মধ্যযুগের বিতর্কিত আরবি কবি আল-মা’রি

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মধ্যযুগের অন্যতম আরবি কবি ‘আল-মা’রি (৯৭৩-১০৫৭) মা’রাত আল-নুমান নামে সিরিয়ার এক জনবহুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার কবিতায় আল্লাহ, ধর্ম, জীবন ও মৃত্যুর মতো বিষয়গুলো নিয়ে জটিল দার্শনিক প্রশ্ন তুলতেন। সেজন্য তিনি ‘দার্শনিকদের কবি এবং কবিদের দার্শনিক’ হিসাবে পরিচিত। তার সেরা সাহিত্যকর্ম ‘রিসালাত আল-গুফরান’ (‘মার্জনার বার্তা’ বা ইংরেজিতে ‘দ্য এটিস্টল অফ ফরগিভনেস’), যার মধ্যে যেসব কবি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেননি, অর্থাৎ পৌত্তলিক যুগের কবি ছিলেন, তারা বেহেশত ও দোজখে কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন, সে সম্পর্কিত বর্ণনা করা হয়েছে। তার এ গ্রন্থকে পরবর্তীতে ইতালির দার্শনিক কবি ও লেখক দান্তের (১২৬৫-১৩২১) ‘ডিভাইন কমেডি’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এছাড়া ‘আল-ফুসুল ওয়া আল-ঘায়াত’ (‘অনুচ্ছেদ ও সময়কাল’) নামে তার আরেকটি সাহিত্যকর্মকে কুরআনের প্যারোডি বিবেচনা করা হয়।
ইসলামি বিদগ্ধ পণ্ডিতরা কবি আল-মারিকে ধর্মদ্রোহী বিবেচনা করলেও অনেকেই তার এ দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছেন এবং তারাও যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ইসলাম-পূর্ব যুগের কবিরাও অবশ্যই বেহেশতে যাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
তার পুরো নাম ছিল আবুল আলা আহমদ ইবনে আবদ-আল্লাহ আল-মা’রি। সবকিছুর মাঝে আল মা’রি একজন বিষণ্ন কবি ছিলেন। অন্ধত্ব ও নিঃসঙ্গতার কারণে তিনি নিজেকে বর্ণনা করতেন একজন ‘দ্বৈত বন্দি’। বলা হয় যে, তিনি ধ্বংসবাদে বিশ্বাস করতেন। কারণ তার কাছে জীবন ছিল অন্তর্নিহিতভাবে অর্থহীন এবং পৃথিবীতে অবস্থানকালে আমরা যা করি এবং যা বিশ্বাস করি, সেজন্য অনন্ত থেকে আমরা কিছু পাই না। তবে প্রত্যাশার বিপরীতে, আল মা’রি আনন্দবাদীও ছিলেন না, বরং তিনি একজন নিষ্ঠাবান নৈতিকতাবাদী ছিলেন। শান্তিবাদী হিসাবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধ কখনো ভালো কিছু দেয়নি, বরং মানুষে মানুষে ঘৃণা সৃষ্টি করেছে। তিনি নিরামিষ ভোজন করতেন এবং প্রাণিজ খাদ্য অর্থাৎ মাছ, মাংস, ডিম, এমনকি দুধ ও মধু খাওয়ার বিরুদ্ধে বলতেন। এ সম্পর্কে তিনি তার ‘প্রকৃতি থেকে আমি চুরি করি না’ কবিতায় লিখেছেন-
“পানি থেকে মাছ ধরে খেয়ো না, পশুর মাংশ খাওয়া ইচ্ছা করো না,
নিরীহ পাখির ডিম নিয়ে ওদের দুঃখ দিয়ো না; অন্যায় মন্দ অপরাধ,
সুবাসিত ফুল থেকে প্রচুর শ্রমে আহরিত মৌচাকের মধু গ্রহণ বন্ধ করো,
মৌমাছিরা তো অন্য কারো উপকার করার জন্য মধু সংগ্রহ করে না।
এসব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি, চুল পাকা পর্যন্ত এমন থাকতে চাই।”
মৃত্যুর হাজার বছর পর মা’রির ওপর আক্রোশ :
বেচারা অন্ধ কবি আল-মা’রি। আল্লাহ পরম করুণাময় ও ক্ষমা প্রদর্শনকারী হলেও তার একদল বিভ্রান্ত বান্দা আরবি ভাষার বিখ্যাত কবি আল-মা’রির মৃত্যুর ৯৫৬ বছর পর তার ওপর আক্রোশ ঝাড়ে ২০১৩ সালে। মা’রি জীবদ্দশাতেও কষ্টের মধ্যে ছিলেন। চার বছর বসন্ত রোগে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। অন্ধ মানুষের জীবন কেমন তা এমনকি যারা অন্ধ নন, তারাও অবগত। যে কবি কুরআনের ভাষায় কবিতা লিখতেন, সেই কবির মৃত্যুর ৯৫৬ বছর পর সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আল-মা’রির জন্মস্থান ‘মা’রাত আল-নুমান’ শহরের কেন্দ্রীয় জাদুঘরের কাছে ১৯৪০-এর দশকে স্থাপিত ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি ভাস্কর্য ধ্বংস করে ফেলে জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএস-এর সদস্যরা।
এ ধ্বংসের পেছনে একটাই কারণ ছিল, তা হলো, আইএসআইএস-এর কাছে কবি আল-মা’রি ছিলেন নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দিকের অন্যতম নাস্তিক ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন শিল্পকলা বিষয়ক সিরীয় ইতিহাসবিদ নাসের রাবাত। আল-মারি যেসব ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন, তা ফুটে ওঠে তার এ লাইনগুলোতে-
“লাতাকিয়ায় (সিরীয় বন্দর) আহমদ (মুহাম্মদ) ও মসীহ’র (যিশু) মধ্যে কলহ,
একজন বাজাচ্ছে ঘণ্টা, অন্যজন তার মিনার থেকে বিশ্বাসীদের আহ্বান করছে,
প্রত্যেকে ঘোষণা করে নিজ নিজ বিশ্বাসের মহিমা। আমাকে বলো, কোনটি সত্য?”
তিনি ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচর্চা নিয়ে হাস্যপরিহাস ও কট্টর সমালোচনা করতেন। ইহুদি, খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম, জরোষ্ট্রিয়বাদ-কোনো ধর্মই তার সমালোচনার বাইরে ছিল না। আল-মা’রি স্থানীয় তরুণদের প্রিয়ভাজন ছিলেন। ধর্মীয় মতবাদের বাইরে তিনি মুক্তচিন্তা করতেন। তার দৃষ্টিতে ধর্মীয় মতবাদ এবং সামাজিক রীতিনীতি ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশের পথে বাধা ও ব্যক্তির সামর্থ্যকে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখে। তিনি তার অনুসারীদের শেখাতেন যে, ধর্ম প্রাচীনকালে আবিষ্কৃত কল্পকাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়। যারা ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারণা করতে পারে, কেবল তাদের কাছেই ধর্ম মূল্যবান।
তিনি গেরুয়া রঙের বস্ত্র ধারণ করতেন। এ সম্পর্কে আল-মা’রি বলেছেন, ‘আমি যখন অসুস্থ’ ছিলাম, তখন আমাকে ‘কুসুম’ ফুলের (‘স্যাপ্লাওয়ার’-লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের এক ধরনের ফুল) রঙের জামা পরিধান করাতেন। অন্ধ হওয়ার আগে আমি শেষবার এ রং দেখেছি।’ বারো বছর বয়সে তিনি কবিতা রচনায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এরপর তিনি ভাষা, ইতিহাস এবং চিঠি লেখার কৌশল আয়ত্ত করেন। ১০০৭ সালে মা’রি বাগদাদ গিয়ে সেখানে বসবাসের কথা ভাবেন। কিন্তু সেখানে আব্বাসীয় অভিজাতদের বর্ণাঢ্য, আয়েশি জীবনের সমালোচনা করে বাগদাদের সাহিত্যমহলে এই মর্মে বিতর্কিত হন যে, তিনি পরিশীলিত ব্যক্তি হতে পারেননি। তিনি বাগদাদ ছেড়ে আলেপ্পো ফিরে আসেন। এরপর থেকে ১০৫৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি নিজেকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন।
তিনি তার অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন-
“নতুন পৃথিবীর নিয়ম সম্পর্কে আমাকে কিছু বলো না,
সেগুলো যতো মন্দই হোক না কেন, স্বয়ং আমিই তো
আমার তিনটি কয়েদখানায় এখানে আটকে আছি:
আমার অন্ধত্ব, আমার নিজের আরোপিত নিঃসঙ্গতা,
এবং একটি কুৎসিত দেহে আমার আত্মার কারাগার।”
আল-মা’রির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে মুসলিম কট্টরপন্থিদের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখনো আরবি সাহিত্যে অন্যতম প্রভাবশালী কবির মর্যাদায় আসীন। তার গদ্যও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তার রচনা ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও এবং তিনি তাদের কাছে নিন্দনীয় বিবেচনা হওয়া সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে আব্বাসীয় শাসকরা তার বিরুদ্ধে কখনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবেননি। তার বিরুদ্ধবাদীরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ ও উপহাস করলেও তার কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করেননি। সেজন্য এখনো আল মা’রি আরব জগতে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে তাৎপর্যপূর্ণ হেঁয়ালি হিসাবে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন। এখনো তার সাহিত্য ব্যাপকভাবে ইতিবাচক সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি করে, যা নতুন প্রজন্মের আরবি কবি সাহিত্যিককে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে এবং সত্যের সন্ধানে তাদের অদ্ভুত এক অন্তর্দৃষ্টি দেয়।
আল-মা’রির কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ-
“মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও জরোষ্ট্রিয়-সবাই বিভ্রান্ত,
মানবতা দুটি বিশ্বব্যাপী নিয়মরীতি অনুসরণ করে:
একটি হচ্ছে, মানুষ ধর্ম ছাড়া বুদ্ধিমান,
দ্বিতীয়ত: বুদ্ধিহীন ধার্মিক।”
“নবীরাও আমাদের মাঝে শিক্ষা দিতে আসেন,
মিম্বর থেকে যারা খুতবা দেয়, তিনি তাদের সাথে,
তারা ইবাদত ও হত্যা করেন এবং একসময় চলে যান,
তবুও আমাদের সমস্যা এখনো সৈকতে নুড়ির মতো,
সত্যের ওপর ইসলামের একচেটিয়া অধিকার নেই।
“ওহে মূর্খেরা, জাগো! যেগুলো তোমরা পবিত্র রীতি বলো,
সেসব রীতি প্রাচীন যুগের মানুষের প্রতারণার কৌশল,
যারা সম্পদের পেছনে ঘুরে তাদের লালসা পূর্ণ করে
তাদের অপকর্মে তারা মৃত, তাদের আইন মিশেছে ধুলায়।”
“মোহাম্মদ অথবা যিশু! তোমরা আমার কথা শোনো,
এখানে বা সেখানে পুরো সত্য হতে পারে না;
আমাদের ইশ্বর, যিনি সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন,
কীভাবে তিনি কাউকে আলো দেন, আর আমি দেখতে পাই না।”