Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের মাইকেল বিবেচনা

Icon

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ঠাকুর বাড়ির বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে মাইকেলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশে ও ইংল্যান্ডে মাইকেলের প্রীতিপূর্ণ সময় কেটেছে। তিনি সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবনস্মৃতি বইয়ে’ উল্লেখ করেছেন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয় তখন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসিতেন। আমার ভগিনীপতি শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাহার পরিচয় ছিল। মধুসূদনকে আমার বেশ স্পষ্টই মনে পড়ে। রঙ ময়লা, চুলগুলি ইংরাজী-ফ্যাশানে ছাঁটা বেশ কোঁকড়া-কোঁকড়া, মাঝখানে সিঁথি। চোখ দুটি বড় বড়, লোচন প্রতিভাদীপ্ত, চেহারা দোহারা, মুখশ্রী অপূর্ব লাবণ্য-সমুজ্জ্বল। তাঁহার গলার আওয়াজ ছিল একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা। আমার মনে পড়ে, একদিন তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র পাণ্ডুলিপি, তাঁহার সেই ভাঙা গলায় পড়িয়া সারদাবাবুকে শুনাইতেছিলেন। তখনও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয় নাই। তিনি অতিশয় সহৃদয়, আমুদে এবং মজলিশি ব্যক্তি ছিলেন। গল্প করিয়া লোককে মুগ্ধ করিবারও তাঁহার শক্তি অপূর্ব এবং অসাধারণ ছিল।”

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মাইকেল কর্তৃক যখন মেঘনাদবধ পঠিত হচ্ছে তখন রবীন্দ্রনাথ মাতৃগর্ভে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের চার মাস আগে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম খণ্ড (জানুয়ারি ১৮৬১) এবং এক মাস আগে দ্বিতীয় খণ্ড (এপ্রিল ১৮৬১) প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এ অবিস্মরণীয় কাব্য রবীন্দ্রনাথের সমবয়সি। একই বছরে প্রকাশিত হয় ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক। ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগ মুহূর্তে প্রকাশিত হয়। মাইকেলের চতুর্দশপদী কবিতাবলি প্রকাশের সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল পাঁচ।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেঘনাদবধ কাব্যের উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। এতে গর্বিত হয়ে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লিখে মাইকেল জানিয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও মাইকেলের সখ্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের আরেক ভাই হেমেন্দ্রনাথ তার পরিবারের মেয়েদের মেঘনাদবধ কাব্য পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে থিয়েটার চর্চার সূত্রপাত ঘটে মধুসূদনের নাটক দিয়ে। ‘জোড়াসাকোঁ নাট্যশালা’য় অভিনয়ের জন্য প্রথমে নির্বাচন করা হয় ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দুটি নাটকেই অভিনয় করেছিলেন। ঠাকুর বাড়ির পরিমণ্ডলের সঙ্গে মাইকেলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেনি। ‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তার শৈশবের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। মাইকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলে তিনি নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন। মাইকেলের সহপাঠী ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নর্মাল স্কুলের পাঠ্যতালিকায় মেঘনাদবধ কাব্য অন্তর্ভুক্ত হয়। ঠাকুরবাড়ির গৃহশিক্ষক নীলকমল ঘোষাল নর্মাল স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার কাছে ছয় থেকে নয় বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যালাভ করেছিলেন। তখন নীলকমলবাবু মেঘনাদবধ পড়িয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের। এ বয়স রবীন্দ্রনাথের মেঘনাদবধ কাব্য পাঠের অনুকূল ছিল না। শিক্ষার পাঠদানের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি বালক রবীন্দ্রনাথকে আরও অনাগ্রহী করে তুলেছিল। নীলকমল বাবুকে মনুষ্যজন্মধারী একটি ছিপছিপে বেত মনে করতেন তিনি। নীলকমল বাবু কাব্যরসিক ছিলেন না। ভাষা ও ব্যাকরণ শিক্ষার কাজে হাতিয়ার বানিয়েছিলেন মেঘনাদবধ কাব্যকে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মেঘনাদবধ কাব্যটিও আমাদের পক্ষে আরামের জিনিস ছিল না। যে জিনিসটা পাতে পড়িলে উপাদেয় সেইটাই মাথায় পড়িলে গুরুতর হইয়া উঠতে পারে। ভাষা শিখাইবার জন্য ভালো কাব্য পড়াইলে তরবারি দিয়া ক্ষৌরি করাইবার মতো হয়-তরবারির তো অমর্যাদা হয়ই, গণ্ডদেশেরও বড় দুর্গতি ঘটে। কাব্য-জিনিসটাকে রসের দিক হইতে পুরোপুরি কাব্য হিসেবেই পড়ানো উচিত, তাহার দ্বারা ফাঁকি দিয়া অভিধান ব্যাকরণের কাজ চালাইয়া লওয়া কখনোই সরস্বতীর তুষ্টিকরণ নহে।’ এ উক্তির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার অসাধারণ প্রতিফলন ঘটেছে।

এ বিরূপ অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের বালক মনে প্রভাব ফেলেছিল। সেই সময়ের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় মেঘনাদবধ কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি প্রবন্ধে। যথাক্রমে ষোলো ও একুশ বছর বয়সে তিনি প্রবন্ধ দুটি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি তাহার মূল লইয়া তাহার প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়।’

রবীন্দ্রনাথের এমন বিরূপ মনোভাব বহুদিন স্থায়ী ছিল। রবীন্দ্রনাথ এই মনোভাব কাটিয়ে ওঠেন পরিণত বয়সে। লজ্জিত হয়ে তিনি নিজের সমালোচনা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি লেখেন, ‘ইতিপূর্বে আমি অল্প বয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস, কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম।’

শুধু তাই নয়, কৈশোরে রচিত এ প্রবন্ধের জন্য রবীন্দ্রনাথের কঠোর সমালোচনা করেন যোগীন্দ্রনাথ বসু ‘নব্যভারত’ পত্রিকায়। এটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিব্রত ও অনুতপ্ত হন। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘বহুকাল হইল প্রথম বর্ষের ভারতীতে মেঘনাদবধ কাব্যের এই দীর্ঘ সমালোচনা বাহির হইয়াছিল। লেখক মহাশয় এই প্রবন্ধে তাহার প্রতিবাদ প্রকাশ করিতেছেন। তিনি যদি জানিতেন ভারতীয় সমালোচক তৎকাল পঞ্চদশ বর্ষীয় বালক ছিল তবে নিশ্চয়ই উক্ত লোকবিস্মৃত সমালোচনার বিস্তারিত প্রতিবাদ বাহুল্যবোধ করিতেন।’

রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি যে কত আন্তরিক ছিল পরবর্তী সময়ে একাধিকবার এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মাইকেলই যে বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রথম বিদ্রোহী এ সম্পর্কে তার অভিব্যক্তি, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে, কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃতি নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙ্গিয়াছেন... তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দবোধ করিয়াছেন।... যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া, যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্য লক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।’

মাইকেলের কাব্যের ভাঙন প্রক্রিয়া রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করে। বাংলার মাটি চিরকালই গীতরস প্রধান, বীররসের সমাদর এখানে কমই ঘটেছে। তাই মেঘনাদবধ কাব্যের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশি অনুরাগ দেখিয়েছেন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’র প্রতি। রবীন্দ্রনাথের নিজের কবিতাতেও মাইকেলের এসব কাব্যগ্রন্থের প্রভাব পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের মাইকেল প্রীতির উজ্জ্বল পরিচায়ক তার ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ বইটি। এ বইয়ে আধুনিক কবিতার সূচনা পর্বে ছিল মাইকেলের ছয়টি কবিতা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটেছে মাইকেলের হাতে এ সত্যেরই অনুরণন ঘটেছে তখন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘মধুসূদন আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রথম দ্বারমোচনকারী।’

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, রসজ্ঞানহীন শিক্ষকের ত্রুটিপূর্ণ পাঠদানের ফলে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিরূপতা জন্মেছিল। শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সেই ভুল করেননি। ১৯০৬ সালে দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন প্রতিষ্ঠা হলে দুটি শ্রেণির পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্ন প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ স্বর্গ থেকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন-

‘ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরী তীরে,

কপোত কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষ চূড়ে

বাঁধি নীড় থাকে সুখে; ছিনু ঘোর বনে,

নাম পঞ্চবঢী, মর্ত্ত্যে সুরবন সম।

গোদাবরী তীরে স্থিত রাম ও সীতার কুটির এমন বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা কর, যেন তাহা স্বচক্ষে দেখিতেছ; অর্থাৎ কুটিরের সম্মুখবর্ত্তী নদীর তটভাব কিরূপ, তাহার সমীপবর্ত্তী বনে কি কি গাছ কিরূপে অবস্থিত, কুটিরের মধ্যে কোথায় কি আছে তাহা প্রত্যক্ষবৎ লিখ।’ শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের প্রবেশিকা পরীক্ষায় মাইকেলের ‘বঙ্গভাষা’ কবিতা থেকে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি ‘চিরকুমার সভা’ নাটকের সূচনায় এ চরিত্রের মুখে মেঘনাদবধ কাব্যের প্যারডি বসিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রবন্ধে, নিবন্ধে, চিঠিপত্রে ও আলাপচারিতায় শ্রদ্ধার সঙ্গে মাইকেলের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। মাইকেলের কিছু কবিতার অনুবাদও করেছিলেন তিনি।

১৯৩৫ সালে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে ভাষণে মাইকেল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত মনোভাব জানা যায়, ‘মাইকেল সাহিত্যে যে যুগান্তর আনলেন তার অনতিকাল পরেই আমার জন্ম। আমার বয়স যখন অল্প তখন দেখেছি, কত যুবক ইংরাজি সাহিত্যের সৌন্দর্যে ভাববিহবল।... অথচ তাদের সমকালেই বাংলা সাহিত্যে যে নতুন প্রাণের উদ্যম সদ্য জেগে উঠেছে সে তারা লক্ষ্যই করেননি। সেটা যে অবধানের যোগ্য তাও তারা মনে করতেন না। সাহিত্যে তখন যেন ভোরের বেলা-কারো ঘুম ভেঙেছে, অনেকেরই ঘুম ভাঙ্গেনি।’

রবীন্দ্রনাথ তার চেনা ব্যক্তি ও বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত মত প্রকাশ করেছেন। মহৎ প্রতিভার এটিই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তারুণ্যে ও পরিণত বয়সে মাইকেল সম্পর্কে যেভাবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তা আর কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আধুনিক বাংলা কবিতার যে জয়রথের সূচনা ঘটিয়েছিলেন মাইকেল, সেই জয়রথকে আরও বিপুল বেগে ছুটিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একজন ছিলেন বাংলার রেনেসাঁসের প্রথম কবি, অন্যজন ছিলেন বাংলার রেনেসাঁসের শেষ কবি ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। মাইকেলের সবচেয়ে যোগ্য উত্তরসাধক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম