রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি

রাজু আলাউদ্দিন
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হাসান হাফিজ সত্তরের দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি। এটি এমন এক দশক, যা আমাদের ইতিহাসে এক ক্রান্তিকাল হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পরাধীনতা থেকে আমরা স্বাধীনতার দিকে যাত্রা শুরু করেছি। অবশেষে অর্জন করেছি এক স্বাধীন ভূখণ্ড। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি এক স্বাধীন জাতি হিসাবে। আমাদের কবিতার জগতেও ঘটেছে এক বড় ধরনের পরিবর্তন। এ পরিবর্তনে যারা প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ, কবি ও বরেণ্য সাংবাদিক হাসান হাফিজ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। হাসান হাফিজ কবিতায় এক সহজিয়া ধারার অনুশীলন করেছেন, কিন্তু তা গভীরতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তিনি বক্তব্যে স্বচ্ছতোয়া জলের মতোই স্পষ্ট কিন্তু অতলে সঞ্চরণমান অনুভূতির বহুবর্ণিল মীন রাশির চলাচল আমাদের চোখকে তৃপ্ত করে। রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা প্রেমমূলক সংবেদনকে তিনি নিজস্ব ভাষায় নিষ্কাশিত করে নেন, আর তারপর তিনি ঘরোয়া আর অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তাকে কাব্যময় করে তোলেন।
তার কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই আশির দশক থেকে। হাসান হাফিজ কবি হিসাবে যেমন উচ্চ রুচির, তেমনই তিনি বহুপ্রজ। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অতিক্রম করে ফেলেছেন। এতদিন আমরা জেনে এসেছি রবীন্দ্রনাথের পরে সর্বাধিক সংখ্যক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা কবি শামসুর রাহমান। হাসান হাফিজ সম্ভবত ইতোমধ্যে সেই রেকর্ডও ভাঙতে যাচ্ছেন কিংবা ভেঙে ফেলেছেন। আমাদের দেশে, সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও এত বেশি সংখ্যক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা দ্বিতীয় কেউ আছেন বলে জানি না। অনেকেই মনে করেন বেশি লিখলে অনেক দুর্বল লেখাও সৃষ্টি হয়। তা হয়তো হয়, কিন্তু এটা আসলে বেশি বা কম লেখার বিষয় নয়। এটা স্রেফ লেখকের ধরন; কেউ বেশি লিখেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখতে পারেন, কেউ কম লিখেও গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখে ফেলতে পারেন। হাসান হাফিজ বহুপ্রজ লেখকদের কাতারে অবস্থান করেন। বেশি লেখা তার ক্ষতি করতে পারেনি বলে আমার বিশ্বাস। ক্ষতি যে করেনি তার এক বড় প্রমাণ পাঠকদের কাছে তার জনপ্রিয়তা। তিনি শুরু থেকেই এখন পর্যন্ত আমাদের কর্মেও জনপ্রিয় কবিদের একজন। পাঠক তার কবিতা যে এতটা পছন্দ করে তা নিছক বেশি লেখার জন্য নয়, বরং লেখার গুণগত মানের জন্যই। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সর্বশেষ বিচারক লেখক কিংবা সমালোচক নয়, বরং পাঠক। হাসান হাফিজের পাঠকপ্রিয়তাই প্রমাণ করে তিনি আমাদের কালের এক বরেণ্য কবি।
হাসান হাফিজের ‘রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি’ যখন পাঠকের হাতে পৌঁছে যাবে, তারা আমার কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। বইটি আমি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি তার কাব্যশক্তিতে। এ গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই মূলত প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ আর প্রেমের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পূর্ণ এক ফুলের বাগান। এ বাগানে রয়েছে নানা জাতের চক্ষু-জুড়ানো কাব্যফুলের সমাবেশ। এতে প্রবেশ করা মানেই সৌন্দর্যে ও সৌরভে বিমোহিত হওয়া। বইটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে এক বসায় শেষ না করে উঠতে পারিনি। মনে হচ্ছিল আমার সামনে দরজার পর দরজা খুলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় কক্ষের কুহকি আহ্বানে।
হাসান হাফিজ দশকের বৃত্ত পেরিয়ে তিনি আজকের নবীনতম পাঠকদের কাছেও আকর্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পেরেছেন, এমনটা খুব কম কবির ক্ষেত্রেই ঘটে। তিনি তার অনন্য কাব্যশক্তিগুণে এ অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন। তাকে আমার অভিনন্দন ও আলিঙ্গন। ‘রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বইউদ্যান। সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু।