Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

পাঠকের আন্দালিব রাশদী

Icon

ঈশিতা রনি

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আন্দালিব রাশদীর লেখার সঙ্গে পরিচয় তার উপন্যাস খুকি পড়ে। হঠাৎ খুকি নামটাই মনে ধরে আমার, তাই চটজলদি রকমারিতে অর্ডার করি। খুকি মফস্বলের একটি শ্যামলা মেয়ের গল্প। যার বেড়ে ওঠা নিতান্ত অবহেলা, অযত্নে, গায়ের ময়লা রং আর শারীরিক অনাকর্ষণীয় গঠনের কারণে কখনো কেউ তাকে সুন্দর বলেনি, বলার নয়ও। তাই স্বভাবতই তার নিজের ওপর আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তরুণী খুকি কখনো ভাবতেও পারেনি তার জন্য তারই পাড়ার মাস্তান ছেলেটা দিওয়ানা হয়ে উঠবে। তার মতো করে কেউ কখনো খুকির যত্ন নেয়নি। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে খুকি ও মন্টুর প্রেম কাহিনিতে নানা রকম চিত্র দেখা গিয়েছে। মন্টুর নিরুদ্দেশ হওয়া আর সারা জীবনের জন্য খুকির অপেক্ষায় থাকা-লেখক পাঠকের হৃদয়কে একেবারে নাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। বইটি বলা যায় গোগ্রাসে সাবাড় করি।

এর পর পরই পড়ি এসএমএস যুগের আগে। ইলেকট্রনিক এসএমএস, ইমেইলের আগের কালের প্রেম বিরহের একটি গল্প। এ কাহিনিতে ছাত্রী তার কবছরের বড় প্রাইভেট টিউটরকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারে না, কিন্তু বিভিন্নভাবেও যখন বুঝাতে ব্যর্থ হয়, তখন সে তাকে চিঠি লেখে। এ চিঠির বেশিরভাগই ছিল তার কল্পনায়। চিঠিগুলো সে তার মনে জমিয়ে রেখেছে, পোস্ট করতে পারেনি। মেয়েটির পরে বিয়ে হয় প্রবাসী এক সজ্জনের সঙ্গে। বিয়ের পর সুইজারল্যান্ডে চলে যায়, তবু দুজনের মানসিক আদান প্রদান থামে না। দুজনেই চিঠি লেখে মনে মনে। শেষ পর্যন্ত যে চিঠি ছেলেটি ডাকে পোস্ট করে, সেটিতে ছেলেটি মেয়েটির স্বামীর কুশলাদিই মূলত জিজ্ঞেস করে। ছেলেটি চেয়েছে যেভাবে হোক তার হাতের লেখা মেয়েটির কাছে পৌঁছাক। ভালোবাসা যে কত রকমের হয়, না ছুঁয়েও পুরো শরীরকে কেমন করে পাওয়া যায়, তা লেখক আন্দালিব রাশদীই জানেন।

লেখকের ঝুম্পানামা ও লাইলীনামাতে পাঠক এক পকেটমারের প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন। তোতা মিয়া নামের এ পকেটমার অত্যন্ত সুকৌশলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার পকেট, ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে। এই তোতার জীবনের সংগ্রাম, তার প্রেম, প্রেমিকার প্রতি তার ভালোবাসা, সবকিছু পড়তে গিয়ে পাঠক পুরো সময় তোতার জন্যই প্রার্থনা করবেন যেন তোতা আজ ভালো কোনো পয়সাওয়ালা লোকের পকেট কাটতে পারে। তোতা যেন ধরা না পড়ে, যেন গণপিটুনির শিকার না হয়। আন্দালিব রাশদীর যে রাতে আমার স্ত্রী পড়েছিলাম কলকাতার একটি খবরের কাগজে বইয়ের রিভিউ দেখে। রিভিউতে উপন্যাসটিকে বর্ণনা করা হয়েছিল ‘একটি হিংস্র প্রেমের কাহিনি’। পড়তে গিয়ে আমি খুঁজে পেয়েছি খ্বুই সাধারণ জীবনযাপনকারী এক অসাধারণ যুবক আব্দুল খালেককে, যার জন্য ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল ঋতুমণি। আবার সেই ঘর সে নিজেই ভেঙে চলে যায়। তাদের একমাত্র কন্যা অবন্তীকে আগলে রাখে দ্বিতীয় স্ত্রী শবনম। সম্পর্কের অনেক উত্থান-পতন, শবনমের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস, একই রাজনৈতিক আদর্শ থেকে উঠে আসা স্বামীর নিস্পৃহতা-সবকিছু ছাপিয়ে যখন বিয়েটা প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল, তখন মেয়ে অবন্তীর জন্যই যেন দুজনে আবার এক হয়ে সংসারটা ধরে রাখে।

