Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

পরিবর্তিত সময়ের সাহিত্য ভাবনা

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবর্তিত সময়ের সাহিত্য ভাবনা

তরুণরা অগ্রসর চিন্তার মানুষ

ড. মাহবুব হাসান, কবি

সাহিত্য পুরস্কার

ফ্যাসিবাদ আমলে দেওয়া বাংলা একাডেমির ৯০ শতাংশ পুরস্কার ভুয়া। সামনে এমন একজনকে পুরস্কৃত করা দরকার যিনি প্রকৃত অর্থে মেধাবি, নতুন, প্রকৃত অর্থেই ভালো সাহিত্য রচনা করতে পারে। যার কাব্যমূল্য কি সেটা বিচার করার জন্য প্রচলিত যে ধ্যান, যে কাব্য বিচারবোধ, তা দিয়ে বিচার করা যাবে না; সেসব চৈতন্যকে ধারণ করার জন্য চাই নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টি, নতুন ভঙ্গি, নতুন কিছু। যেটা থেকে তৈরি হবে নতুন মহাবয়ান। আগেরকার বয়ান নিয়ে এভাবে লিখতে হবে, সেভাবে লিখতে হবে; এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

তরুণদের বিষয়ে

তরুণরা হলো অগ্রসর চিন্তার মানুষ। তরুণরা যা ভাবতে পারে, অগ্রজরা তা ভাবতে পারে না। জগৎজুড়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে-পৃথিবীজুড়ে তরুণরাই একমাত্র প্রতিবাদী। বুঝে হোক বা না বুঝে। তাদের জায়গা করে দিতেই হবে বাংলা একাডেমিকে। যারা চিন্তাশীলতায় নতুন, যারা চিন্তা ভাবনায় স্বাধীন তাদেরই পুরস্কৃত হওয়া উচিত। তাহলে কী হবে-পরবর্ত প্রজন্ম অগ্রসর চিন্তাকে ধারণ করবে এবং জাতীয় যে চৈতন্য সেটা এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মনে করি, বাংলা একাডেমির উচিত এ আবর্জনা ফেলে দিয়ে নতুনদের চিন্তাকে যুক্ত করা।

গবেষণা

বাংলা একাডেমি একটি গবেষণামূলক জাতীয় প্রতিষ্ঠান। অথচ এর গবেষণা নাই বললেই চলে। যা আছে খুবই সীমিত। বাংলা একাডেমিতে গবেষণার পাশাপাশি এটাকে মননশীল সাহিত্য প্রকাশকও হওয়া উচিত ছিল। এখানে অনুবাদের কাজ করে সারা বিশ্বে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। বাংলা একাডেমিকে জাতীয় প্রতিষ্ঠান করে তুলতে মিনিমাম ২০০টি বই অনুবাদ করতে হবে। যেন অন্য দেশের মানুষ আমাদের সাহিত্য নিয়ে ভাবে।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার মিনিমাম বিশ লাখ টাকা হওয়া উচিত

রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সাহিত্য পুরস্কারে দলীয়করণ

আমি মনে করি যারা যোগ্য, বাংলা সাহিত্যে অনবদ্ধ ভূমিকা রেখেছে, সে রকম অনেক লেখক বাংলাদেশে আছে। শুধু ঢাকা শহরে নয়, রাজধানীর বাইরে মফস্বল শহরগুলোয় যারা লেখালেখি করেন সেসব লেখক কিন্তু বঞ্চিত। তারা ঢাকা শহর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। তাদের কণ্ঠস্বর এ পর্যন্ত আসে না। একতরফা দলীয়করণের কারণে, এসব লেখক বঞ্চিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এবারও বাংলা একাডেমিতে আমি লক্ষ করেছি, যাদের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তারা অনেকেই ফ্যাসিবাদের দোসর এবং যে সংস্কারের কথা আমরা শুনেছি, তার ছিটেফোঁটা কিন্তু বাংলা একাডেমিতে নেই। বাংলা একাডেমিকে জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে একটা সংস্কারের প্রস্তাব আমরা দিয়েছিলাম। সেটিও মান্য করা হয়নি। ভবিষ্যতে মান্য করা হবে কিনা আমরা জানি না। বাংলা একাডেমি হচ্ছে জাতির মননের প্রতীক। তার প্রতিফলন কিন্তু গত ছয় মাসে আমরা দেখতে পাইনি। একুশে পদক কাদের দেওয়া হবে, সেটিও আমরা জানি না।

গতবারও একুশে পদক বিতর্কিত লোকদের দেওয়া হয়েছে। আজীবন যারা সাহিত্য খোঁজে, সাহিত্যের সঙ্গে আছে, নিবেদিত প্রাণ; সেসব মানুষকে পুরস্কৃত করতে হবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য বাড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পে এত এত টাকা ব্যয় করা হয়। আর একুশে পদকে মাত্র তিন-চার লাখ টাকা দিয়ে বুঝ দেওয়া হয়। আমি মনে করি, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেককে মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ টাকা দেওয়া উচিত। বাংলা একাডেমি পুরস্কার মিনিমাম বিশ লাখ টাকা হওয়া উচিত। বাজার বিবেচনায় হলেও এমনটি হওয়া উচিত। তাহলে আমাদের সংস্কারটা মূল জায়গাতে আসবে। একজন লেখক সারা জীবন ধরে লেখে, তার অর্জন কী? আর পাঠ্যপুস্তকে যেসব কবিদরে কবিতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোর কোনো ছন্দ নেই। কবিতা হচ্ছে না। আগে যে রকম করা হয়েছিল, এখনো সেরকম করা হচ্ছে। আমরা কিন্তু এর প্রতিবাদ করব। আমরা নজরুলের সৈনিক দ্রোহ করতে জানি। ভালোবাসতেও জানি।

বইমেলা

আমি মনে করি, যারা স্বৈরাচারের দোসর ছিল, যারা একটি বিশেষ দলের বই বের করে লাখ লাখ টাকা আয় করেছে; বইমেলা থেকে তাদের বাদ দিতে হবে। বিশেষ কাউকে প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে দিয়ে, ধনীর পর ধনী করে ফেলা, লেখকদের সম্মানী না দেওয়া, কম দেওয়া, তরুণ লেখকদের কাছে টাকা নিয়ে বই বের করা; এসব আমি পছন্দ করি না। এসব অবশ্যই সংস্কারের অংশ হওয়া উচিত। যারা ভালো বই বের করে এমন প্রকৃত, নিরপেক্ষ, ভালো প্রকাশকদের স্টল বরাদ্দ দিতে হবে। আমি ব্যক্তিগত বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত বা যে কোনো দলই করতে পারি; তবে তার প্রতিফলন যেন আমার স্টলে না ঘটে, পাঠক যেন বঞ্চিত না হয়। এমনটিই হওয়া উচিত।

তরুণদের বিষয়ে

আমি মনে করি, তরুণ লেখক প্রকল্প আগে যেটা ছিল, সেটাকে রিভাইস করে নতুনভাবে সাজানো উচিত। তরুণদের জন্য আলাদা আলাদা সেক্টর খোলা, গবেষণা, পত্রিকা বের করা উচিত। ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তরুণদের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কবি সাহিত্যিকরা কেমন সাহিত্যচর্চা করেন এগুলো দেখতে হবে বুঝতে হবে। আর আমাদের সাহিত্যচর্চা পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য অনুবাদ হওয়া উচিত। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে না লাগালে আমরা এগোতে পারব না।

কবি-সাহিত্যিকদের দায়

আমরা লক্ষ করেছি কিছু কবি-সাহিত্যিকরা দালালি করে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। তাদের মানহীন কবিতা পাঠ্যপুস্তকে গেছে। তাদের বইগুলো হাজার হাজার কপি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয়েছে। বিগত ফ্যাসিবাদ আমলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য আমার একটি বইও কেনা হয়নি। তাহলে আমরা কতটা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হলাম। পৃথিবীতে ৪২টি ভাষায় আমার কবিতা অনূদিত হয়েছে। বিশ্বের বড় প্রকাশনী থেকে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। কিন্তু সরকার নেয়নি আমার বই। সরকার যে বইগুলো কিনেছে, সেখানে একটা ছোট্ট বই পাঁচ-ছয় হাজার টাকা দামেও কিনেছে। এসব হতে পারে না। মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘যখন দেশ পচে, বুদ্ধিজীবীর মাথা থেকে তা শুরু হয়।’ সুতরাং ওইসব দলবাজ, দালাল বুদ্ধিজীবীদের মাথা থেকেই দেশ পচন ধরেছিল।

