হুমায়ূন আহমেদের তিরোধানের শব্দসাক্ষী

উম্মে সায়মা
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হুমায়ূন আহমেদ যা করে গেছেন, রেখে গেছেন, তার সঙ্গে তুলনা করার মতো বৃক্ষ বা নদী, পাহাড় বা আকাশ আমাদের নেই। সাগর যাও বা একটা আছে তাও ঠিক সাগর নয়, উপসাগর। ফলে স্রষ্টা বা নির্মাতা যাই বলি না কেন, তিনি তাঁর নাম খোদাই করে গেছেন অজর, অমর, অবিনাশীদের তালিকায়। দৈহিক ও আত্মিক দু-অর্থেই তিনি কালের প্রাচীর পার হয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন মহাকালে। তিনিই আমাদের শেষ ‘মহান’। ২০১২ সালে হুমায়ূন আহমেদের তিরোধানের পর শোকের যে লু হাওয়া বয়ে যায়, তারই শব্দসাক্ষী আবদুল হাই শিকদারের গ্রন্থ ‘হুমায়ূনতীর্থ, নুহাশপল্লী বাংলাদেশ ডটকম’।
এ গ্রন্থের সব কটি লেখাই ছাপা হয়েছিল দৈনিক আমার দেশে। দুটি উপসম্পাদকীয় হিসাবে, বাকি দুটি সাহিত্য পাতায়। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোড়িত গ্রন্থ ‘হুমায়ূন আহমেদ : ঘরে বাইরে হাজার প্রশ্ন’র একটা বড় অংশ এ বইয়ের পরিশিষ্টে যুক্ত করা হয়েছে। ‘হুমায়ূনতীর্থ, নুহাশপল্লী বাংলাদেশ ডটকম’ নামের প্রথম প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন-হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথা, কান্না-হাসিকে বাঙময় করেছেন অনুকরণীয় মাধুর্যে। তাকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন অশিক্ষিত আবেগ দিয়ে নয়; যুক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে, নিরাভরণ সত্যের সহজ-সরল মমতা দিয়ে। একই রকমভাবে বলা যায় আধিপত্যবাদী থাবার নিচ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উদ্ধার করে তাকে দান করে গেছেন আত্মশক্তি, মর্যাদাবোধ ও নিজস্বতা। আর আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠা। কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষাভঙ্গিকে বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশের জনজীবনের ভাষাকে শিল্পরূপ দিয়ে যে অসামান্য কাজটি তিনি করে গেলেন, তার মূল্যায়ন হতে সময় লাগবে। তিনি নিজের জন্য নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ করে আমাদের আক্কেল-হুঁশ হারিয়ে ফেলা, কেঁচোর মতো ঘিনঘিনে, পরমুখাপেক্ষী লেখক-কবিদের আঁতলামির জ্বালা সয়েছেন বটে; কিন্তু তাদেরও খানিকটা মানুষ করে দিয়ে গেছেন। লেখকের মতে-হুমায়ূন আহমেদ তার বিষয়-বৈচিত্র্যের মতোই বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকেও সম্মান দান করে গেছেন। মধ্যবিত্ত নাগরিক, সাদামাটা জীবনের কাহিনি বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রোপণ করে গেছেন লোকসংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল নানা দিক। তার নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, সংগীত-সব কিছুই এর প্রমাণ হিসাবে আমাদের সামনে আছে। এর মাধ্যমে বিরাজমান হীনম্মন্যতার শিকড় তিনি উপড়ে ফেলেছেন। লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক, ফ্যান্টাসি এবং সায়েন্স ফিকশন-এসবের পরতে পরতে তিনি গেঁথে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে সুপারম্যান হিসাবে দেখেননি কখনো, দেখেছেন দোষে-গুণের ভেতরে সন্তরণশীল। এজন্যই শ্রাবণ মেঘের দিনের দাদা, বহুব্রীহির এমদাদ খোন্দকার কিংবা নান্দাইলের ইউনুসের জন্যও চোখে পানি আসে আমাদের। হুমায়ূন আহমেদকে সাহিত্যসম্রাট সামনাসামনি বললে হয়তো তিনি হেসে উঠতেন। কারণ এসব সম্রাট, রাজা, রায় বাহাদুর, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিদের লেখক তো ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মননায়ক। আবদুল হাই শিকদার মনে করেন-বাংলা সাহিত্যের শেষ একশ বছরে দেখা যায়, মাত্র দুজন লেখক ব্যাপকভিত্তিক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আগেরজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরেরজন হুমায়ূন আহমেদ। মাঝে কাজী নজরুলও চেয়েছিলেন বড় ধরনের কিছু একটা করার। চেয়েছিলেন মহামিলনের আরাফাত গড়তে। কিন্তু তিনি সময় পাননি।
এ বইয়ের অন্য লেখায় লেখক তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব অর্থ, ঘাম, মেধা আর স্বপ্ন দিয়ে গড়া নুহাশপল্লীর গুরুত্ব। নাগরিক কোলাহলের বাইরে গভীর নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে মমতার রেণুমাখা নুহাশপল্লী হতে পারে শেক্সপিয়ারের ‘স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন’। ছোট একটা শহরের পুরোটাই গড়ে উঠেছে শেক্সপিয়ারকে নিয়ে। কী নেই সেখানে? আছে শেক্সপিয়ারের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, আছে সোয়ান থিয়েটার, আছে প্রেক্ষাগৃহ, আছে শপিংমল, আছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পর্যটন অফিস, গাইড, আরও কত কি! ...দেশি পর্যটকের পাশাপাশি দেশ-দেশান্তর থেকে প্রতিদিন গাড়ি ভরে ভরে পর্যটক যাচ্ছে স্ট্র্যাটফোর্ডে। হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের ও প্রিয় স্থান নুহাশপল্লীকে গড়ে তোলার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তার পরিবার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে নুহাশপল্লী হয়ে উঠতে পারে ‘হুমায়ূন তীর্থ’; হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যরকম এক স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন; হয়ে উঠতে পারে একটা খাঁটি বাংলাদেশি শান্তিনিকেতন।
এ বইয়ের ‘হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু : হাজার প্রশ্ন’ প্রবন্ধে তার দুই স্ত্রী সম্পর্কে লেখক আবদুল হাই শিকদারের মূল্যায়ন-‘শাওনকে আমি কোনো দোষ দিচ্ছি না। তারপরও তো একথা সত্য, গুলতেকিন জীবনদাত্রী আর শাওন সেই জীবনের শেষাংশের লাবণ্যের অংশ ভাগী। ... গুলতেকিন চেয়েছেন হুমায়ূন বড় হোক, আর শাওন চেয়েছেন হুমায়ূনকে জড়িয়ে বড় হতে। দুজনই ভালোবেসেছিলেন হুমায়ূনকে। তাদের কারোর প্রেমকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির এ পার্থক্যটুকু গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো তাই শেষ বেলায় ‘আমার আমি’তে হুমায়ূন লেখেন, গুলতেকিনই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী। তার লেখক হয়ে ওঠা এবং প্রেরণার উৎসও সেই তিনিই।’
এ প্রবন্ধের অন্য এক জায়গায় ভারত ও ভারতীয় বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদের মতামত তুলে ধরেছেন, ‘...ভারতের প্রতি আমার কোনো মমতা নেই। কারণ ভারত আমাদের দীর্ঘসময় শোষণ করেছে। এখনো করছে। আমাদের সাহিত্যকেও ঠিকমতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়নি। কাজেই এদের প্রতি কোনো মোহ থাকার কারণ নেই। ...তবে তাদের দিন শেষ। বর্তমান ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। বাংলা সাহিত্যে ভবিষ্যতে কোনো মহৎ সৃষ্টি এ দেশের লেখকদের দ্বারাই কেবল সম্ভব এবং তারা সে দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। (ঘরে বাইরে হুমায়ূন আহমেদ : হাজার প্রশ্ন, মাহফুজ আহমদ, পৃষ্ঠা-৬৬)।
আবদুল হাই শিকদারের মনে করেন-বাংলাদেশের পাঠক, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে হুমায়ূন আহমেদ ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাদের মধ্যে বুনে দিয়েছেন স্বপ্ন। লজিক ও এন্টি-লজিকের পৃথিবী। আর বাংলাদেশের নিভু নিভু প্রকাশনা শিল্পকে তিনি দিয়েছেন প্রাণ, দিয়েছেন প্রতিষ্ঠা। কলকাতার কৃত্রিম ভাষা ও ভঙ্গির বিরুদ্ধে খাড়া করেন খাঁটি বাংলাদেশি ভাষাকে। সব ধরনের নেগেটিভ বিষয়-আশয় পরিহার করে তিনি উচ্চকিত করেন বাংলাদেশের আত্মাকে, তার আত্মার ভাষাকে। লোকসংস্কৃতি ও মরমি গানকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। ঐতিহ্যের করেছেন নবায়ন। জীবন থেকে দূর করেছিলেন হীনম্মন্যতা, ফিরিয়ে এনেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস।
‘হুমায়ূনতীর্থ : নুহাশপল্লী বাংলাদেশ ডটকম’ বইটি ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স। বইটির মূল্য ৪০০ টাকা মাত্র