আন্দালিব রাশদী তার সচিব সাহেব উপন্যাসে দেখিয়েছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেখিয়ে কীভাবে একজন মানুষ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হন এবং ওই একটি ভুয়া সার্টিফিকেটের কারণে তিনি ‘সচিব’ বনে যান। আমাদের চারপাশে এমন অনেক ভুয়া সার্টিফিকেটধারী আছেন যারা তাদের মিথ্যা কাগজ দেখিয়ে জীবনে অনেক বড় জায়গায় চলে গেছেন। তবে এ মিথ্যা কাগজের জন্য তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কও থাকে। তাই যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দেশজুড়ে খবর প্রচার হয়, এবং বেশ কিছু ‘সচিব’ পদমর্যাদার লোক ধরাও পড়ে যান, তেমনি একটি সময় এ উপন্যাসের ভুয়া সচিব ধরা না পড়ার আনন্দে সুখনিদ্রায় যান। একেবারেই সত্যি ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা এ উপন্যাসে দেখা যায় তথাকথিত সচিব সাহেব নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতা সিদ্ধ করার জন্য তার নিজের চেয়ে ২-৩ বছরের জুনিয়র এক ধনী লোকের সঙ্গে তরুণী মেয়েকে বিয়ে দেন, যার সঙ্গে পাত্রের বয়সের পার্থক্য ৩১ বছর। আরেক কন্যাকেও একজন অর্থ পাচারকারী ও নারী পাচারকারীর হাতে তুলে দেন। প্রকৃতির পরিহাস-সচিব সাহেবের এক সন্তান অপঘাতে মারা যায়। আসলে সচিব সাহেব আমাদের পরিচিতই কোনো আমলা, যাদের জন্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কলুষতা ছড়িয়ে গেছে।

আন্দালিব রাশদীর রোল নম্বর ৩৯ পাঠককে একেবারেই ভিন্ন স্বাদ দেবে। বইটি পড়তে গিয়ে তরুণ অথবা মধ্য বয়সি পাঠক হারিয়ে যাবেন তাদের কিশোরবেলায়। বিশেষ করে স্কুলে যারা কো-এডুকেশনে পড়েছেন, এ উপন্যাস তাদের নস্টালজিক করতে বাধ্য। কো-এডুকেশনের কোনো কিশোর কোনো কিশোরীর একটা ব্যক্তিগত তথ্য উদ্ঘাটন করা মানেই যেন আমেরিকা আবিষ্কার করা। কীসের এডিসন, কীসের আইনস্টাইন, কো-এডুকেশন স্কুলের সবচেয়ে বখাটে ছাত্র তার জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার করে ফেলেছে-ক্লাসের সুন্দরী সহপাঠী ব্র্যাসিয়ার পরে! এখনই সে আর্কিমেডিসের মতো ইউরেকা বলে চিৎকার করবে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রাজাবাজার থেকে কাপ্তানবাজার কিংবা লালবাগ থেকে গুলশান ছুটে যেতে চায়। ক্লাস নাইনে কোত্থেকে উড়ে আসা জুলিয়েট সিদ্দিকীর ঔজ্জ্বল্য সবাইকে ঝলসে পুড়ে দিয়ে শিক কাবাব বানিয়ে দিল। ক্লাসের বাকি মেয়ে জেসমিন, ফারজানা, জাকিয়া, ছন্দা, মোবাশ্বেরা, মহুয়া রায়, সবাই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। লেখক নিজেও কি সেই কিশোরবেলায় জুলিয়েটের অগ্ন্যুৎপাতে ফুটন্ত লাভায় তলিয়ে যাননি? চরিত্রগুলো খুব চেনা, তবু শেষটাতে ভালোবাসার কী বিষণ্ন পরিসমাপ্তি, পাঠককে কাঁদিয়ে ছাড়বে।

আন্দালিব রাশদীর আমাদের প্রেমিকারা একটি সুখপাঠ্য উপন্যাস বলা যায়, ভীষণ নস্টালজিকও। আচ্ছা মনে করে দেখুন তো বন্ধুদের সঙ্গে কখনো কনফেশনে গেম খেলেছেন? অথবা ট্রুথ অর ডেয়ার এসব খেলায় ঠেলায় পড়ে সত্যি কথা বলতে হয়। এবং দিন শেষে মনটাও হালকা লাগে কারণ সত্য সাধারণত মধুরই হয়ে থাকে। আমাদের প্রেমিকারা এখন থেকে ৫৭ বছর আগে ১৯৬৮ সালে যারা ক্লাস টেনে পড়তেন, অর্থাৎ স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যাদের বর্তমান বয়স সত্তর থেকে বাহাত্তরের মধ্যে তাদের গল্প। এসব বন্ধুরা স্কুলের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে একটি গেট টুগেদারের আয়োজন করে এবং তারা ঠিক করে এ গেট টুগেদারে তাদের মনের কথাগুলো, অজানা সব গল্প শেয়ার করবে। তাদের কথার সবচেয়ে কমন বিষয় হচ্ছে সবাই কোনো না কোনো তরুণীকে ভালবেসেছিল। এ ভালোবাসার কথা কমবেশি অনেকেরই হয়তো জানা, কিন্তু আসল অনুভূতি তখনো অনাবিষ্কৃত; ভালোবাসতে গিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কমবেশি বিরোধও হয়েছে। কাউকে স্কুল থেকে রাসাটিকেট করা হয়েছে। কারও সে বছর এসএসসি পরীক্ষাতেই বসা হয়নি। কারও কারও জীবনের গতিধারাই বদলে যায়। তারা ঠিক করেছে প্রেমের ব্যর্থতা ও সাফল্যের কথা বলবে। কারও একাধিক প্রেম থাকলেও বলবে। এ প্রেমও বিরহের বর্ণনা ও গেট টুগেদারকে কেন্দ্র করে ঘটতে থাকে নানা ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা। শেষ বয়সে এসে পুরোনো প্রেমিকার সঙ্গে কারও কারও মিলনও হয়। আসলে আমাদের শৈশবের প্রেমিক-প্রেমিকারা ফুরিয়ে যায় না, ক্ষত রেখে যায়, সেই ক্ষত হয়তো উপশম হয় দীর্ঘ ৪০-৫০ বছর পর কোনো এক গেট টুগেদারে। অসাধারণ এ ফিকশন না পড়লে পাঠক মিস করবেন।

আন্দালিব রাশদী তার কফিনের জানালা উপন্যাসে যেন নিজেকেই ফুটিয়ে তুলেছেন পাঠক। উপন্যাসটির পরতে পরতে উপন্যাসের ‘লেখক’ চরিত্রটির সঙ্গে আসল লেখক আন্দালিবকে মিলিয়ে ফেলতে পারেন।

কফিনের জানালায় মূলত একজন মৃত লেখক পৃথিবী ছাড়ার পর চারপাশের লোকজনের তার সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ অথবা লালসা দেখে মৃত লেখকের অভিব্যক্তি দিয়ে গল্পটি শুরু করেছেন। পুরো গল্পে লেখকের তার স্ত্রীর প্রতি ভীষণ রকমের আবেগ ও মায়া প্রত্যক্ষ করি। লেখকের তরুণী স্ত্রীর তার স্বামীর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যে কোনো বিখ্যাত প্রেম কাহিনিকে হার মানায়।

গল্পের প্রধান নারী চরিত্র ‘পদ্ম’ ১৯ বছরের তরুণী। তার স্বামী সেলিব্রিটি লেখক পদ্মের চেয়ে বেশ অনেক বছরের বড়। এ অসম বিয়েকে সমাজ মেনে নেয়নি। লেখকের আগের পরিবারের সন্তানরাও স্বভাবতই মেনে নেয়নি বিয়েটা। নানাভাবে হেয় হতে হয়েছে তাদের। তবু দিন শেষে তাদের ভালোবাসার জয় হয়েছে। গল্পটি পড়ে পাঠকের মিশ্র অনুভূতি হতে পারে।

তবে পুরো গল্প এবং এর ঘটনা-দুর্ঘটনা সবই অসাধারণ।

আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক ভেবে বসতে পারেন যে, এর প্রতিটি চরিত্রই লেখকের নিজের। লেখক চারপাশে যাদের দেখেছেন তাদের নিয়েই তার ফিকশন, কিন্তু এক একটা ফিকশন যেন বাস্তবে দেখা আপনার আমার অতিপরিচিত কেউ। লেখকের গদ্যে যেমন অসাধারণ সুন্দরীরা আছেন, তেমনি মায়াবতী কালো মেয়েও রয়েছেন সম্রাজ্ঞী হয়ে। অনেক চরিত্রের হাসি আনন্দ পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।

বইয়ের ফ্ল্যাপে ঠিকই লিখা আছে : আন্দালিবের বই একবার শুরু করলে শেষ না করে আর ওঠা যায় না। তবে পড়া শেষ হয়ে গেলেও ভালোলাগার রেশটা থেকেই যায়। পাঠকের মনজয়ী আন্দালিব রাশদীর ফিকশন পড়তে পড়তে কখনো হেসে ওঠা, কখনো হাউমাউ করে কাঁদতে পারার পাঠক মন টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও তার মতো নগর জীবনের কথা-কারুকার অবশ্যই প্রয়োজন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম