Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ভাষার প্রশ্নে মানুষই ভরসার কেন্দ্র

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ একবার পড়লে রামমাণিক্যকে ভোলা মুশকিল। রামমাণিক্য বাঙাল। তার পরিচয়লিপিতে বলা আছে সে-কথা; সে-লিপি না থাকলেও অবশ্য চলত, কেননা মুখ খুললেই আর রক্ষা নাই, হা হা করে ওঠে তার বাঙালপনা। পদ্মাপারের। খাঁটি বিক্রমপুরীর। তার অনেক স্মরণীয় মনিমাণিক্যের মধ্যে একটি, ‘এতো করেও কলকাতার মতো হবার পারলাম না, তবে এ পাপ দেহতে আর আজ কি, আমি জলে ঝাঁপ দিই, আমাকে হাঙ্গরে কুমিরে বক্কোন করুক।’

ওই যে ‘বক্কোন’ ওই আওয়াজ কে দিতে পারবে এ সংসারে, খাঁটি বাঙাল ছাড়া? টেলিভিশনে হঠাৎ সেদিন ওই ভক্ষণের আওয়াজ যেন আবার শুনলাম। নিজ কানে। যিনি বলছিলেন, তার পরিচয়টা ঠিক ধরতে পারিনি, কিন্তু আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম, কেননা তিনি মাছের কথা বলছিলেন। মাছের ব্যাপারে আশ্বস্ত করবেন আশা করছিলাম; ভরসা দেবেন, ভ্রান্তধারণার নিরসন করে দেবেন, বলবেন, মাছ খাওয়া যাবে। না, উলটো বললেন কথা, বললেন মাছ ভক্ষণ করবেন না। তা তো বুঝলাম, কিন্তু কী যে ভক্ষণ করব, তা তো বুঝলাম না, জনাব। সেটা তো কেউ বলে না, বলে দেয় না।

তবে অত দুঃখের মধ্যেও ভক্ষণ দেখি আমাকে ছাড়ে না। বেড়ে বলেছেন, ভাই, ভক্ষণ করবেন না। আসলে তো আমরা ভক্ষণই করি। বিশেষ করে মাছ, বাঙালির ভেতরে একটা বিড়াল আছে, মাছ দেখলে চাঞ্চল্যকে শাসন করা কঠিন হয়ে পড়ে। লম্ফঝম্প দিতে থাকে। কিন্তু মাছ পেলে বিড়ালের মতো ভদ্রভাবে খাই না, গপাগপ গিলতে চাই। রাক্ষসের মতো ভক্ষণ করি। কেবল মাছ বলে নয়, এমনকি কোনো খাবার আছে, যা পেলে ভক্ষণ করি না? শান্তভাবে খাই?

তবে মাছের এখন সত্যি সত্যি দুর্দিন। সহকর্মীর ভাগিনা গিয়েছিল দেশে। ভাটি অঞ্চলে দেশ তার। ভাগিনার বাবা বাজারে খুঁজে ঢুকে জিয়ল শিংমাছ নিয়ে এসেছে দশটা। পরের দিন সকালে উঠে দেখেন মরে ভেসে রয়েছে সবকটিই। গায়ে তাদের ফোসকা। বসন্ত হয়েছে। পানির মাছের গায়ে পানি বসন্ত। কে কবে শুনেছিল অমন অলক্ষণে কথা। একি তবে প্রকৃতির প্রতিশোধ? বসন্তকে দেশছাড়া করব বলে আস্ফালন করেছি, তাই কি প্রতিশোধ নিল বসন্ত; মাছের গায়ে ফুটে উঠে? এরপরে কি তরকারির বসন্ত হবে? তারপরে চাল-ডালের? কলিকালের মনে হয় খুব আর বিলম্ব নেই।

অনেকে আছেন এমনিতেই হতাশাবাদী; তাদের ইমান আরও পোক্ত হয় এসব দেখে। তারা বলেন, সব শেষ হয়ে যাবে। দেখছ না লক্ষণ?

কেমন খরা পড়েছে। মরুভূমি হয়ে যাবে সারা দেশ। খেজুর গাছ দেখবে চারদিকে। তার নিচে হয়তো পাওয়া যাবে তরল সোনা, অর্থাৎ খনিজ তেল, কিন্তু তাতে তোমার আমার কী লাভ, ব্রাদার, তুমি আমি তো ততদিন টিকব না। আমি অবশ্য হতাশাবাদী নই। বিলোপবাদ পোষায় না আমার। যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই-ই, তবে জৈবসার হিসাবে তো অন্তত একটা ভূমিকা থাকবে। আবার আসিব ফিরে। সার হয়ে ভূমিকে উর্বর করতে পারব। তাতে গাছ হবে। গাছ হলে বৃষ্টি হবে, বৃষ্টি হলে আর পায় কে, সোনার বাংলা তখন আবার শ্যামল হয়ে উঠবে। কিন্তু ওই যে প্রশ্ন, তাতে তোমার কী, আমার কী? ও বড় মারাত্মক প্রশ্ন, সত্যি সত্যি, আমি গেলে রইল কী?

ভক্ষণ বড়ই সত্য হয়ে উঠেছে, কেবল আমরা যে ভক্ষণ করি তা নয়, আমাদের ভক্ষণ করা হয়। দারিদ্র্য আমাদের ভক্ষণ করে, হতাশা খুবলে খুবলে খায়। মহানন্দে মশাগুলোও ছাড়ে না। কারও ইচ্ছা ধর্মীয় রাষ্ট্র করা হোক বাংলাদেশকে, ওদিকে মানুষের ধর্মকর্ম করার স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত যে বিপন্ন, তা তো দেখছে না কেউ। পরিচ্ছন্ন থাকার মতো বাড়তি কাপড় নেই, সম্ভ্রম রক্ষা করার মতো আড়ালটুকু অবলুপ্ত, ওজু করার পানি নেই। বাংলাদেশের মেয়েরা বিশ্বের বাজারে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরেও শবেবরাতে দেখলাম খাওয়া-দাওয়া কমে এসেছে। যে দুটো চাকরি করে, সে তিনটে চাকরি খুঁজছে। ওদিকে বেকার মানুষ কী খায়, কোথায় ঘুমায় হদিস নেই। আমরা ভক্ষণ করব না তো ভক্ষণ করবে কে? হয় ভক্ষণ করব, নয় তো ভুক্ত হব। আমাদের দেশ ক্ষুধার দেশ। কেবল মানুষ নয়, মশা, মাছি, রোগ, শোক, কুকুর, শৃগাল সবাই এখানে বিলক্ষণ ক্ষুধার্ত। ভক্ষণ, শুধু ভক্ষণ।

মনুষ্যত্ব তো বিপন্ন হচ্ছেই, এমনকি বাঙালিত্বও খাবি খাচ্ছে, দেখতে পাই। দুধ ছিল, দুধ গেছে। সেই যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মাছ খেয়ে আসছি আমরা, বিকাশ তা-ও কি যাবে চলে পানির স্রেতো শুনি হাঙ্গরে কুমিরেই, নয়তো ধরে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।

২.

আমরা কি বলব যে, ভাষা রাজনীতির অধীন? হুকুমের দাস? না, তা নয়। ভাষা কারও একার সৃষ্টি নয়, কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর সৃষ্টিও নয়, যেজন্য ভাষার শব্দ বাড়ে, শব্দের বানান ও উচ্চারণ বদলায়, কিন্তু ব্যাকরণ ঠিক থাকে এবং রাজনৈতিক বিপ্লবের পরেও ভাষা বদলায় না। যেজন্য বলা হয়, ভাষা মূল কাঠামোরই উপাদান বটে, উপরকাঠামোর রাজনীতি এ মূল কাঠামোকে বারে বারে ও নানাভাবে আক্রমণ করতে পারে, করে থাকে। আমাদের দেশের মানুষ একের পর এক বিদেশিদের ভাষা শিখেছে। ফারসি ও ইংরেজি তাকে শিখতে হয়েছিল, উর্দুও শিখতে হতো। কারণটা ভাষাতাত্ত্বিক নয়, কারণটা রাজনৈতিক। ফারসিচর্চাকে ধর্মীয় আকর্ষণ-উদ্ভূত বিবেচনা করলে ভ্রান্তির পরিচয় দেওয়া হবে, কেননা ফারসি কেবল মুসলমানরাই শেখেনি, সেকালের হিন্দুরাও শিখেছে। ইংরেজি যে কারণে শেখা, ফারসিও সে কারণেই। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষা বিনষ্ট করার উদ্যোগকে ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়েছিল বটে; কিন্তু অন্তর্গত অনুপ্রেরণাটি ছিল রাজনৈতিক। আর আজও যে বাংলা ভাষা চলছে না দেশে, তার কারণও অন্যকিছু নয়; নির্ভুলরূপে রাজনৈতিকই। এবং সারা পৃথিবীতে আজ যে ইংরেজি ভাষার এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, এর ব্যাখ্যা ভাষাতত্ত্বের কোনো বইয়ে খুঁজতে গেলে পণ্ডশ্রম হবে, খুঁজতে হবে ইংরেজি ভাষীদের রাজনৈতিক আধিপত্যে। রাজনীতির জাল সর্বত্র পাতা, পালাব কোথায়?

বড়ই নির্মম তার টানাপোড়েন। এরশাদ শাসনের প্রথমদিকে পত্রিকায় রাজনৈতিক দলের ‘কর্মসূচি’ পালনের কথা লেখা হতো। বলা হতো ‘কর্মসূচি’ পালিত হয়েছে। এ ‘কর্মসূচি’ জিনিসটার অর্থ কি ভবিষ্যতের গবেষকরা কিছুতেই বুঝতে পারবেন না তৎকালীন রাজনীতির একটি ইতিহাস যদি তাদের হাতের কাছে না থাকে। অথবা সেই মহাপণ্ডিত ও বিরাট কবির কথা ধরি না কেন, যিনি বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কয়েক মাস আগে বিধান দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য প্রয়োজন হলে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বর্জন করতে হবে অথচ বায়াত্তরের পর যিনি প্রচণ্ড রকমের রবীন্দ্রভক্ত হয়ে পড়েন এবং রবীন্দ্রনাথের কাব্য কীভাবে পড়া দরকার তার ওপর মস্ত একটি গ্রন্থ লিখে ফেলেন; তার এ দ্বিবিধ আচরণের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি, আমরাও পাব না যদি-না খেয়াল রাখি একান্ন সালে তিনি পাকিস্তানের সেবক, বায়াত্তরে বাংলাদেশের। তিনি বদলাননি মোটেই, তবে রাজনীতি বদলে গেছে। দোষ তার নয়, দোষ রাজনীতির। মানী লোকদের সে মান রাখে না, শয়তানি করে, বদলে যায় এবং বিপদে ফেলে।

ঢাকা শহরে এখন হাওয়া বইছে শিশুদের জন্য ইংরেজির মাধ্যমে স্কুলের; হুহু করে বাড়ছে তাদের সংখ্যা। ব্যাঙের ছাতা বলা যাবে না, তারাই মনে হয় আদত বৃক্ষ, এমন শক্ত। এ বৃদ্ধির ব্যাখ্যাও ভাষাতাত্ত্বিক গ্রন্থ দেবে না আমাদের, পাওয়া যাবে অন্যত্র। যে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা বাড়ে না, বাড়ে না অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের শতকরা হার এবং বাংলা ভাষা পথ পায় না সর্বত্রগমনের, ঠিক সেই কারণেই ইংরেজি বিদ্যালয়ের কদর বাড়ে বাংলাদেশে। রাজনীতি উপরকাঠামোর অংশ ঠিকই, কিন্তু তার শক্তিকে উপেক্ষা করে কার সাধ্য। অন্ধ হতে দোষ নেই, তবে তাতে প্রলয় বন্ধ থাকে না। তবু ভাষা টিকে থাকে এবং বলে; মানুষই ভরসা, শেষ পর্যন্ত।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম