আয়ানের কথা শুনে আমার মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। ডানহাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলের স্পর্শ দিয়ে ঠোঁটের অবস্থা অনুভব করি। চৈত্রমাসের কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে যাওয়া ফসলের চৌচির মাঠ যেন! কেউ যখন তৃষ্ণা অনুভব করে অথবা শরীর পানিশূন্য হলে বা উদ্বেগ অনুভব করলে মুখ শুকিয়ে যায়। এটা তো সাধারণ ঘটনা। মুখ শুকিয়ে যাওয়াকে বলা হয় জেরোস্টোমিয়া। প্রথম যেদিন আয়ানের সঙ্গে দেখা হয় সেদিনও এ রকমভাবে গলা শুকিয়ে ছিল। মিছিলে স্লোগান দিচ্ছিলাম-
চাইতে গেলাম অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার!
তুমি কে? আমি কে?
রাজাকার। রাজাকার
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার স্বৈরাচার ...
ঠিক তখনই শাহবাগের মিছিলে পুলিশের হামলা শুরু হয়। আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারি ছুটতে থাকি। হাঁপাতে হাঁপাতে পড়ে যাই রাস্তায়। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল আমাকে। পেছনে পুলিশের গুলির শব্দ শুনে সে বলল, পালান। পালান।
আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না, পালাব কী? শরীর তখন থরথর করে কাঁপছিল। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। সে আমার চোখের দিকে তাকাল। তারপর আমাকে পাঁজা কোলে তুলে নিজেই দৌড়াতে লাগল। আমাদের পেছনে চার-পাঁচজন পুলিশ একজন ছাত্রীকে আক্রমণ করেছে। লাঠি দিয়ে, বন্দুকের ডাঁট দিয়ে পেটাতে থাকে। মেয়েটি তাদের হাত থেকে অস্ত্র, লাঠি কেড়ে নিতে চায়। অমনি সব জানোয়ার মার্কা পুলিশ এলোপাথাড়িভাবে তাকে লাথি দিতে থাকে। কী নির্মম নিষ্ঠুরতা! কী অমানবিক! সেই দৃশ্য দেখে আমি থ হয়ে গেলাম।
পঁয়ষট্টি কেজি ওজনের আমাকে নিয়ে কত আর দৌড়ানো যায়? সে একটা গলির ভেতরে ঢুকল। পরিবাগের গলি। এ গলি আমার খুব চেনা। সামনেই সাংস্কৃতিক বিকাশ কেন্দ্র। ওখানে একদিন কবিতার অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। কবি জাকির আবু জাফর ভাইয়ের সঙ্গে। চেনা পথ, চেনা গলি দেখে একটু যেন হুস ফিরে আসে। হঠাৎ লক্ষ করি, আমি তার গলা জড়িয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে ঝুলছি আর সে হাঁপাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক। তাকে বললাম, এবার নামিয়ে দিন। প্লিজ।
তখনই তার চোখে কী যেন খেলা করে গেল! এক ঝলক আলো যেন! এ কিসের আলো? কষ্টের? নাকি আনন্দের? একি! তার গালে গোলাপ কিভাবে রং ছড়িয়ে দিল? গোলাপি গাল! এ কিসের প্রতীক? শুনেছি, ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোলাপকে ফুলের প্রতীক হিসাবে তৈরি করার জন্য আইন স্বাক্ষর করেন। সে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে বলল, বিপদ কাটেনি, সাবধানে থাকবেন। আর মিছিলের অত সামনে থাকার দরকার নেই। শুধু শুধু বিপদের মুখে থাকবেন না। বুঝেছেন?
আমি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা।
বিপদের সময় অপরিচিত মানুষও ভীষণ আপন হয়ে ওঠে। কাছের হয়ে যায়। কি মনে করে যেন আমি তার একটা হাত চেপে ধরি। দরদ মিশিয়ে বললাম, আজকের কথা কোনোদিনও ভুলব না। আপনাকে সারা জীবন মনে রাখব। এ কথা শুনে তার নাক ঘামতে শুরু করে। কিশোরী বেলায় খেলার মাঠে যেসব ছেলেদের নাক ঘামত আমরা মেয়েরা সবাই মজা করে বলতাম, তোমার বউ তোমাকে অনেক আদর করবে। ব্যাস, তৎক্ষণাৎ সে রেগে যেত। আর মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠতাম। কি মধুর ছিল সেসব দিন! তার নাকের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম, আপনি অনেক ভাগ্যবান।
সে চোখ তুলে বলল, কেন? কিভাবে বুঝলেন?
অন্য আরেক দিন বলব, মুচকি হেসে বললাম তাকে।
কি নাম আপনার?
তমা
আমি আয়ান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। যদি বেঁচে থাকি তো ফের দেখা হবে। ভালো থাকুন।
বিদায় নিয়ে সে আবার শাহবাগের দিকে দৌড়াতে লাগল। তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে দোয়া করলাম, হে আল্লাহ তুমি তাকে সাহায্য কর। রক্ষা কর সব বিপদ থেকে।
ভেবেছিলাম, আর হয়তো দেখা হবে না। এত এত মানুষ! এত বিশাল মিছিলের ভিড়ে তাকে খুঁজে পাওয়ার কথাও না, কিন্তু এক সপ্তাহ পরে আবারও দেখা হয়ে গেল। মিছিলের ভেতর থেকে সে ঠিক খুঁজে নিয়েছে। কখন যে আমার পাশে এসে সমানতালে হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল তা টের পাইনি ঘুণাক্ষরেও। রোদের ভেতরে আমার মুখটা সে সময় রক্তজবা হয়ে ফুটেছিল। চিড়বিড় করছিল ভীষণ। দরদর করে ঘামতে থাকি। ঠিক তখন কেউ একজন ঠান্ডা পানির বোতল আর টিস্যু এগিয়ে দেয়। পানির বোতল নিতে যেয়ে চমকে উঠি, আয়ান! আপনি! কখন এসেছেন?
সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, বহু আগে। কিন্তু আপনার তো আশপাশে তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই।
কিছু বলতে পারিনি শুধু মিষ্টি করে হেসে তাকিয়ে ছিলাম তার চোখের দিকে। কি সুন্দর চোখ! দেখে মনে হয়, সরোবরে ফোটা দুটো পদ্ম! নীল পদ্ম! দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করে!
সে বলল, সামনে তাকান। সেদিনের মতো হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবেন তো! তখন আবার আমাকেই কোলে তুলে দৌড়াতে হবে হাসপাতালের দিকে।
লজ্জায় আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে ওঠে। তাকাতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকি। সে আমার হাতটা ধরতে চাইলে হাত সরিয়ে নেই। সে ইশারা করে বলল, সমস্যা কি?
কিচ্ছু না বলে একটুখানি হাসি দিলাম।
বুঝেছি। লজ্জা পাচ্ছেন। গুড। লজ্জা একটি প্রশংসনীয় বিষয়। হাদিসে এসেছে, আল্লাহ নিজে লজ্জা ও অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন।
তারপর থেকে একসঙ্গে মিছিল করা, মিটিং করা, জীবনবাজি রেখে আওয়ামী বাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এ রকম গণ-অভ্যুত্থানের ভেতরেও বন্ধুত্ব হয় তাহলে! সে একদিন বলেছিল, বাঁচলে সবাই একসঙ্গে বাঁচব আর যদি মরে যাই তাও একসঙ্গেই মরব।
সেদিন বুঝেছি, বন্ধুত্ব মানে আত্মার শক্তিশালী বন্ধন। একে অপরের সুখে-খুশিতে লাফিয়ে ওঠা, একে অপরের দুঃখে পাশে দাঁড়ান। মন খুলে কথা বলা, হেসে গড়াগড়ি খাওয়া আর চূড়ান্ত পাগলামি করার নামই বন্ধুত্ব। এ বাইশ বছরের জীবনে বহু বন্ধু পেয়েছি, তবে আয়ানের মতো এত ভালো বন্ধু পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। আয়ানের বন্ধুত্বের ভেতরে আছে সীমাহীন ভালোবাসা। রয়েছে আত্মার সঙ্গে আত্মার টান। গত পঁচিশে জুলাই সন্ধ্যারাতে আয়ানকে যখন পুলিশ গুলি করে, তখন আমি চিৎকার করে কেঁদেছি। আয়ান। আয়ান। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। চোখ খোলো আয়ান। চোখ মেলে তাকাও। আয়ানের পায়ে গুলি লাগে, ওকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান হয়। সারা রাত জেগেছি, কেঁদেছি। জায়নামাজ বিছিয়ে ওর প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি আল্লাহর কাছে। ওর বাবা-মা আসেন, উনারা দু’জনেই আমার জন্য দোয়া করলেন। আয়ানের মা বললেন, তোমাকেই চাই। আমি চমকে উঠি -জি।
তিনি বললেন, তুমি খুব ভালো।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। খালাম্মার চোখ দু’টো ঠিক আয়ানের মতো। মায়ের চেহারার সঙ্গে ছেলের চেহারার এত মিল! যেসব ছেলেদের চেহারা মায়ের মতো হয় সেসব ছেলেরা নাকি ভাগ্যবান হয়। আর তারা নাকি নারীদের কাছেও জনপ্রিয় হয়। হয়তো এ কারণেই নায়ক আমীর খান এত্তো জনপ্রিয়।
আজ আর মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে, মগজের নিউরোনগুলো ছোটাছুটি করছে দপদপ শব্দে। ঝিম মেরে বসে আছি আয়ানের বেডের পাশে, ছোট্ট একটা টুলে। আয়ান আবারও বলল, তমা তুমি কি ইয়ামিনকে চিনতে? ওকে কি ভুলে গেলে?
ইয়ামিনকে কি করে ভুলি? সহজ সরল মেধাবী ইয়ামিনের বাড়ি তো সাভার ব্যাংক টাউনে। আমাদের বাড়ির জানালা থেকে ইয়ামিনের বাড়ি দেখা যায়। কি সুন্দর ভদ্র আর নামাজি পরিবার! সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়ার সময় একদিন আমাদের বাড়িতে সে এসেছিল। কি মায়াবী চেহারার বিনয়ী ছেলে! কত স্মৃতি! সে আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়ত। একসঙ্গে ঘুরে বেড়াত।
আয়ান আবার বলল, ইয়ামিনকে এপিসিটির ওপর থেকে রাস্তায় ফেলার দৃশ্যটা ভুলতে পারছি না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে কিভাবে রাস্তায় ফেলে দিল? উহঃ তমা ভুলতে পারছি না। কি অমানবিক!
নিজের দুই ঠোঁট নিজেই কামড়ে ধরে রাখি। চোখের পানি আটকে রাখতে চেষ্টা করি। আহারে! রাস্তায় পড়ে থেকে টেনে টেনে নিশ্বাস নেওয়ার দৃশ্য, ইয়ামিনের সেই ঢোক গেলার দৃশ্য মনে পড়লেই কান্নায় ভেঙে পড়ছি। অনেক কেঁদেছি। এমন মৃত্যু কি সহ্য হয়? হয় না। হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আজ ভোরেই তো ইয়ামিনের কবরে গিয়েছি। ওর আদরের পোষা বিড়ালটা ওর কবরের উপরে শুয়ে ছিল। ওকে কবর দেওয়ার পর থেকেই বিড়ালটা ওখানেই আছে। কোথাও যাচ্ছে না, কিচ্ছু খাচ্ছেও না। মুনিবকে পাহারা দিচ্ছে হয়তো, হয়তো মিস করছে। হয়তো শোক প্রকাশ করছে। বিড়ালটাকে দেখে মনে মনে ভাবলাম, ছোট্ট পশুও মানুষের জন্য মায়া করে আর স্বৈরাচারী হাসিনার পশুরা গুলি করে মানুষ মারছে নির্বিঘ্নে। ওদের হৃদয়ে এতটুকুও দয়ামায়া নেই। আওয়ামী লীগ আসলে পশুর দল। অমানুষের দল।
তমা, কথা বলছ না কেন? কী ভাবছ? আয়ানের কণ্ঠের সুর আমাকে সজাগ করে তোলে। আমি ওর দিকে তাকাই। শুনছি। বল।
তুমি আমাকে একবার ইয়ামিনের কবরে নিয়ে চল। ওর কবরটা জিয়ারত করতে চাই। নিবে না?
অবশ্যই নিয়ে যাব। তুমি সুস্থ হও। তোমার পা ভালো হোক তারপর ইয়ামিনের কবর জিয়ারত করবে। ইনশাল্লাহ।
আয়ান চুপ হয়ে গেল। তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সে একদৃষ্টিতে তার কাটা পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার দু’চোখের ভেতরে দুটো নদী কুলকুল করে বইতে শুরু করেছে। এই নদী এত কেন কুলকুল শব্দ করে? আমার তো ভালো লাগে না।
আয়ানের নাকের পাতা কাঁপতে শুরু করলে আমি তার হাতটা ধরে বলি-জীবনের একমাত্র ধ্রুবক হলো পরিবর্তন, যা কখনো পরিবর্তন হয় না।