বাঘ বেঁধে রাখা সহজ, মুহূর্তকে বেঁধে রাখার চেয়ে। মুহূর্ত চলে যায় অনন্তের পথে। আর সেই পথ ধরেই আসে মৃত্যুর পরোয়ানা। অন্ধ জাতিস্মর কিনারা করে উঠতে পারে না কিছুই। তার প্রাণহীন চোখ থেকে হারিয়ে যায় কার্তিকের মাঠ, তার ওপর চড়ুইভাতির রোদ, ঝিঁঝি পোকাদের অকারণ ছোটাছুটি, ঘরময় ছড়িয়ে থাকা পাণ্ডুলিপি, বারান্দার কোনে নুয়ে পড়া হাসনা-হেনার চারা, ঝুড়ি চাপা বেড়ালছানা-চারদিকে শুধু এক নিমেষহারা অন্ধকার। এমন কৃষ্ণগহ্বরের কাছে ধরা দিয়ে ২০২৪ সালে শিল্প-সাহিত্যের যেসব গুণিজন আমাদের ছেড়ে গেছেন, তাদের স্মরণেই এ আয়োজন। লিখেছেন উম্মে সায়মা
হেলাল হাফিজ: ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’-এ কালজয়ী পঙ্ক্তির কবি হেলাল হাফিজ ১৩ ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে হেলাল হাফিজের জন্ম। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে খ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান।
জাহিদুল হক: ষাটের দশকের কবি, গল্পকার, গীতিকার জাহিদুল হক ১৫ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান। সুবীর নন্দীর গাওয়া জাহিদুল হকের লেখা ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। জাহিদুল হকের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প-গান মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি। তার প্রথম কবিতার বই ‘পকেট ভর্তি মেঘ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-‘পকেট ভর্তি মেঘ’, ‘তোমার হোমার’, ‘নীল দূতাবাস’ ও ‘এ উৎসবে আমি একা’।
মাকিদ হায়দার: ষাটের দশকে সময়ের প্রয়োজনে যারা একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সৃষ্টি করে গেছেন একের পর এক দুর্দান্ত সব কবিতা, কবি মাকিদ হায়দার তাদেরই একজন। ১০ জুলাই সকালে উত্তরার নিজ বাসায় ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কবি। ১৯৪৭ সালে পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি মাকিদ হায়দার লিখেছেন ‘রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা’, ‘আপন আঁধারে একদিন’, ‘কফিনের লোকটা’ ও ‘পার্থ ও প্রতিম’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়া রয়েছে তার গল্প ও প্রবন্ধের বই।
ড. গোলাম মুরশিদ: বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক অধ্যাপক ড. গোলাম মুরশিদ লন্ডনে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। গোলাম মুরশিদ একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক লাভ করেন। তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘মাইকেলের জীবন ও পত্রাবলী’, ‘আশার ছলনে ভুলি’, ‘সংকোচের বিহ্বলতা’, ‘নারীপ্রগতির একশো বছর: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া’, ‘কালান্তরে বাংলা গদ্য’, ‘যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’। গোলাম মুরশিদ কখনো ‘হাসান মুরশিদ’ ছদ্মনামেও লিখতেন।
অসীম সাহা: কবি অসীম সাহা ১৮ জুন ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য অসীম সাহা ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। কবিতা-উপন্যাস ছাড়াও অসীম সাহা লিখেছেন প্রবন্ধ-গান। অসীম সাহা ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন।
এলিস মুনরো: সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী কানাডীয় লেখক এলিস মুনরো ১৩ মে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এলিস মুনরোর গল্পে যে অন্তর্দৃষ্টি ও সমবেদনা ফুটে উঠত, সেজন্য তাকে প্রায়ই রাশিয়ার লেখক আন্তন চেখভের সঙ্গে তুলনা করা হতো। ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করা মুনরো গভর্নর জেনালের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনবার। এছাড়াও ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেন এলিস মুনরো।
ইসমাইল কাদারে: ম্যান বুকার পুরস্কারজয়ী প্রখ্যাত আলবেনীয় ঔপন্যাসিক ইসমাইল কাদারে ১ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ জানুয়ারি ১৯৩৬ জন্মগ্রহণ করা কাদারে ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অফ দ্য ডেড আর্মি’ প্রকাশের আগ পর্যন্ত কবিতায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু উপন্যাসটি তাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত করে তোলে।
এডনা ও’ব্রায়েন: বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও বিষণ্ন কণ্ঠগুলোর মধ্যে একজন আইরিশ ঔপন্যাসিক এডনা ও’ব্রায়েন গত ২৭ জুলাই ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ও’ব্রায়েন ছিলেন একজন বিশ্ব নাগরিক, সর্বদা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং এমন একজন প্রাণবন্ত শক্তি, যিনি তার চিন্তাভাবনাগুলো একটি বৃহৎ পাঠকশ্রেণির কাছে পৌঁছে দিতে জানতেন। প্রায় ষাট বছরের লেখক ক্যারিয়ারে ও’ব্রায়েন উপন্যাস, ছোটগল্প, নন-ফিকশন (যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেমস জয়েস ও লর্ড বায়রনের জীবনী), নাটকসহ বহু গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
জন বার্থ: ২০ শতকের আধুনিক সাহিত্যিক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক জন বার্থ গত ২ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেণ। এ আমেরিকানের রচনা প্রায়শই পরাবাস্তবতা, বিমূর্ততা এবং জটিল কাঠামোর জন্য পরিচিত। তার লেখায় গল্প বলার পদ্ধতি, ভাষার ব্যবহার এবং সাহিত্যিক শৈলীর পরীক্ষামূলক প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। বার্থের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে ‘ফ্লুকি’ এবং ‘গোল্ডেন হ্যারেলড’ উল্লেখযোগ্য।
পল বেঞ্জামিন অস্টার: আমেরিকান লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা পল বেঞ্জামিন অস্টার গত ৩০ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক ট্রিলজি’, ‘মুন প্যালেস’, ‘দ্য মিউজিক অফ চান্স’, ‘দ্য বুক অফ ইল্যুশনস’, ‘দ্য ব্রুকলিন ফলিস’। তার বই ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
ব্রেটেন ব্রেইটেনবাখ: দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক, কবি এবং বর্ণবাদের সমালোচক ব্রেটেন ব্রেইটেনবাখ গত ২৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে সাত বছর কারাগারে কাটিয়েছিলেন। তার প্রথম কবিতার বই ‘দ্য আয়রন কাউ মাস্ট সোয়েট’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বেশ কয়েকটি কবিতার বই, যা দক্ষিণ আফ্রিকায় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। সূত্র: ওয়েব সাইট