সংলাপহীন পরিবেশ প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটায়

কুদরত-ই-হুদা, লেখক, গবেষক, শিক্ষক

ফ্যাসিস্ট আমলে সাহিত্যচর্চা

সাহিত্যচর্চার সঙ্গে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই; থাকার কথা না; উচিত না। যার থাকে সে তো সাহিত্যিক না। সাহিত্যিকের কাজ কারও পারপাজ সার্ভ করা না। নিজের চিন্তার পারপাজ সার্ভ করা। কিন্তু গত আমলে এবং অন্য নানা আমলে কিছু লেখক নির্দিষ্ট আদের্শের পার্পাজ সার্ভ করার কাজে লিপ্ত হয়েছিল; সব সময় হয়। এরা সাহিত্য সমাজে এক ধরনের আপাত নুইসেন্স তৈরি করে। এটা কখনো কখনো প্রকৃত লেখককে কিছুটা বিরক্ত-বিপন্ন করেও তোলে। এ পরিস্থিতি গত আমলে ছিল। আরেকটা ব্যাপার তো ছিলই যে, অনেক কিছু বলতে গেলে যেভাবে বলতে চাই সেভাবে হয়তো বলতে পারিনি। অন্যভাবে বলতে হয়েছে। তখন একটু অসহায় লাগত। কখনো কখনো নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন মনে হতো। কিন্তু যা বলার তা বলেছি।

সাহিত্যচর্চার পরিবেশ

ওই যে আগে যে সমস্যার কথা বললাম, যা লেখককে বিরক্ত-বিপন্ন, অসহায় করে তেমনটি আর না থাক। কিন্তু আপনি তো জানেন, সেটা বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সত্যিই সোনার পাথর বাটি।

একটা সংলাপধর্মী পরিবেশ প্রত্যাশা করি। আমাদের এখানে সংলাপের স্পেস নেই। সংলাপহীন পরিবেশ প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটায়। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়; শিল্প-সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য। ভবিষ্যতে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় সংলাপী চেতনা তথা গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি তৈরি হোক সেটা চাই। মানে যার যার চিন্তা সেই সেই তার মতো করে প্রকাশ করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের ভেতর ব্যাপারটা দেখা না গেলে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ, রাষ্ট্রের মনোভঙ্গি বা খাসলতই আসলে পানির মতো চুইয়ে চুইয়ে নানা সেক্টরে ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে। দেখা যাক কতদূর কী হয়।

বইমেলা

বইমেলাকে আমি ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি না। দেখি এর আয়োজক-প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সক্ষমতা কতটুকু সেই দৃষ্টিকোণ থেকে। আমার ব্যক্তিগত ভাবনায় অনেক বড় বড় সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনার ব্যাপার আসতে পারে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের সামর্থ্য বাংলা একাডেমির আছে কি না সেটা মাথায় রেখে কথা বলা দরকার। এইদিক ভেবে বললে বলতে হয়, বাংলা একাডেমি বরাবর যেভাবে বইমেলার আয়োজন করে সেটা যথেষ্ঠ ভালো বলে আমি মনে করি। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ আন্তরিক থাকলেই তার যে-সামর্থ্য আছে সেটা দিয়ে একটা ভালো বইমেলা বরাবরের মতো এবারও করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

বিগত বছরগুলোতে দেখেছি, কখনো কখনো কিছু কিছু প্রকাশনা সংস্থাকে ভিন্নমতের বই প্রকাশ করার অজুহাতে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এই ধরনের ঘটনা যাতে এড়ানো যায় সেদিকে মেলা কর্তৃপক্ষ খেয়াল রাখলেই চলবে। মেলাটাকে যেন সবাই তার নিজের বলে মনে করতে পারে এমন পরিবেশ ও পদ্ধতির সন্নিবেশের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি আন্তরিক থাকলেই হবে। নতুন মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম প্রাজ্ঞ-পন্ডিত-পরমতসহিষ্ণু একজন মানুষ বলে জানি। তিনি এটা নিশ্চিত করতে পারবেন বলে মনে করি।

সাহিত্য পুরস্কার

বাংলা একাডেমির পুরস্কার তার জন্মলগ্ন থেকেই বিতর্ক তৈরি করে করে এতদূর এসেছে। রাজনৈতিক তাবেদারি বাংলা একাডেমি পুরস্কার খাটে নাই এমন বছর দেখাতে পারবেন? কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখি। আসলে বাংলা একাডেমির পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে এটা আমি মনে করি না। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার-প্রধান কি ফোন করে বলেন যে একে-ওকে-তাকে পুরস্কার দেন! এই কাজটা করে থাকেন পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের সাহিত্যিক এজেন্টরা। পুরস্কার প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্টরা এই এজেন্টশিপ মানসিকতাটা একটু কমালেই পারেন। তাহলেই পুরস্কার অনেকটা ফেয়ার হয়ে উঠবে। তবে যেহেতু এটা বাংলাদেশ সেহেতু এখানে শতভাগ ফেয়ারনেস আপনি পাবেন না। এজন্য আমদের সময় লাগবে। চারদিকে সবকিছু পঁচা থাকবে আর বাংলা একাডেমি পুরস্কার শতভাগ ঠিকঠিকভাবে দেয়া হবে এটা আশা করেন কী করে!

সরকারি বই কেনা

বই কেনাকাটা প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেকার সরীসৃপ মানসিকতা যতটা সম্ভব ত্যাগ করতে হবে। বুকে ভর দিয়ে নয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের মতো করে সিলেকশানটা দিতে হবে। যোগ্য, পড়াশুনা জানা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লোকদের এর সাথে যুক্ত করতে হবে। তাহলেই পুরোপুরি না হলেও অনেকটা ঠিকঠিক বইগুলো বাছাই করা যাবে। সংশ্লিষ্টদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, প্লিজ বাজে বই কেনাকাটায় অন্তর্ভুক্ত করে বই সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল বার্তা দেবেন না। আপনার বাছাই করা বাজে বইটা পড়ে পাঠক মনে করবেন, বই ব্যাপারটাই বোধ হয় এমন ফালতু। কিন্তু আসলে তো তা নয়!

রাজনৈতিক বাটখারায় পুরস্কার

জাকির আবু জাফর, কবি ও কথাসাহিত্যিক

পুরস্কার দলীয়করণ

গত ষোলো বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কারের যে ধারাটি চলছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বাটখারা দিয়ে মেপে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এক সময় বাংলা একাডেমির স্লোগান ছিল জাতির মননের প্রতীক। এটিকে করা হয়েছে বাঙালি জাতির মননের প্রতীক। এখানে সাম্প্রদায়িক স্লোগান ঢুকানো হয়েছে। আমাদের আরও অনেক জাতিগোষ্ঠী এখানে বসত করে, তারা কোথায় যাবে? কে কত বড় চেতনা ধারণ করেছে, একজন ব্যক্তির নাম কতবার উচ্চারণ করতে পেরেছে এবং সে ব্যক্তিকে নিয়ে কতটি বই লিখতে হয়েছে-তার ওপর পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে।

আমি মনে করি, প্রত্যককে তার যোগ্যতা অনুযায়ী পুরস্কার দিতে হবে। যিনি যে কাজের যোগ্য, যিনি যে সেক্টরের যোগ্য সে বিষয়েই পুরস্কার দেওয়া উচিত।

ফ্যাসিবাদ কায়েমে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা

বিগত ষোলো বছর ধরে স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট এখানে একনায়কতন্ত্র চেতনার নামে যা ইচ্ছা তাই করেছে। স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে, ভোট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এসব একদিনে হয়নি, এই দেশ একদিনে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের কিছু কবি-সাহিত্যিক ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগিতা করেছে। অকারণ তোষামদের দিকে নিয়ে গেছে। তার নামে বা তার বাপের নামে শত শত নয়, হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের একটা বড় দায়িত্ব হলো, তারা সত্যকে তুলে ধরবে। মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকবে। কবি-সাহিত্যিকরা একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে। লেখকদের দায়িত্ব হলো পুরো জাতিকে, ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর স্বপ্ন দেখাবে। সবার অধিকার যেন রক্ষা হয়, সে বিষয়ে তারা ভূমিকা পালন করবে।

সরকারি বই কেনা

কোটি কোটি টাকার বই কেনা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। যেসব বই কেনা হয়েছে, তার সিংহভাগই একটি পরিবারের নামে। এটি আরও জঘন্য এবং ভয়ানক বলে আমি মনে করি। বই কেনার ক্ষেত্রে আমার একই কথা, মানসম্পন্ন বই কিনতে হবে। যে বিভাগের বই কেনা হবে, তা মানসম্পন্ন কিনা, সুন্দর বা সুস্থ কিনা, যথার্থ কিনা, জাতি বা মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখে কিনা, দেশের পক্ষে কিনা, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয় এমন সব বিষয় বিবেচনায় বই অবশ্যই কেনা উচিত। এক কথায় বলতে চাই, পাঠকের জন্য যথার্থ বই কিনতে হবে।

বইমেলা

বইমেলা হলো মননের মেলা, জীবনের মেলা। আমি মনে করি এটি জ্ঞানেরও মেলা। জ্ঞান তো বইয়ের পৃষ্ঠায় লুকিয়ে থাকে বা মহাকাল লুকিয়ে থাকে বইয়ের পাতায়। আমরা সে গ্রন্থগুলোকে উন্মোচন করি। আমি একশ বছর আগের বই পড়া মানে হলো, একশ বছর আগের মানুষের সঙ্গে কথা বলা। একশ বছর আগের পৃথিবীর সঙ্গে কথা বলা। এ মেলাটি হবে আমাদের জাতীয় মানের। যেখানে আমরা জাতিকে নিতে চাই সেই মানে। জাতি যেখানে আছে, সেখানে নয়। যেখানে আমরা জাতিকে নিতে চাই, সে মানের মেলাটি করতে হবে। সে মেলার ব্যাপারেও ঘুরে ফিরে কথা একটি হবে, একটি জাতি পৃথিবীতে উন্নত বা সভ্য হওয়ার জন্য বা সর্ব উত্তম হওয়ার জন্য যে বৈশিষ্ট্য দরকার। সেসব নিয়ে লেখকদের ভাবতে হবে এবং লিখতে হবে। প্রকাশকদের সেই বই প্রকাশ করতে হবে। যে প্রকাশনাগুলো এসব বই প্রকাশ করবে, তাদের সুযোগ দিতে হবে। এখানে সাময়িক কোনো চেতনা বা বাঙালি সংস্কৃতির নামে ধর্মকে ক্রিটিসাইজ করা হয় বা ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। এটিকে আমরা কখনো গ্রহণ করব না। আমাদের বিশ্বাস নিয়ে, এ মাটি, এ জাতির যে বিশ্বাস। এ মাটির যে গন্ধ, সে গন্ধ সম্পৃক্ত বই দেখতে চাই। এ জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে মেলবন্ধন রেখে, এ জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন রেখে বইমেলার আয়োজন দেখতে চাই।

বাংলা একাডেমির হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছি

ড. মোহাম্মদ হারুন রশিদ

পরিচালক, গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ, বাংলা একাডেমি

বাংলাদেশের ইতিহাসে পুরো জাতি সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বিগত ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালে, ফ্যাসিবাদ পতনের আগ পর্যন্ত। এ সময়ে আমাদের গণতন্ত্র, মানবধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানুষের মর্যাদা সত্যিকার অর্থে কিছুই ছিল না। বাংলা একাডেমি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেই অর্থে একই পরিবশে পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ১৯৫৫ সালে ৩ ডিসেম্বর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রচার প্রসার, সংরক্ষণের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সময়ে এখানে অনেক মহাপরিচালক এসেছেন। ১৯৮২ সালে কবি মনজুরে মওলা এসেছিলেন। ওনি অনেক যোগ্য, দক্ষ ডিজি ছিলেন। বিভিন্ন সংস্কার করেন। বাংলা একাডেমিতে পেনশনের সিস্টেম ছিল না কিন্তু উনি সেটা চালু করেন। এটা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার ছিল। ১৯৭৭ সালে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর আমলে সবচেয়ে জঘন্য একটা নিয়ম চালু করেন। তিনি সরকারি কলেজ থেকে ডিজি হয়ে আসেন। পরিচালকদের বেতন কাঠামো অধ্যাপকের চেয়ে ধাপ ওপরে ছিল। ওনি দেখলেন যে তিনি ডিজি অথচ তার বেতন কাঠামো পরিচালকদের চেয়ে এক ধাপ নিচে, তারপর তিনি পরিচালকদের বেতন কাঠামো দুই ধাপ পিছিয়ে দিলেন। আমরা সে যৌক্তিক অধিকার আদায়ে বর্তমান মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা ১ ফ্রেব্রুয়ারি সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার একাডেমিতে এলে তা উপস্থাপন করব।

বাংলা একাডেমি যে একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ২০০৯ সাল থেকে কিন্তু সে রকম কোনো কিছুই হয়নি। বাংলা একাডেমির মৌলিক যে কাজগুলো-বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, চর্চা, লালনপালন কিছুই হয়নি বলা যায়। আমরা যারা এখানে কাজ করেছি, কারও কোনো স্বাধীনতা ছিল না। যেমন বিগত পনেরো বছরে মানুষের ভোটের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ছিল না, তেমনি বাংলা একাডেমিও এ সময় তেমন অবস্থায় ছিল। সব সময় বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের গুণগান স্মরণসভা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত বাংলা একাডেমি প্রশাসন।

এখন বাংলা একাডেমি নিয়ে আমরা আশাবাদী। যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বর্তমান ডিজির নেতৃত্ত্বে বাংলা একাডেমি যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তা বিনির্মাণে এগিয়ে চলছেন। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন, সামনে অনেক ভালো কিছু হবে বলে আমরা ভীষণ আশাবাদী। গোটা জাতি সেটা খুব শিগ্গির জানতে পারবে। আমরা আশা করি বাংলা একাডেমি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

দুর্নীতিগ্রস্তরা যেন বাংলা একাডেমিতে না থাকে

পাপড়ি রহমান, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

বাংলা একাডেমি

আমি চাই বাংলা একাডেমি একদম নিরপেক্ষ থাকুক। সব ধরনের দলাদলির বাইরে থাকুক। এই প্রতিষ্ঠান পবিত্র থাকা উচিত, এখানে যেন কেউ দুর্র্নীতি না করে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যেন বাংলা একাডেমিতে না থাকে।

সাহিত্য পুরস্কার

এটা সব সময় আমি বলে এসেছি বা এখনো বলে থাকি সচরাচার। বাংলা একাডেমির পুরস্কার মানেই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। যিনি সত্যি সত্যি ভালো লিখছেন, যিনিই লিখুক না কেন, তিনি পুরস্কারটি পাক। এতে দেখা যাবে অনেক নিভৃতচারী লেখক, অনেক ভালো লিখছেন। কখনো সেভাবে জাতীয়ভাবে পরিচিতিতে আসে না তারা। বাংলা একাডেমির দায়িত্ব তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করা।

তরুণদের বিষয়ে

তরুণ লেখক প্রকল্প চালু ছিল। এখন কী অবস্থা সঠিক জানা নেই। এটা খুব ভালো বিষয় ছিল। এখানে আরেকটি বিষয় হতে পারে-পুরস্কার শুধু সিনিয়রদের দেওয়া হয়, এমনটা না করে বাংলা একাডেমি বয়সসীমা নির্ধারণ করে তরুণদেরও পুরস্কার দিতে পারে।

বইমেলা

বইমেলায় প্রচুর প্রকাশক ও স্টল দেখি। আসলে কি এত প্রকাশক আছে বাংলাদেশে। চিন্তুাভাবনা করে একদম প্রকৃত প্রকাশক যারা, তাদেরই স্টল বরাদ্দ দেওয়া উচিত। যদিও এটা কঠিন কাজ। আবার বই বাছাই করে প্রকাশ করলে সেটা অনেক ভালো হয়। মানহীন বই বের করে জঞ্জাল বাড়ানোর দরকার নেই। প্যাভিলিয়ন করা হয় বড় বড় জায়গাজুড়ে। আমার মনে হয় এটাও দরকার নেই। তিনটা বা চারটা স্টল একজন প্রকাশককে দিলেই হলো।

গ্রন্থনা : ফরিদুল ইসলাম নির্জন, উম্মে সায়মা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম