মার্কেট বা শপিংমল খুলতে দেরি হলেও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলো সকাল-সকাল খুলে যায়। আজও তেমনি খানপাড়ার গলির দোকানগুলোর বেশির ভাগই খুলেছে ওষুধের দোকান ছাড়া।
মূল সড়ক থেকে গলিটি শুরু হয়ে আরও কয়েকটি সরু গলি হয়ে খালের পাড়ে শেষ হয়েছে। এক সময় এ পাড়ায় সবাই ছিল স্থানীয়, গোটা দশেক ভাড়াটিয়া ছাড়া। তবে কয়েক বছর ধরে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ওঠায় এখন বাইরের অনেক লোকের বসবাস গড়ে উঠেছে।
পাড়ায় ঢুকতে ডানপাশে বেশ বড় একটি পুকুর ছিল। ছিল বলতে হচ্ছে কারণ, টলটলে সে পুকুরের অস্তিত্ব এখন নেই। দেড়-দু দশক ধরে খুব কৌশলে পুকুরটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এখন চতুর্দিকে টিনের বেড়া দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে। এক সময় এ পুকুরের তিন দিকে শানবাঁধানো ঘাট ছিল। সকাল-বিকাল আর সন্ধ্যায় সে ঘাটে আড্ডা দিত পাড়ার ছেলেবুড়ো সবাই। ডেভেলপারদের পাল্লায় সে পুকুর হারিয়ে গেল।
বাম পাশে গলি ঘেঁষেই সব দোকানপাট। হোটেল, মুদির দোকান, সেলুন, ফার্মেসি আর মোবাইল রিচার্জ ও বিকাশের এজেন্সি।
আজ দোকান খুলতে এসে সবাই খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। দুটি জোড়ালাগা কুকুর গলির মাঝ বরাবর আটকে আছে। ভাদ্র থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত কুকুরের প্রজনন মওসুম। এ সময় রাস্তাঘাটে এ দৃশ্য প্রায় দেখা যায়। এমন দৃশ্য দেখলে ছোটরা খুব অবাক হয়ে তাকায়। বড়দের প্রশ্নও করে।
এরই মধ্যে দুয়েকজন লাঠি দিয়ে কুকুর দুটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তাতে কাজ হয় না। কুকুর একটি এদিকে টানলে অপরটি উলটো দিকে টানে। এক সময় ব্যর্থ হয়ে তারা ফিরে যায় যার-যার কাজে। এ সময়টায় অনেকে অফিসে যায়। অনেকে তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিতে বের হয়।
প্রতিদিনের মতো আজও শফিউল্লাহ মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছে স্কুলের উদ্দেশে। এ জায়গাতে এসে মেয়েটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। জীবনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখেনি শিশুটি। গভীর আগ্রহ নিয়ে সে কুকুর দুটোর দিকে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, বাবা কুকুর দুটো এরকম কেন?
দৃশ্যটি দূর থেকেই দেখেছে শফি। কিছু করার নেই ভেবে দ্রুত হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আর মেয়ের মনোযোগ নিজের দিকে রাখতে স্কুল নিয়ে কথা বলছিল সে। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
‘চলো, চলো স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে’ বলে মেয়েকে এক ধরনের টেনেহিঁচড়ে গলির মুখে পৌঁছে শফি। স্কুল কাছে। প্রতিদিন হেঁটেই যায়। কিন্তু আজ দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে নিল সে।
মেজাজটা ভীষণ চড়ে আছে কুকুর দুটোর ওপর। মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত ফিরে আসে সে। এসে দেখে কুকুর দুটো তখনো একই অবস্থায় আছে। সে আবার তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করে। দোকান থেকে একটি লাঠি এনে কয়েকটি বাড়ি মারে। কিন্তু কোনোভাবেই ওদের তাড়াতে পারে না। হঠাৎ তার কী হয়। দৌড়ে গিয়ে পাশের হোটেলে ঢোকে। হোটেলের রান্নাঘর থেকে খুঁজে বের করে একটি বড় ছুরি। এবার কুকুর দুটির দিকে এগিয়ে যায় সে। আশপাশের দোকান থেকে সবাই না, না করে ওঠে। অনেকে তাকে বাধা দিতে এগিয়ে যায়। তবে তার আগে সে পৌঁছে যায় আর কেউ কিছু আন্দাজ করার আগেই জোড়া লাগা কুকুর দুটোর মাঝ বরাবর ছুরিটা চালিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। শফির মুখে হাতেও এসে পড়ে খানিকটা।
গগনবিদারি আওয়াজ করতে করতে একটি কুকুর দৌড়াতে থাকে। আর তার শরীরের রক্তে রাস্তা ভিজে যেতে থাকে। মাদি কুকুরটি ভয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে গলি থেকে বেরিয়ে মূল সড়ক ধরে পালাতে থাকে। আহত কুকুরটি কাতরাতে কাতরাতে পাশের টিনের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তার আর্তচিৎকারে পুরো পরিবেশটা ভারী হয়ে ওঠে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিহ্বল হয়ে পড়ে। কারও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। অবশ্য শফিকে বলার মতো মানুষও নেই পাড়ায়। শফি কারও দিকে তাকায় না, ছুরিটা একপাশে ছুড়ে ফেলে হোটেলে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে দ্রুত ঘরের দিকে রওয়না দেয়।
শফিউল্লাহদের তিন পুরুষের বাস এ এলাকায়। তার দাদা পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে এসে প্রথমে চাকরি পরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এক সময় এখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেন। শফির বাবাও গত হয়েছেন বছরপাঁচেক আগে। শফিরা দুভাই। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসা দেখেন দুজনেই। দোতলা বাড়ির ওপরতলায় থাকেন তার বড় ভাই। শফি নিচের তলায় দুসন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। শফির দাদা ও বাবা সমাজে বড় মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন। পাড়ার সালিশ-বিচার করতেন তারা। কিন্তু সে পরিবারে ব্যতিক্রম হয়েছে শফি। বড় ভাই শান্ত স্বভাবের হলেও শফি ছোটবেলা থেকেই ছিল বদরাগী ও উগ্র স্বভাবের। এক সময় মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। বিয়ের পর কিছুটা পরিবর্তন হলেও উগ্র স্বভাবটি বদলায়নি।
দুটি মেয়ে তার। বড়টি ক্লাস সিক্সে আর ছোটটিকে এখনো স্কুলে দেওয়া হয়নি। আজ রাতে তার ঘরে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তার শালি ও ভায়রাভাইকে। নাশতা সেরে বাজারে যাবে সে। খেতে বসে পরোটা মুখে দিতেই গা গুলিয়ে আসে তার। বমি এসে গলায় আটকে থাকে। টেবিল ছেড়ে বেসিনের দিকে ছুটে যায় সে। বমি করার চেষ্টা করে কিন্তু সামান্য তেতো পানি ছাড়া কিছুই বের হয় না।
‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলতে বলতে তার বউ পেছনে এসে দাঁড়ায়। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘শরীর খারাপ লাগছে?’
কয়েকবার বমি করার চেষ্টা করে শফি কিন্তু হয় না। মনে হয় কিছু একটা এসে গলায় আটকে আছে। কুলি করে টেবিলে বসে এক গ্লাস পানি খায়। একটু আগের ঘটনাটি বউকে বলে না সে।
বলে, ‘নাশতা খাব না এখন। বাজার করে এসে খাব। মনে হয় অ্যাসিডিটি বেড়েছে। একটা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট দাও।’
ট্যাবলেটটি খেয়ে বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। মুরগি কিনে তা কাটাতে দিয়ে মাছের দোকানে যায়। সেখানে মাছ কাটাতে দিয়ে গরুর মাংসের দোকানে আসে সে। দোকানিরা সবাই পরিচিত তার। মাংস কিনতে কিনতে মুরগি, মাছ কেটে তৈরি করে রাখবে তারা। দাম দিয়ে নিয়ে যাবে শফি।
মাংসের দোকানদার শফিকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কারণ শফি তাদের পারমানেন্ট কাস্টমার। কেনার সময় পাঁচ-ছয় কেজি একসঙ্গে কেনে। আজও রানের একটি অংশ দেখিয়ে পাঁচ কেজি দিতে বলে শফি।
ছুরিতে সামান্য শান দিয়ে রানের একটি অংশ দেখিয়ে দোকানি বলে, এইখান থেইকা দিই মামা, এইটা ভালো হইব-বলেই মাংসে ছুরি চালিয়ে দেয় লোকটি। মাংস কাটার সঙ্গে সঙ্গে কিছু রক্ত বেরিয়ে আসে মাংস থেকে। এ দৃশ্য দেখে শফির কিছু একটা ঘটে যায়। মনে হয় তার পুরুষাঙ্গেই ছুরি চালিয়ে দিয়েছে কেউ। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে প্যান্টের ওপর পুরুষাঙ্গের জায়গাটি চেপে ধরে সে। শফির এ অবস্থা দেখে ভড়কে যায় মাংসওয়ালা। তার হাত থেকে ছুরিটি নিচে পড়ে যায় আর অর্ধেক কাটা রানের মাংস ঝুলে থাকে হাড়ে। আশপাশ থেকে লোকজন ভিড় করতে থাকে। তারা ভেবেছিল কসাইয়ের ছুরিতে আহত হলো কিনা। কিন্তু সবাই খেয়াল করল শফি নাভির নিচের অংশ দুহাতের তালুতে চেপে ধরে আর্তনাদ করছে।
শফি এখানে আর দাঁড়াতে পারে না। ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। সে এবার দৌড়ে তাদের গলিতে ঢুকে পড়ে আর এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটতে থাকে। তার এ অবস্থা দেখে গলির দোকানদার থেকে শুরু করে আশপাশের ঘর থেকে অনেকে জড়ো হতে থাকে গলিতে। ঘটনা বুঝতে না পেরে শুধু পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
নাভির নিুস্থান দুহাতে চেপে ধরে গলির এমাথা থেকে ওমাথা ছুটতে ছুটতে এক সময় ধপাস করে পড়ে যায় সে যেখানে কিছুক্ষণ আগে কুকুরের অঙ্গচ্ছেদ করেছিল সে।
এতক্ষণ ধরে হতবিহ্বল হয়ে যারা এ দৃশ্য অবলোকন করছিল তারা ছুটে যায় সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখে চিত হয়ে পড়ে থাকা শফির নাভির কিছুটা নিচ থেকে প্যান্টের অংশটি রক্তে ভিজে চপচপে হয়ে আছে।
শফির কোনো সাড়াশব্দ নেই; তবে টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে তখনো কুকুরটির আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল।