Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ইতিহাসের গল্প

Icon

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান সময়ের একজন মেধাবী গল্পকার ও পরিশ্রমী গদ্যকার সাইফুর রহমান। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিচিত্র শাখা থেকে তিনি তুলে আনেন আগ্রহ উদ্দীপক ও ব্যতিক্রমী তথ্যপ্রবাহ এবং সরস ও গতিময় ভাষায় পরিয়ে দেন শিল্পপোশাক। সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘ইতিহাসের গল্প’ বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১৪টি বৈচিত্র্যময় প্রবন্ধ নিয়ে গ্রন্থটি সজ্জিত হয়েছে। প্রবন্ধের নামগুলো বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ‘আশ্চর্য বৃক্ষ ও সম্রাট নেবুচাঁদ নেজারের ঝুলন্ত বাগান’, ‘ঘৃণাভরে ঘুস প্রত্যাখ্যান করলেন আলকজান্ডার’, একজন বীর, একটি বই ও বিশাল সাম্রাজ্য’, ‘দারিয়ুসের তিল বনাম আলেকজান্ডারের সরষে’, ‘জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি’, ‘নিঃসঙ্গবাসে জুল ভার্ন, হুমায়ূন আহমেদ ও ডিকেনসন’, ‘অ্যালিস মুনরো এ সময়ের চেকভ কিংবা রবীন্দ্রনাথ’, ‘নোবেল বিতর্ক রবীন্দ্রনাথ ও ড. ইউনূস’, ‘পুরুষশ্রেষ্ঠ ও নলখাগড়া বনের রাজা’, ‘কবি নজরুলের কোমরে দড়ি ও প্রতিবাদের ভাষা’, ‘নজরুল ছিলেন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও’ ‘ফ্যাসিস্ট সরকার পতনে কবি সাহিত্যিকদের অবদান’ প্রভৃতি। প্রবন্ধের নাম থেকে বোঝা যাচ্ছে ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ গ্রন্থটিতে আকর্ষণীয় রূপে উঠে এসেছে। ‘আশ্চর্য বৃক্ষ ও সম্রাট নেবুচাঁদ নেজারের ঝুলন্ত বাগান’ প্রবন্ধে ৬২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ব্যবিলনের ঘটনাপ্রবাহ স্থান পেয়েছে। রানি আমিতিসকে খুশি করার জন্য ব্যবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাঁদ নেজার তৈরি করেছিলেন ভূমি থেকে প্রায় ৭৫ ফিট ওপরে এক আশ্চর্য ঝুলন্ত বাগান, যা আজও মানুষের বিস্ময় জাগায়। এ ছাড়া এ প্রবন্ধে রাজা চতুর্দশ লুই, মুঘল সম্রাট বাবর, জাহাঙ্গীর ও আকবর প্রমুখের উদ্যানপ্রীতি ও নান্দনিক ভাবনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি অরণ্য ও বৃক্ষকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাহিত্যিক নজির লেখক হাজির করেছেন দারুণ দক্ষতায়। প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস আরণ্যক থেকে শুরু করে লোকজ সাহিত্য, পুরাণ ও ধর্মীয় গ্রন্থ ঘেঁটে লেখক অরণ্যমুগ্ধ জীবনের দৃশ্য তুলে এনেছেন। গাছপালা ও লতাপাতা শুধু সৌন্দর্যের আধারই নয়, এগুলো যে চমৎকার ঔষধি গুণেও অনন্য, সে দিকটিও লেখক উল্লেখ করতে ভোলেননি। ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যময় শাখায় লেখকের অবাধ বিচরণের সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো।

‘ঘৃণাভরে ঘুস প্রত্যাখ্যান করলেন আলেকজান্ডার’ প্রবন্ধে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও ভুবনজয়ী অবিচল মানসিকতার দিকটি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নানা প্রলোভন, অর্থ-বিত্ত, সুন্দরী নারী কোনো কিছুই তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। ‘একজন বীর, একটি বই ও বিশাল সাম্রাজ্য’ প্রবন্ধেও বীর আলেকজান্ডারের সাহিত্যপ্রেমও যুদ্ধকৌশলের দিকটি উঠে এসেছে। আলেকজান্ডারের বালিশের নিচে থাকত হোমারের ইলিয়াড ও একটি ধারালো খক্ষ। গুরু এরিস্টটলের কাছ থেকে বালক বয়সেই পেয়েছিলেন মহাকবি হোমারের ইলিয়াড, অডিসি ও নানা মূল্যবান গ্রন্থ, যা তার ইস্পাতসম ব্যক্তিত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল।‘জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি’ প্রবন্ধে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’খ্যাত বিখ্যাত লেখক অরওয়েলের জীবনের অম্ল-মধুর কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন। লেখকের ভাষায়-যে কোনো উপন্যাস লেখার সময়ই কেন যেন আকস্মিক ও কাকতালীয়ভাবে জর্জ অরওয়েল পতিত হন দৈবদুর্বিপাকে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান যুদ্ধজাহাজ থেকে কয়েকটি সেল এসে আঘাত হানে অরওয়েলের গৃহে। পরিবারের সবাই বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তারা। কিন্তু অরওয়েল বিধ্বস্ত ঘরের ছাইয়ের মধ্যে পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন অ্যানিমেল ফার্মের পাণ্ডুলিপি। অন্যদিকে নাইনটিন এইটটি ফোর উপন্যাস লেখার সময়ও তিনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভয়াবহ নৌকাডুবির কবলে পড়েন। ‘নিঃসঙ্গবাসে জুল ভান, হুমায়ূন আহমেদ ও ডিকেনসন’ প্রবন্ধে লেখকদের ব্যক্তিজীবন শিল্পভুবনের বৈপরীত্য ও বিস্ময়কর রহস্যের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। জুল ভান ঘরকুনো স্বভাবের হলেও তার কল্পকাহিনির চরিত্ররা বিশ্বজগৎ চষে বেড়িয়েছে। হুমায়ূন আহমেদও ছিলেন একই প্রকৃতির। কিন্তু তার চরিত্ররা ভবঘুরে। একইভাবে নিঃসঙ্গ ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ ও এলিজাবেথ ডিকেনসন।

সমকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গও প্রবন্ধগুলোতে স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে চব্বিশের গণ আন্দোলনের বিভিন্ন দিক এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। এক্ষেত্রে ‘কবি নজরুলের কোমরে দড়ি ও প্রতিবাদের ভাষা’, ‘নজরুল ছিলেন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও’, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার পতনে কবি সাহিত্যিকদের অবদান’ প্রভৃতি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যায়।

সাইফুর রহমানের ‘ইতিহাসের গল্প’ আসলে ইতিহাস ও সাহিত্যের অনন্য মেলবন্ধনে শিল্পিত রূপ পেয়েছে। এখানে তত্ত্ব ও তথ্য এক বৃহৎ ক্যানভাসে সমকালীন জীবন আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত। ফলে সমকাল ও চিরকাল এখানে যুগপৎ নান্দনিক বিভায় উপস্থিত।

আহমেদ বাসার

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম