তকাল জেগে থাকুক।”

“এরা কেমন মানুষ বা দেবতা? কুমারীর কেমন অনিচ্ছা?

উন্মাদের সাধনা কী? পালানোর সংগ্রাম কী?

কী বাঁশি এবং তাম্বুরা? উদ্দাম পরমানন্দ কী?

শোনা সুর খুব মধুর, কিন্তু যা অশ্রুত,

তা আরো মধুর...”

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম