
প্রিন্ট: ০২ মার্চ ২০২৫, ০২:২৫ পিএম
কামাল দাউদের ফ্রান্স জয়

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ফরাসি সাহিত্যের যে পানপাত্রে একদা চুমুক দিয়েছিল বিশ্ববাসী, কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে এসে তা আর শুধু বিলাস নয়, অভ্যাসই বটে। বিশ্বে ফরাসি সাহিত্যের অবদান নিয়ে নিশ্চিতই অনেক অধ্যায় লেখা থাকবে। গঙ্কুর্ট প্রাইজ সেই ফরাসি সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার। প্রতি বছর এ পুরস্কার এমন একজন লেখককে প্রদান করা হয়, যিনি সাহিত্যে নতুন কিছু সংযোজন করেছেন এবং যার কাজ সময়ের সীমা অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে।
আলজেরিয়ার ১৯৯০-এর রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে এ বছর ফ্রান্সের এ সাহিত্য পুরস্কার প্রথমবারের মতো একজন আলজেরিয়ান লেখকের ঝুলিতে গেছে। ‘হুরিস’ উপন্যাসের জন্য কামাল দাউদ সম্মানজনক এ পুরস্কার লাভ করেন। উপন্যাসটি আলজেরিয়ার ‘অন্ধকার দশক’ নামে পরিচিত সময়ের বেদনাদায়ক ঘটনা বর্ণনা করে, যেখানে আনুমানিক দুই লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসলামপন্থি বিদ্রোহী বা সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়।
ফরাসি সাহিত্য জগতে কামাল দাউদের নামটি নতুন নয়। আলজেরিয়ার এ লেখক তার সৃজনশীল প্রতিভা ও সমাজের গভীরতর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছেন। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘হুরিস’ শুধু একটি সাহিত্যকর্ম নয়, এটি এক ধরনের সমাজ-দর্শন এবং অস্তিত্বের খোঁজ। ‘হুরিস’-এ কামাল দাউদ যে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতা ফুটিয়ে তুলেছেন, তা পাঠকদের চিন্তার গভীরে টেনে নেয়। গঙ্কুর্ট প্রাইজ জয় কেবল কামাল দাউদের ব্যক্তিগত সাফল্য নয়; এটি আলজেরিয়া এবং গোটা উত্তর আফ্রিকার সাহিত্যিক পরিচয়ের প্রতীক। দাউদের লেখনী দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক জটিলতাগুলোকে আলোচনায় এনে বিশ্বজুড়ে পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। ‘হুরিস’-এর ক্ষেত্রে তিনি এ দক্ষতাকে আরও শানিত করেছেন।
‘হুরিস’ শব্দটি ইসলামিক বিশ্বাসে জান্নাতে নারীদের এক বিশেষ অবস্থানের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দাউদ তার উপন্যাসে এ প্রতীকটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটি আলজেরিয়ার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ধর্মীয় সংস্কারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এ উপন্যাসের নায়িকা ফাজর (আরবিতে যার অর্থ ‘ভোর’) সহিংসতার শিকার একজন বেঁচে থাকা নারী, যিনি ইসলামপন্থি যোদ্ধাদের হাতে গলা কাটার শিকার হয়েছিলেন। কথা বলার জন্য তাকে একটি স্পিকিং টিউব ব্যবহার করতে হয়। তিনি নিজের গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্মৃতি আকারে যুদ্ধের দুঃসহ অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেন। লেখক এখানে স্মৃতি ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে জীবন্ত করে তুলেছেন এবং আলজেরিয়ার ‘জাতীয় স্মৃতিচারণের নিষেধাজ্ঞা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ফরাসি ভাষায় রচিত এ বইটি ‘আলজেরিয়ার এক অন্ধকার সময়ের কষ্ট, বিশেষ করে নারীদের ভোগান্তি, তুলে ধরে,’ বলে জানিয়েছে গঙ্কুর্ট কমিটি। ‘এটি দেখায়, ইতিহাসের বিবরণের পাশাপাশি সাহিত্য কীভাবে স্মৃতির একটি ভিন্ন পথ রচনা করতে পারে।’ কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, আলজেরিয়ায় খুব কম লোকই সম্ভবত এ বই পড়তে পারবেন। কারণ বইটির কোনো আলজেরিয়ান প্রকাশক নেই। এবং দাউদের গঙ্কুর্ট জয়ের খবর এখনো আলজেরিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। আরও খারাপ বিষয় হলো, দাউদ-যিনি এখন প্যারিসে বসবাস করেন-গৃহযুদ্ধ নিয়ে কথা বলার জন্য তাকে অপরাধমূলক মামলার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।
আলজেরিয়ার ২০০৫ সালের একটি ‘রেজোলিউশন’ আইন অনুযায়ী ‘জাতীয় ট্র্যাজেডির ক্ষতকে কাজে লাগানো’ একটি অপরাধ, যার শাস্তি হতে পারে জেল। দাউদের মতে, এর ফলে সেই গৃহযুদ্ধ-যা পুরো দেশকে আঘাত করেছিল-এক নিষিদ্ধ বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘আমার ১৪ বছরের কন্যা আমাকে বিশ্বাস করেনি যখন আমি তাকে এসব ঘটনার কথা বলি, কারণ স্কুলে এ যুদ্ধ সম্পর্কে পড়ানো হয় না। আমি আমার লেখায় কিছু ভয়াবহ দৃশ্য বাদ দিয়েছি। সেগুলো সত্য হলেও আমি জানতাম, মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করবে না।’
৫৪ বছর বয়সি দাউদ সাংবাদিক হিসাবে সে হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, কারণ তিনি তখন কোতিদিয়েন দ’ওরান সংবাদপত্রে কাজ করতেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে প্রতিদিন লাশ গোনা হতো এবং পরে কর্তৃপক্ষ সেই সংখ্যা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতেন তাদের বার্তা অনুযায়ী। ‘আপনি প্রতিদিনের একটি রুটিন তৈরি করে ফেলেন,’ তিনি বলেন। ‘বাড়ি ফিরে আসেন, প্রতিবেদন লেখেন, তারপর সব কিছু ভুলে থাকার জন্য মদ্যপান করেন।’
তিনি বহু বছর কলামিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন, কিন্তু ধীরে ধীরে আলজেরিয়ান সরকারের সঙ্গে তার মতবিরোধ তৈরি হয়, কারণ তিনি তাদের অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। ‘আমি আশা করি, আমার বই মানুষকে স্বাধীনতার মূল্য (বিশেষ করে নারীদের) নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করবে। এবং আলজেরিয়ায়, এটি লোকদের একটি অংশকে বাকি অংশগুলোর ওপরে প্রাধান্য না দিয়ে পুরো ইতিহাসের মুখোমুখি হতে উৎসাহিত করবে।’
২০২০ সালে দাউদ ‘পরিস্থিতির চাপে নির্বাসিত হয়ে’ প্যারিসে চলে যান এবং ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ‘সব আলজেরিয়ানই ফ্রাঙ্কো-আলজেরিয়ান,’ তিনি বলেন। ‘ঘৃণা থেকে হোক বা ভালোবাসা থেকে।’ আলজেরিয়ায় তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তার শত্রুরা তাকে একজন বিশ্বাসঘাতক মনে করেন, যিনি ফ্রান্সের কাছে তার আত্মা বিক্রি করেছেন। আবার অন্যরা তাকে একজন সাহিত্যিক প্রতিভা হিসাবে চেনেন, যাকে দেশটির গর্ব হিসাবে দেখা উচিত।
১৯৭০ সালে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করা কামাল দাউদের সাহিত্য ও ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা গড়ে ওঠে শৈশব থেকেই। সাংবাদিকতার পেশায় যোগ দিয়ে তিনি তার কলমকে বুলেটের মতো ধারালো করে তোলেন। ‘দ্য মুরসল্ট ইনভেস্টিগেশন’ তার প্রথম উপন্যাস, যা তাকে রাতারাতি সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত করে। এ বইটি আলবেয়ার কামুর ‘দ্য আউটসাইডার’-এর একটি অনানুষ্ঠানিক উত্তর, যেখানে তিনি উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে উপনিবেশিতের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেন।
কামাল দাউদের লেখনীতে রয়েছে একটি ছন্দময় এবং গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক আঙ্গিক। ‘হুরিস’-এর ভাষা সরল হলেও এর ভেতরে রয়েছে জটিল দার্শনিক বার্তা। দাউদ বিশেষভাবে দক্ষ কাহিনির চরিত্র এবং পরিবেশের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। তিনি পাঠকদের এমন এক জগতে নিয়ে যান, যা একাধারে পরিচিত এবং অপরিচিত। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি ধর্মীয় শাসন এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নিজের পরিচয় খুঁজছেন। এখানেই দাউদ তার লেখার গভীরতা দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি সমাজ তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে, আবার একই বিশ্বাস কীভাবে মানুষকে বন্দি করে রাখে। ‘হুরিস’ মূলত একটি সীমাবদ্ধ সমাজের প্রতীক, যেখানে নারীদের ভূমিকা, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতার অভাব দেখা যায়।
গঙ্কুর্ট পুরস্কার পাওয়ার পরের সংবাদ সম্মেলনে দাউদ বলেন, ফ্রান্সে না আসলে তিনি ‘হুরিস’ লিখতে পারতেন না। ‘ফ্রান্স আমাকে লেখার স্বাধীনতা দিয়েছে। এটি লেখকদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল,’ তিনি বলেন। ‘লেখার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন : একটি টেবিল, একটি চেয়ার এবং একটি দেশ। আমার কাছে এ তিনটি রয়েছে।’
গঙ্কুর্ট পুরস্কার শুধু একটি সাহিত্যিক সম্মান নয়; এটি একজন লেখকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কামাল দাউদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি উত্তর আফ্রিকান লেখক হিসাবে তার এবং তার সমাজের কণ্ঠস্বরকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরেছে। ‘হুরিস’ গঙ্কুর্ট জয়ী হওয়ার ফলে এ উপন্যাস আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা আলজেরিয়া এবং গোটা মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে। এটি একাধারে একটি মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং সামাজিক সমালোচনা। গঙ্কুর্ট পুরস্কার জয় করে ‘হুরিস’ শুধু কামাল দাউদকেই নয়, আলজেরিয়ার সাহিত্যকেও একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
‘হুরিস’-এর মতো সাহসী এবং চিন্তাপ্রসূত সাহিত্যিক কাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সাহিত্যের শক্তি কেবল বিনোদন নয়; এটি পরিবর্তনের হাতিয়ার। কামাল দাউদ এ উপন্যাসের মাধ্যমে সে পরিবর্তনের বার্তাই দিয়েছেন। উপন্যাসটি সেই পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যারা ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যদিও হুরিস সাহসী এবং উদ্ভাবনী, তবে কিছু সমালোচক মনে করেন, দাউদ ধর্মীয় বিষয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিতর্কিত করেছেন। অন্যদিকে, অনেকেই মনে করেন, তার লেখনী প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
সূত্র : বিবিসি ও ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর