আবদুল হাই শিকদারের
রাজনীতি ও বিপ্লবের কবিতা

শাহাদাৎ সরকার
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী।’ ফলে তার ভেতর রাজনীতি সচেতনতা কাজ করে ন্যাচারালি। আর সেই ব্যক্তি যদি কবি হন, তাহলে তার রাজনৈতিক চেতনা হয়ে ওঠে আরও তীক্ষ্ণ। কারণ কবি তো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না।
আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘কবিরা সমাজ দেহের চক্ষু, বাগানের মুক্ত পাখি এবং সত্যের দর্পণ।’ এই সত্য চেতনা তাকে করে তোলে আরও বেশি রাজনীতিপ্রবণ। আরও বেশি রাজনৈতিক। আমাদের আলোচিত কবি আবদুল হাই শিকদারও একজন রাজনীতি সচেতন কবি। তার রাজনীতি সচেতনতার পরিচয় যেমন মাঠের আন্দোলনে অর্থাৎ কর্মে তেমনি কাব্যেও। সাম্প্রতি কবি রফিক লিটনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে কবি আবদুল হাই শিকদারের ‘রাজনীতি ও বিপ্লবের কবিতা’।
শিরোনাম থেকে বোঝা যায় কবিতাগুলোর মেজাজ। ফলে নতুন করে বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ তুলে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। তবে তার এ গ্রন্থটি পড়লে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি চিত্র পাওয়া যাবে। আমাদের জাতীয় জীবনের অর্জনগুলোকে তুলে এনেছেন তিনি। পাশাপাশি ভুল রাজনীতির চিত্রও দেখা যায়। এমনকি সদ্য পলাতক খুনি হাসিনার ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেই ঘটেছিল, তার কিছু কাব্যিক প্রকাশ পাই কবির ‘এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো’ কবিতায়।
তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো ‘কে সিরাজদৌলা কে মীরজাফর’ এই কবিতার কিছু লাইন পড়া যাক: “শীতের রাতে যেটাকে কাশ্মীরি শাল বলে বার্তা পেয়েছিল জনপদ,/ ভোরের আলো ফোটার আগেই দেখা গেল,/ এ হলো সেই নেকড়ে যে মেষের চামড়া গায়ে জড়াতে জানে।/ ধার্মিকের ভান করে বেড রুমে ঢুকেছে জল্লাদ ট্রয়ের ঘোড়ার মতো মাসুম।” উপমার মাধ্যমে তুলে এনেছেন রাজনীতির ভেতরের গভীর ক্লেদকে। এটাই শিকদারীয় স্টাইল।
তিনি বলেন তার মতো করে। তার এমন আরও দু-একটি কবিতার উদাহরণ উপস্থাপনের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আরও কিছু পঙ্ক্তি: “তুই জঘন্য তুই ইতর/ তুই তোর জন্মদাত্রী জননীকে অপবাদে মলিন করেছিস।/ নিজের সহধর্মিনীকে তুই মহাজনের শয্যায় যেতে বাধ্য করেছিস।/ তুই নপুংসক, তুই অমানুষ।!/ তুই মীরজাফরের চাইতেও নিকৃষ্ট/ তুই মইন ফখরের চাইতেও বেশি বেশি নেড়িকুত্তা!/ তোকে আমি তিন তালাক দিলাম।” (তালাকনামা)
তার আলোচিত কবিতার মধ্যে একটি হলো ‘কসম’। এই কবিতার ভেতরে বিপ্লবের বীজ বপিত ছিল। যা তরুণ সমাজকে আলোড়িত করেছে বিভিন্ন সময়ে, সংগ্রামে, আন্দোলনে। এই কবিতার কয়েকটি লাইন থেকে তার নমুনা মিলবে। “কসম সালাম বরকত রফিক জব্বারের,/ কসম ১৯৭১ সালের,/ কসম কর্ণফুলীর তীরে অপেক্ষমাণ আমাদের ভবিষ্যতের,/ কসম শাহজালালের আজান ধ্বনির,/ কসম আমার মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডার,/ কসম লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রতি ফোঁটা রক্তের,/; কসম কসম কসম আমরা এইসব করবো।/ তারপর জমজমের পানিতে ধুয়ে নেব মাতৃভূমির শ্রান্ত ক্লান্ত ব্যথিত শরীর।” তার ‘সাঈদ’ কবিতাটিও যদি লক্ষ করি সেখানেও দেখব বিপ্লবের সুর : “সাঈদ সাঈদ বলে ডেকে ডেকে পাড়া মাত করি,/ ও পুত্র, বাপ আমার, ফিরে আয় আগ্নেয় মশাল ধরি।” কিংবা “ঘাতকের হাতে রক্ত ঝরছে দেশে,/ আমরা রয়েছি রক্তের পরিবেশে।/ তবু বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছ তুমি,/ তোমার গর্বে কাঁদছে মাতৃভূমি।/ তোমার ছেলেরা তোমার মেয়েরা আজ,/ রক্তে আঁকছে মুক্তির কারুকাজ।/ ফ্যাসিস্ট ঘাতক মানবেই পরাজয়,/ এই তাঁবেদার এ দেশের কেউ নয়।” (স্বদেশ ও সন্তান) আর একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই, “আমার ভাইয়ের রক্তমাখা জুলাই অনিঃশেষ,/ জুলাই তুমি স্বাধীন সকাল তুমিই বাংলাদেশ।” আসলে কবি আবদুল হাই শিকদারের কবিতা মানেও একটি বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ হবে ফ্যাসিবাদমুক্ত, সাম্য, সমতা ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ।
কবি আবদুল হাই শিকদারের ‘রাজনীতি ও বিপ্লবের কবিতা’ সম্পাদনা করার জন্য কবি রফিক লিটনকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই মূল্যবান সংকলনটি আমরা হাতে পেয়েছি। বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা। নান্দনিক প্রচ্ছদ উপহার দিয়েছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। বইটির মূল্য ৪০০ টাকা। ‘রাজনীতি ও বিপ্লবের কবিতা’ আমাদের জুলাই বিপ্লবকে শানিত করুক। ছড়িয়ে পড়ুক রাজনীতি সচেতন পাঠকের হাতে হাতে।
শাহাদাৎ সরকার