স্বাতন্ত্র্য স্বরের কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন
এমরান কবির
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কবির দেখা আর সাধারণ মানুষের দেখা কখনোই এক হয় না। সেজন্য সাধারণ মানুষের দেখায় যে উপলব্ধির জন্ম হয়, কবির দেখায় সে উপলব্ধি ভিন্নতর হয়। এভাবে যে কোনো কবির সঙ্গে অন্য যে কোনো সাধারণ মানুষের পার্থক্য রচিত হয়ে যায়। কবিতে কবিতে দেখার পার্থক্যেও বিস্তর ফারাক। কারও কারও দেখাটা নিছকই দেখাতেই সীমাবদ্ধ। কারও কারও দেখাটা পর্যবেক্ষণে পর্যবসিত, কারও কারও দেখা হৃদয়ের প্রতিফলনে বিদ্ধ, কারও কারও দেখা মস্তিষ্কের হিসাব-নিকাশে সীমাবদ্ধ।
কবি থেকে কবিতে দেখার এ পার্থক্য তাদের রচিত কবিতার মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। এ দেখা বা পর্যবেক্ষণ যার যত ভিন্নতর হয়, যার যত হৃদয়গ্রাহী হয়, মনোগ্রাহী হয়, তিনি তত স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা এ দেখা ও পর্যবেক্ষণের পার্থক্যে চিহ্নিত। কীভাবে? তা আলোচনা করার আগে তার বাল্মিকী নামক কবিতার কিছু অংশ পাঠ করা যেতে পারে-সবাই যা চেয়েছিলো/তা হইনি আমি/হয়েছি রত্নাকর বাল্মিকী/ব্যাংক ভোল্টের টাকা/ধনীদের সম্পদ/এসব আমার করতলগত/ভয়ে ভূস্বামী দিয়েছে শস্য/মজুদতার মুদ্রা/কিন্তু আমি অরণ্যের বৃক্ষে চালাইনি কুঠার/কারো হৃদয়ের হাসিতে বাধ সাধিনি/বরং পাখির চোখের পানি মুছে দিয়েছি/চিতা থেকে তুলে এনেছি কান্না/... লিখেছি শ্লোক আর লক্ষ্যভেদী অভিসম্পাত/দেবতা ও মানুষের পার্থক্য/সবাই যা চেয়েছিলো তা হইনি আমি’
বাল্মিকীর ছদ্মাবরণে তিনি আসলে নিজের কথা বলে যান। যেখানে দেখা যায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ। দৃষ্টি আলাদা বলেই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা পাই আমরা। সবাই যা হতে চায় তিনি তা হতে চান না। তিনি বৈষয়িকতার বিপরীতে প্রাকৃতিকতার পক্ষে কখনো কুঠার হাতে অরণ্যে বৃক্ষের বুকে আঘাত করেননি। এমনকি পাখির চোখের কান্নাও তিনি মুছে দেন।
সত্যি সবাই যা চেয়েছিল তা হননি তিনি। বাল্মিকীর সঙ্গে আত্মপ্রক্ষেপণের মাধ্যমে তিনি মূলত করে ফেলেন নিজেরই আত্মসংশ্লেষণ। যা নির্মম ও শৈল্পিক স্বীকারোক্তিও।
কবিতায় কবির আত্মসংশ্লেষণ থাকবে। সাধারণের কবিতায় তা যেরূপে শিল্পীত তা অনন্য। তা অন্য কারও কাবিতায় একইভাবে পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কবিতায় এ উপাদান উপস্থিত থাকে অজান্তেই, আড়ালে, কখনো নিষ্ক্রিয়রূপে আবার কখনো সহজাতভাবে। কিন্তু স্টালিন এখানে তা প্রয়োগ করেছেন বা তুলে এনেছেন সচেতন শিল্পীতভাষ্যে। সুনির্দিষ্টতার মধ্য থেকে তিনি ইঙ্গিত করেছেন অনির্দিষ্টতার। দুয়ে মিলে হয়ে উঠেছে বহুল আরাধ্য কবিতার অপেন এন্ডিং এবং প্যারাডক্স। ফলে তার আপাত সুনির্দিষ্টতা যা আধুনিক কবিতায় সবচেয়ে দুর্বল উপাদান হিসাবে মনে করা হয় তার উপস্থিতি আর থাকে না। কবিতা হয়ে ওঠে বিশেষ দ্যোতনাময়, ভিন্নাথির্ক গতিসিদ্ধ এবং বারবার পাঠ্য-আকর্ষণীয়।
প্রতিগল্প নামের কবিতা নিয়ে কথা না বললে স্টালিন কবি হিসাবে কতটা শক্তিমান তা অজানাই থেকে যাবে। স্বরবৃত্তের লেখা কবিতাটি যেন বিশ-একুশ শতকের আয়না। আমরা তো গল্প নিয়ে ব্যস্ত, আপাত সরলপ্রাপ্তির আশায় উদ্বেল। কিন্তু ভেতরের গল্প সম্বন্ধে উদাসীন। এখানেই আমরা ব্যর্থ। কবি চোখে আঙুল দিয়ে প্রতিগল্পের মাধ্যমে শোনাচ্ছেন আসল গল্প। দৃশ্যমান গল্প কখনোই প্রকৃত গল্প নয়। আড়ালে থাকে আসল গল্প
ঘরের আছে একটা দেওয়াল থাক সে/জন্ম আমার বিশ শতকের বাক্সে।/...পা বাড়ালাম বাইরে যাওয়ার জন্য/ একুশ শতক বলল জীবন ধন্য।/কিন্তু আমি পিছলে পড়া বিশ্ব/ উপনিবেশ-ফন্দিতে সব নিঃস্ব/ঋণের স্রোত ভাসছে বোকার ফূর্তি/ দাদাগণ তো যিশুর প্রতিমূর্তি/দিচ্ছে সবই খাদ্য এবং বস্ত্র/শর্ত কেবল কিনতে হবে অস্ত্র।/যাক ভেসে সব দুর্যোধনের চুক্তি/কি প্রয়োজন হত্যার এ প্রযুক্তি
জন্ম বিশ শতকে হলেও একুশ শতকের একটা অংশে তার সৃষ্টিশীল জীবন চলমান। বদ্ধ জীবন পেরিয়ে এসে একুশ শতক জীবনকে ধন্য করার উপাদান নিয়ে হাজির। কী এসব? চোখ ধাঁধানো অস্ত্র, ড্রোন, মুঠোফোন ইত্যাদি। কিন্তু আড়ালে আমরা যারা তিৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা তারা তো সভ্যতার আভিজাত্যতা থেকে পিছলে পড়ে নিঃস্বাতিরিক্ত নিঃস্ব কেন? তার কারণ উপনিবেশিকতা। এ ঔপনিবেশিকতা এখন দৃশ্যমান না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বিরাজমান। এ যে অস্ত্রের ঝনঝনানি এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্বকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে অন্যদিকে খাদ্য বস্ত্র বিতরণের আড়ালে অস্ত্র বাণিজ্য চলমান। একুশ শতকের এ নির্লজ্জপনা থেকে বলা গল্পই ‘প্রতিগল্প’ কবিতাটি।
‘আমরা তো চাই শুনতে বাঁচার গল্প/চোখ ধাঁধানো লোভের যা বিকল্প’
চোখ ধাঁধানো রূপ ত্যাগ করার কথা তো তিনিই বলতে পারেন যিনি ভিন্নতর চোখ দিয়ে দেখেছেন আলো ঝলমলে পৃথিবীর ভেতরের ভয়াল অন্ধকার, ভিন্ন দৃষ্টির পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা না থাকলে কী সেটা কখনো হয়? হয় না। আমাদের সরল চোখে যা ধরা পড়ে না-তাইই তার চোখে ধরা পড়ে এজন্য। আর কবিতায় তা তুলে আনেন তিনি শিল্পীতরূপে।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার স্বাতন্ত্র্য এখানেই।