
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম

মূল : গ্রায়েম গ্রিন, অনুবাদ : কাজী জাওয়াদ
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
আটজন জাপানি ভদ্রলোক বেন্টলি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবারে মাছ খাচ্ছিলেন। অস্ফুট স্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন, খুব কম, কিছু বললে কথার শেষে মুচকি হাসছিলেন আর মাথা সামান্য নুইয়ে অভিবাদন করছিলেন। একজন ছাড়া তাদের সবার চোখে চশমা। একটু দূরে বসা সুন্দরী মেয়েটির চোখ মাঝে মাঝে তাদের ওপর পড়ছিল, কিন্তু নিজের ও সঙ্গী ছেলেটির গভীর সমস্যার জন্য নিজেদের ছাড়া বিশ্বের অন্য কারও দিকে ভালো করে নজর দেওয়ার সময় তাদের ছিল না।
মেয়েটির মাথায় পাতলা সোনালি চুল, মুখটা রিজেন্সি যুগের (১৮১১ থেকে ১৮২০-এর সময়ে সৃষ্ট সৌন্দর্য, ফ্যাশন, স্থাপত্য ও চিত্রকলার নতুন ধারা। -অনুবাদক) অণুতৈলচিত্রে রমণীদের মতো ছোট্ট সুন্দর। গলার স্বর কিছুটা কর্কশ- হয়তো রোডিন বা চেল্টেনহ্যাম লেডিস কলেজ থেকে শেখা। সে ছাত্রী ছিল বেশিদিন আগে নয়। সিলমোহরের মতো নকশা খোদাই করা ছেলেদের আংটি পরেছিল বাম অনামিকায়। আমার ও তাদের টেবিলের মাঝখানে জাপানিদের টেবিল। মেয়েটিকে বলতে শুনলাম, ‘বুঝতে পারছ, আমরা আগামী সপ্তাহে বিয়ে করতে পারি।’
‘হ্যাঁ?’
সঙ্গী ছেলেটিকে বিহ্বল মনে হলো। সে দুজনের গ্লাসে ফরাসি শাবলি মদ ঢেলে বলল, ‘অবশ্যই, কিন্তু মা...’ তাদের কিছু কথা শুনতে পেলাম না কারণ সবচেয়ে বয়েসি জাপানি লোকটি টেবিলের ওপর ঝুঁকে, মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নুইয়ে, পাখির খাঁচা থেকে আসা কিচিরমিচির শব্দের মতো করে যেন পুরো এক অনুচ্ছেদ পড়ল। টেবিলের সবাই তার দিকে ঝুঁকে মৃদু হেসে তার কথা শুনছিল। আমি নিজেও তার কথা না শুনে পারছিলাম না।
ছেলেটিও দেখতে মেয়েটির মতোই। দুজনকে দেখতে লাগছিল সাদা কাঠের দেওয়ালে পাশাপাশি রাখা দুটো অণুতৈলচিত্র। সে নেলসনের নৌবাহিনিতে তরুণ কর্মকর্তা হতে পারত, যখন সামান্য শারীরিক অক্ষমতা পদোন্নতির জন্য কোনো বাধা ছিল না।
মেয়েটি বলল, ‘তারা আমাকে পাঁচশ পাউন্ড অগ্রিম দেবে। সুলভ সংস্করণের স্বত্ব এর মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে।’ নিরেট ব্যবসায়িক কথাগুলো আমাকে অবাক করল, আরও অবাক হলাম সে আমার পেশারই একজন বলে। বয়স বড়জোর বিশের সামান্য বেশি। একটা সুন্দর জীবন তার প্রাপ্য।
ছেলেটি বলল, ‘কিন্তু আমার চাচা...’
‘তুমি জানো তার সঙ্গে তোমার মেলে না। এতে আমরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারব।’
‘তুমি স্বাধীন হবে,’ নারাজ হয়ে সে বলল।
‘মদের ব্যবসা আসলে তুমি চালাতে পারবে না, পারবে? তোমার ব্যাপারে আমার প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলেছি, সেখানে ভালো সুযোগ আছে... তুমি যদি প্রুফ রিডিংয়ের কাজ শুরু করো...’
‘কিন্তু আমি বই সম্মন্ধে কিছু জানি না।’
‘প্রথম প্রথম আমি তোমাকে সাহায্য করব।’
‘মা বলে লেখালেখিতে ভালো টাকা পাওয়া যায়...’
‘পাঁচশ পাউন্ড আর সুলভ সংস্করণের অর্ধেক স্বত্ব বেশ ভালো টাকা,’ মেয়েটি বলল।
‘শাবলি মদটা ভালো, তাই না?’
‘মনে হয়।’
ছেলেটার সম্মন্ধে আমার মনোভাব বদলাতে শুরু করেছিলাম-সে নেলসন বাহিনির মতো না। তার কপালে পরাজয় অবধারিত। মেয়েটি তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলল। ‘জানো মি ডোয়াইট কী বলেছে?’
‘ডোয়াইট কে?’
‘জানু, তুমি কোনো কথা শুনছ না, শুনছ? আমার প্রকাশক। সে বলেছে, গত দশ বছরে কোনো নতুন লেখকের এত গভীর পর্যবেক্ষণের প্রথম উপন্যাস সে পড়েনি।’
‘চমৎকার,’ মন খারাপ করে ছেলেটি বলল, ‘চমৎকার।’
‘সে শুধু আমাকে নামটা বদলে দিতে বলেছে।’
‘তাই?’
‘সে এভার রোলিং স্ট্রিম নামটা পছন্দ করছে না। চেলসি সেট নাম রাখতে চাইছে।’
‘তুমি কী বলেছ?’
‘আমি রাজি হয়েছি। আমি মনে করি প্রথম উপন্যাসের ব্যাপারে প্রত্যেকেরই প্রকাশককে খুশি রাখা উচিত। বিশেষ করে যখন সে আসলেই আমাদের বিয়ের খরচ দিচ্ছে, তাই না?’
‘বুঝলাম তুমি কী বলতে চাইছ।’
ছেলেটি আনমনা হয়ে একটা কাঁটাচামচ দিয়ে মদ নাড়ছিল-হয়তো বাগদানের আগে সে সব সময় শ্যাম্পেন কিনত। জাপানি লোকগুলোর মাছ খাওয়া শেষ হয়েছে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অত্যন্ত বিনীত হয়ে তারা মাঝবয়েসি পরিচারিকাকে তাজা ফলের সালাদ আনতে বলছিল। মেয়েটি তাদের দিকে তাকাল তারপর আমার দিকে তাকাল, কিন্তু মনে হয় সে শুধু ভবিষ্যৎ দেখছিল। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল তাকে বলি চেলসি সেট নামের কেবল একটি উপন্যাসের ওপর ভর করে সে যেন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা না করে। আমি ছেলেটির মায়ের দলেই ছিলাম। চিন্তাটা অবমাননাকর, কিন্তু আমি হয়তো তার মায়েরই বয়েসি।
মেয়েটিকে বলতে চেয়েছিলাম, তুমি কি নিশ্চিত জান তোমার প্রকাশক সত্যি কথা বলছে? প্রকাশকরা মানুষ। তারা কখনো কখনো কমবয়েসি সুন্দরী মেয়েদের গুণের প্রশংসা বাড়িয়ে করতে পারেন। চেলসি সেট কি পাঁচ বছরের মধ্যে কেউ পড়বে? তুমি কী অনেক বছর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার, অনেক বছর ভালো কিছু লিখতে না পারার বা জীবনের পরাজয় মেনে নেওয়ার মতো প্রস্তুত? বছরগুলো চলে যেতে যেতে লেখা কিন্তু সহজ হবে না, প্রতিদিনের পরিশ্রম ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠবে, ‘পর্যবেক্ষণের ওই ক্ষমতাগুলো’ আবছা হয়ে যাবে। বয়স চল্লিশ পার হলে তোমার মধ্যে কী সম্ভাবনা আছে তা দিয়ে নয়, কেমন কাজ করেছ তা দিয়ে তোমাকে বিচার করবে।
‘পরের উপন্যাসটি লিখব সেন্ট ট্রোপেজের ঘটনা নিয়ে।’
‘জানতাম না তুমি সেখানে গিয়েছ।’
‘যাইনি। কিন্তু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা খুব দরকার। ভাবছিলাম, আমরা সেখানে মাস ছয়েক থাকতে পারি।’
‘ততদিনে আগাম পাওয়া টাকাটার খুব একটা থাকবে না।’
‘আগাম তো শুধু আগাম। পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হলে আমি শতকরা পনেরো টাকা পাব, দশ হাজারের বেশি বিক্রি হলে শতকরা বিশ। জানো, পরের বইটা লেখা হয়ে গেলে আরেকটা আগাম পাওনা হয়ে যাবে। চেলসি সেট ভালো বিক্রি হলে আগামটাও বেশি হবে।’
‘ধরো, যদি বিক্রি না হয়।’
‘মি ডোয়াইট বলেছে বিক্রি হবে। তার জানার কথা।’
‘চাচা শুরুতেই মাসে বারোশ করে দেবে।’
‘জানো, তাহলে তুমি সেন্ট ট্রোপেজে আসবে কী করে?’
‘তাহলে তুমি ফিরে আসার পর বিয়ে করাই হয়তো ভালো হবে।’
‘চেলসি সেট যথেষ্ট বিক্রি হলে আমি হয়তো ফিরে আসব না,’ মেয়েটি রূঢ়ভাবে বলল।
‘ওহ্।’
মেয়েটা আমার ও জাপানি দলটার দিকে তাকাল। মদটা শেষ করল। বলল, ‘আমরা কি ঝগড়া করছি?’
‘না।’
‘আমি পরের বইটার নাম ঠিক করেছি-আকাশি নীল।’
‘আমি জানতাম আকাশি মানেই নীল।’
চোখে হতাশা নিয়ে মেয়েটা তাকাল ছেলেটার দিকে। ‘তুমি আসলে একজন ঔপন্যাসিককে বিয়ে করতে চাও না। তাই না?’
‘তুমি এখনো ঔপন্যাসিক হওনি।’
‘মি ডোয়াইট বলেছে, আমি জাত ঔপন্যাসিক। আমার দেখার ক্ষমতা...’
‘হ্যাঁ, তুমি আমাকে বলেছ। কিন্তু, জানো, তুমি কী বাড়ির কাছাকাছি, লন্ডনে পর্যবেক্ষণ করতে পার না?’
‘চেলসি সেটে করেছি। আবার তা করতে চাই না।’
বিলটা তাদের সামনে অনেকক্ষণ পড়েছিল। দাম মেটানোর জন্য ছেলেটা ওয়ালেট বের করল। কিন্তু মেয়েটা চট করে কাগজটা সরিয়ে নিল। বলল, ‘উৎসবটা আমার।’
‘কীসের উৎসব?’
‘অবশ্যই চেলসি সেট, জানো, তুমি খুব ভালো, কিন্তু মাঝে মাঝে তুমি একদম বোঝ না।’
‘আমি না হয়... যদি কিছু মনে না কর...’
‘না, জানো, এবার আমি দেব। আর হ্যাঁ, মি ডোয়াইটও।’
দুজন জাপানি একসঙ্গে কিচিরমিচির কথা বলছিল, হঠাৎ করে থেমে মাথা নুইয়ে একে অন্যকে এমনভাবে অভিবাদন করল যেন দরজায় একজন অন্যজনের পথ আটকে রেখেছে। ঠিক সে সময়ে ছেলেটি মেয়েটির কথা মেনে নিল।
আমি ভাবছিলাম একই রকম অণুচিত্রের মতো দেখতে দুটো অল্প বয়েসি ছেলেমেয়ে, কিন্তু তারা কত বিপরীত। একই রকম সৌন্দর্য সবল ও দুর্বল দুই-ই হতে পারে। মেয়েটির সমকক্ষ একজন রিজেন্সি যুগের সুন্দরী হয়তো চেতনানাশকের সাহায্য ছাড়াই ডজনখানেক বাচ্চার জন্ম দিত, ছেলেটি হয়তো নেপলসে প্রথম দেখা কোনো গভীর কালো চোখের শিকার হতো। মেয়েটির তাকে এক সময় এক ডজন বইও কী থাকবে? সেগুলো কী যন্ত্রণানাশক ছাড়াই লেখা হবে? বুঝতে পারলাম, মনে মনে আশা করছি চেলসি সেট যেন লোকসানের শিকার হয় এবং শেষ পর্যন্ত সে ফটোর মডেল হয়। ছেলেটি যেন সেন্ট জেমসে মদের ব্যবসায় খুব ভালো করে। মেয়েটি যেন নিজের যুগে মিসেস হাম্ফ্রি ওয়ার্ড (১৮৫১-১৯২০, ভিক্টোরীয় যুগের সফল ওইপন্যাসিক)-এর মতো না হয়-এমন ভাবতে চাইছিলাম না, ততদিন হয়তো বাঁচবও না। আমাদের অনেক আশঙ্কা সত্যি হতে দেখা থেকে বাঁচিয়ে দেয় বার্ধক্য। ভাবছিলাম মি ডোয়াইট কোন প্রকাশনা। ভাবছিলাম সে মলাটের ভাঁজে মেয়েটির পরিচিতিতে তার দেখার গভীর ক্ষমতা সম্বন্ধে কী লিখে ফেলেছে তাই নিয়ে। লোকটি বুদ্ধিমান হলে শেষ প্রচ্ছদে হয়তো মেয়েটির একটি ছবি থাকবে, কারণ প্রকাশকরাও মানুষ আর মেয়েটি দেখতে মিসেস হাম্ফ্রি ওয়ার্ডের মতো না।
রেস্তোরাঁর পেছন দেওয়াল থেকে কোট নিয়ে আসার সময় তাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম।
‘জাপানিরা এখানে কী করছে?’ ছেলেটি বলছিল।
‘জাপানি?’ মেয়েটি বলল, ‘কোথায় জাপানি, জান? মাঝে মাঝে তুমি এত হেয়ালী করো, আমার মনে হয় তুমি আমাকে একদমই বিয়ে করতে চাও না।’