Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কম লিখতে চাই, কিন্তু আরও শক্তিশালীভাবে লিখতে চাই: জিয়াওলু গুও

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কম লিখতে চাই, কিন্তু আরও শক্তিশালীভাবে লিখতে চাই: জিয়াওলু গুও

দখলে বিশ্বাস রাখলাম, দায়িত্বে নয়! অনেকটা যেন ডারউইন বলা কথার মতো-‘স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স’; আর ‘সারভাইভ্যাল অব দি ফিটেস্ট’। অর্থাৎ, অস্তিত্বের লড়াই এবং যোগ্যতমের টিকে থাকা ছাড়া ডারউইন প্রাণিজগতে আর কোনো ধর্ম দেখেননি। এমন তত্ত্বের বাইরে গিয়ে নাগরিক, সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের ভূমিকা, আর্থসামাজিক রাজনৈতিকতার লাগোয়া সাংস্কৃতিক যৌথতায় নির্মিত হয় উপন্যাস। যা আসলে জীবনেরই খণ্ডিত টুকরো, সেখানে ব্যবহৃত উপকরণে পাঠক বা গল্পকারেরই যেন হয় ইচ্ছাপূরণ। চীনা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শিক্ষাবিদ জিয়াওলু গুও নিয়ে এসেছেন তার ইচ্ছাপূরণের নতুন উপন্যাস Call Me Ishmaelle। জিয়াওলু গুও’র লেখা এবং চলচ্চিত্রগুলো অভিবাসন, বিচ্ছিন্নতা, স্মৃতি, ব্যক্তিগত যাত্রা, নারীবাদ, অনুবাদ এবং আন্তর্জাতিক পরিচয় অন্বেষণ করে। তার উপন্যাসগুলো ২৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘নাইন কন্টিনেন্টস : আ মেমোয়ার ইন অ্যান্ড আউট অফ চায়না’ ২০১৭ সালে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। ২০১৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারের জুরি সদস্য ছিলেন জিয়াওলু গুও। তার নতুন উপন্যাস Call Me Ishmaelle মূলত হারম্যান মেলভিলের Moby-Dick-এর পুনঃকথন। নিজের নতুন উপন্যাস নিয়ে গার্ডিয়ানের সঙ্গে জিয়াওলু গুও’র কথোপকথন অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন।

আপনার নতুন উপন্যাস Call Me Ishmaelle-এর জন্য হারম্যান মেলভিলের ১৮৫১ সালের ক্লাসিক Moby-Dick নিয়েছিলেন কেন?

: নিউইয়র্কে আমি একজন বিদেশি হিসাবে বছরের পর বছর কাটিয়েছি। আমি যখন কলাম্বিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলাম তখনই আমি আমার স্মৃতিকথা ‘র‌্যাডিক্যাল’ লিখছিলাম। এটি ছিল একটি প্যারালাল প্রজেক্ট; এক ধরনের দার্শনিক পরীক্ষা। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই এশীয়-প্রায় ৬০%। আমি যখনই একটি উপন্যাস লিখি, আমি ভাবি, একজন অ-পাশ্চাত্য ব্যক্তি, যে বাইবেলের প্রভাবিত সংস্কৃতি থেকে আসেনি, সে কীভাবে পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক ধ্রুপদীর সঙ্গে সংলাপে অংশ নিতে পারে? হারম্যান মেলভিলের Moby-Dick-এ বারবার ‘ক্রিস্টেনডম’ শব্দটি এসেছে। আমি ভাবলাম : যদি কেউ কখনো এটি কী তা না জানত? যদি সেখানে ‘তাওবাদ’ লেখা থাকত, তাহলে কি আপনি গল্পটি শুনতেন? আমি একজন গেরিলা উদ্যানপালক, অর্থাৎ গাছ লাগানোর অধিকার না থাকলেও আমি গোপনে আমার আশপাশে গাছ লাগাই-আর এ ব্যাপারটিই আমাকে ভাবতে বাধ্য করল : আমি কি কোনোভাবে প্রাচীন পূর্ব এশীয় দর্শনকে এই আমেরিকান প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসতে পারি? গেরিলা ধ্বংসযজ্ঞ। আমি চেয়েছিলাম পুরো পৃথিবী যেন সেই জাহাজে থাকে। আমি প্রচুর সময় ব্যয় করেছি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেনকে (গৃহযুদ্ধের সময়কার) একজন চীনা তাওবাদী নৌকা মিস্ত্রির সঙ্গে সংলাপে আনার উপায় বের করতে।

বইয়ের নামে টুইস্ট লক্ষ করছি। কেন ইশমায়েল নয়, বরং ইশমায়েলে?

: আমি শ্রমজীবী ভিক্টোরিয়ান মেয়েদের গল্প পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম, যারা দারিদ্র্য ও হতাশা থেকে সমুদ্রে পাড়ি জমাত। আমি অ্যান জেন থর্নটনের কাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি, যিনি ১৫ বছর বয়সে নিউইয়র্কের এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই মেয়েরা শুধু আর একটু বাঁচতে চেয়েছিল : সেজন্য তারা কেবিন বয়ের পোশাক পরত, চুল কেটে জাহাজে উঠে পড়ত। তাদের অনেককেই তখনই আবিষ্কার করা হতো, যখন তারা গর্ভবতী হয়ে যেত : ক্যাপ্টেন জানত না, কারণ যখন একটি মেয়ে ধরা পড়ত, তখন নাবিকরা তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ত-এটি ছিল এক ধরনের গোপন চুক্তি। এ ঘটনাগুলো আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, আমি প্রায় নৌযাত্রার বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলাম : আমি ইশমায়েলের যাত্রা লিখতে চেয়েছিলাম, ইশমায়েলে থেকে ইশমায়েল, তারপর আবার ইশমায়েলে।

বিষয়বস্তুর দিক থেকে বইটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী মনে হলেও শৈলীতে এটি আপনার আগের বইগুলোর তুলনায় আরও ঐতিহ্যবাহী মনে হয়। কেন?

: আমি আর উপন্যাস লেখার প্রয়োজনীয়তা দেখিনি, বিশেষ করে A Lover's Discourse (যেটি ২০২০ সালে পরীক্ষামূলক কথাসাহিত্যের জন্য গোল্ডস্মিথস পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল) লেখার পর। সমসাময়িক কথাসাহিত্যের অতিরিক্ত উৎপাদিত অপ্রয়োজনীয়তা আমাকে এক ধরনের বিরক্তিতে ভুগিয়েছিল। আমার ‘গল্প’ গ্রহণের তেমন আগ্রহ নেই; বরং সত্যের সঙ্গে বিতর্ক, সংলাপের প্রয়োজন অনুভব করি। আমি আরও চিন্তা করতে চাই, কম লিখতে চাই, এবং রাজনৈতিকভাবে নয় বরং দার্শনিক ও কাব্যিকভাবে বিষয়গুলোর মুখোমুখি হতে চাই। কম লিখতে চাই, কিন্তু আরও শক্তিশালীভাবে লিখতে চাই। তবে এই বইটিতে-যেটি আমার লেখা সবচেয়ে বড় বই-চরিত্রগুলো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমি স্বীকার করছি, এই প্রথমবারের মতো আমি আবার কথাসাহিত্যের নেশায় ফিরেছি... পৌরাণিক কাহিনির প্রতি আমাদের আকর্ষণ যেন মানবজাতির এক অসুখ।

আপনি প্রথমবার Moby-Dick পড়ার অভিজ্ঞতা মনে করতে পারেন?

: আমি এটি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চীনে) অনুবাদ পড়েছিলাম। চীনা ভাষায় শেকসপিয়রীয় ও বাইবেলের ভাষা সম্পূর্ণ বিমূর্ত ও অর্থহীন হয়ে যায়-এটি এতটাই কঠিন হয়ে পড়ে যে, আপনি পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। দ্বিতীয়বার, নিউইয়র্কে পড়ার সময়ও এটি আমার কাছে কঠিন লেগেছিল, বিশেষ করে বিশাল সিটোলজি অধ্যায়, যা ইংরেজি পাঠকদের জন্যও কঠিন। এটি প্রি-উইকিপিডিয়া লেখার ধরনের মতো আজকাল কেউ এভাবে উপন্যাস লিখত না, কিন্তু মেলভিল কেবল কাহিনি একত্রিত করে চলেন। আমি বরং প্রকৃত সামুদ্রিক অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দিতাম। তিনি এসেক্স তিমি শিকার ট্র্যাজেডির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন-যেখানে জাহাজডুবির শিকার নাবিকরা একে অপরকে খেতে শুরু করেছিল-এবং আমি মনে করি জাহাজের প্রথম সহকারী ওয়েন চেজের স্মৃতিকথা Moby-Dick দশবার পড়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল গবেষণার জন্য।

আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে, কোন ধারায় কাজ করবেন?

: যিনি শব্দশিল্পী নন এই প্রশ্নটি এমন একজন লেখকের জন্য কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ লেখক শব্দশিল্পী-তারা কয়েক বছর পরপর একই গল্পগুলো নতুন করে আবিষ্কার করেন-যদিও আমি নিজেকে লেখক মনে করি না। আমি কিছু ভাবি এবং তার সঙ্গে খেলি : আমি একটি চলচ্চিত্র তৈরি করি এবং ভাবি, ওহ, এটি আসলে গদ্য, স্মৃতিকথা বা কবিতা। আমি ধারণানির্ভর। আমার আগের অনেক কাজ আমার জীবনের কাছাকাছি ছিল, কারণ যখন আমি পশ্চিমে এলাম (২০০২ সালে), তখন হঠাৎ করে আমি আবার একজন তরুণী হয়ে গেলাম এবং ইউরোপে একজন নারী হিসাবে নিজেকে আবিষ্কারের জন্য আমি দীর্ঘকালীন কৈশোর কাটালাম। পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি উপলব্ধি করলাম যে, আমি সত্যিকারের ইতিহাসের গভীরে কখনো যাইনি। মানুষ বদলায় : টলস্টয় ৫০ বছর বয়সে নিরামিষভোজী হয়েছিলেন, যদিও তিনি ৫০ বছর ধরে রাশিয়ান সসেজ ও মাংস খেয়ে আসছিলেন! The Anglo-Saxon Chronicle এবং The Domesday Book পড়ে My Battle of Hastings লেখার মাধ্যমে গত ১,০০০ বছরে ক্ষমতার গতিবিদ্যা সম্পর্কে আত্মশিক্ষার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম; এটি আমাকে Moby-Dick প্রকল্পের জন্য আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে আপনি কী পড়ছেন?

: গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ’র Lyrical Ballads পড়ছি। কোলরিজকে আমি অনেক দিন ধরে পড়ছি, বিশেষ করে ‘কুবলা খান’ কবিতার জন্য। যখনই কোনো পশ্চিমা লেখক এশিয়া সম্পর্কে লেখেন, তখন একটা উদারতার অনুভূতি জাগে। ‘হ্যাঁ, ভাই, ধন্যবাদ! তুমি পূর্বকে উল্লেখ করেছ, আমি এখন তোমার কাজগুলো পড়ব এটা বোঝার জন্য কেন তুমি এটি করেছ।’ প্রতিদিন রাতে কোলরিজ পড়া যেন এক স্বপ্নের ভাষার মতো লাগে। আর ওয়ার্ডসওয়ার্থ অনেক বেশি যৌক্তিক, গঠনতান্ত্রিক।

শেষ যে বইটি আপনি কাউকে উপহার দিয়েছেন?

: থমাস হার্ডির ‘টেস অব দ্য ডি’আর্বারভিলস’, যেখানে ব্রিটিশ উপন্যাসের অন্যতম মৌলিক নারী চরিত্র রয়েছে। বহু বছর ধরে আমি ডি.এইচ. লরেন্সকে ভালোবাসতাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম তার গদ্যের উৎস কোথায়, আর তাই হার্ডির কাছে ফিরে গিয়েছিলাম-অসাধারণ! সেই একই সপ্তাহে আমি কাউকে জন ফাওলসের ‘দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট’স ওম্যান’ উপহার দিয়েছিলাম। আমার বাসায় ওই বইয়ের তিনটি কপি ছিল, যাতে সহজেই হাতের কাছে রাখা যায়, কারণ আমি উপন্যাসটি খুব ভালোবাসি। লাইম রিজিস ভ্রমণের পর আমি আবার এটি পড়ে ফেললাম, যেখানে উপন্যাসটির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। ইচ্ছা হয়, এখনো যদি সে ধরনের উপন্যাস লেখা হতো-ভাবনা ও আখ্যান, শুধু আখ্যান নয়।

সূত্র : দি গার্ডিয়ান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম