আত্মপরিচয়ের অভাবে ভুগছে প্রকাশনাশিল্প: আবুল বাশার ফিরোজ
রেশমা হাওলাদার
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আবুল বাশার ফিরোজ ‘ধ্রুবপদ’ প্রকাশনার প্রকাশক। ২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য। সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী, জীবনানন্দ রচনাবলী, মানিক রচনাবলী এবং বিভূতিভূষণ রচনাবলীর সঙ্গে। এছাড়া একসময় তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালকও ছিলেন। এবারের বইমেলা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন রেশমা হাওলাদার
এবারের বইমেলায় অন্যান্য বছরের চাইতে নতুন কী মাত্রা যোগ হতে পারে?
: এবারের বইমেলা হচ্ছে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ বইমেলা। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জনীয় বইমেলা। স্বাস্থ্য সচেতন ওয়াশরুম, স্বাস্থ্য সচেতন পানীয়জল ও স্বাস্থ্য সচেতন ফুড কোর্ট-এর বইমেলা। ধর্মীয় বইয়ের সৃজনশীল উপস্থাপনার বইমেলা। স্বাধীন সাহিত্য চর্চার বইমেলা। উপরের সবগুলো বিষয়ই নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে এবারের বইমেলায়।
এবারের বইমেলায় স্টলবৃদ্ধিকে কীভাবে দেখছেন?
: দেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। বাড়ছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। বুদ্ধিদিপ্ত তারুণ্যের প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে নতুন স্বাধিকারের ‘৩৬ জুলাই’। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের দিন বৃদ্ধির সাথে এবারের বইমেলার স্টল বৃদ্ধি খুব ইতিবাচকভাবে দেখছি।
আপনি তো বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য, এবারের বইমেলার নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা কেমন থাকবে বলে আপনি মনে করেন?
: মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ থাকে, তেমনি থাকবে এবারের বইমেলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোলে মাতৃস্নেহ, ভালোবাসা এবং সর্বোচ্চ সচেতনায় নিরাপদ হবে এবারের বইমেলা। দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ, বাংলা একাডেমি ও সোহরওয়ার্দী উদ্যান মেলা চত্বরের প্রায় প্রতি ইঞ্চি জায়গা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে থাকবে। এছাড়া আনসার, পুলিশ, এসবি, ডিবি, সিআইডি, র্যাব, এনএসআই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএফএফ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় থাকবে এবারের বইমেলা। পোশাকি নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি থাকবে সাদা পোশাকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াও থাকবে।
এবারের বইমেলায় প্যাভিলিয়ন স্থাপনে নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
: অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি ২০২৫ এর কতিপয় প্রকাশক সদস্য প্যাভিলিয়নের চারিদিক খোলা রাখা প্রসঙ্গে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তা ইতিবাচক হয়ে যায়, কেননা প্যাভিলিয়নের দুই দিকে বন্ধ থাকলে সেখানে অবাঞ্চিত লোক সমাগম বা আড্ডা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। এছাড়াও রয়েছে প্যাভিলিয়নের অপর্যাপ্ত জায়গা এবং মেলার নান্দনিকতা। বইমেলার শেষ মিটিংয়ে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়, পরবর্তীতে উপস্থিত সকলের সম্মতিক্রমে বইমেলা সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা প্রদান করা হয় বাংলা একাডেমির ডিজিকে। বিষয়টি অবগত হয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি পৃথক দুটি চিঠির মাধ্যমে প্যাভিলিয়নের চারিদিক খোলা রাখার অনুরোধ করেন বইমেলার নিরাপত্তা ও নান্দনিকতার স্বার্থে।
অবশেষে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সভাপতি সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সভায় উপস্থিত সকলে এ বিষয়ে নিরাপত্তাজনিত ব্যাপক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন প্যাভিলিয়ন চারিদিক খোলা রাখার।
বর্তমান প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
: আত্মপরিচয়ের অভাবে ভুগছে প্রকাশনা শিল্প। আমরা লেখায় এবং কথায় প্রতিনিয়ত বলছি ‘প্রকাশনাশিল্প’ কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও প্রকাশনাকে এখনো ‘শিল্প’ ঘোষণা করা হয়নি। ফলে ‘প্রকাশনাশিল্প’ অনেকটা ‘বাথরুম সিংগার’ এর মতো মর্যাদাহীনভাবে বেঁচে আছে।
সৃজনশীল বই প্রকাশে যেরকম বৈচিত্র থাকার কথা, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সরকারি বই ক্রয়কে কী আপনি এ কারণে দায়ী করবেন?
: সাহিত্যে ‘কল্লোল যুগ’-এর পার আর কোনো যুগ আসেনি। এর মূল কারণ, প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের পর সাহিত্যিকদের আত্মগোপন করতে হয়েছে বা সেল্ফ-সেন্সর করতে হয়েছে। অন্য দিকে তোষামোদি বা সরকার তোষণ সাহিত্য সরকারের বই ক্রয় কার্যক্রমে আধিপত্যে- অপমৃত্যু ঘটেছে জাতির শক্ত পোক্ত রিডিং সোসাইটির এবং সাহিত্য আপাতত অচেতন অবস্থায় রয়েছে আই সি ইউ তে।
ফ্যাসিস্ট আমলে প্রকৃত প্রকাশকরা কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিল?
: বাকশাল, সামরিক শাসন এরপর শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনকে প্রায় সকালেই ফ্যাসিস্ট শাসন বলে। সেই বিবেচনায় এদেশে ফ্যাসিস্ট শাসনের মেয়াদ প্রায় তিন দশকের বেশি। ফলে প্রকাশকরা বাধ্য হয়েই তোষামোদি সাহিত্যিকের বই প্রকাশ করেছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।
প্রকাশনা শিল্পকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে কী করা দরকার?
: প্রকাশনাকে ‘শিল্প’ এর মর্যাদা দেওয়া উচিত সর্বাগ্রে। সেই সাথে সাহিত্যের উপর থেকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণও প্রত্যাহার করা উচিত
প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
প্রকাশনাকে ‘শিল্প’ ঘোষণা অত্যান্ত জরুরি এবং সরকারের বই ক্রয় কমিটি ও প্রকল্পে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রকাশক প্রতিনিধি রাখা দরকার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম কমিটিতেও সমিতির প্রকাশক প্রতিনিধি রাখা দরকার। এছাড়াও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যেকোনো পাঠ্যসহায়ক বই, পাঠ উন্নয়নমূলক বই ও প্রশ্ন-উত্তরের সহায়ক বইগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার।