Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ধ্রুপদী ভাষায় শৈল্পিক দলিল

Icon

মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধ্রুপদী ভাষায় শৈল্পিক দলিল

শওকত আলী’র ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি ইতিহাসের বিশেষ ক্রান্তিকালের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অস্পষ্ট ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত। ‘প্রদোষ’ অর্থ দিনের একটি বিশেষ সময়। যার দ্বারা মোটামুটি সূর্যাস্তের আগে-পরে দেড় ঘণ্টা সময়কে বোঝানো হয়। যা আলো এবং অন্ধকারের মাঝামাঝি মুহূর্ত। আর ‘প্রাকৃতজন’ শব্দের অর্থ নিতান্ত সাধারণ মানুষ-কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার কুমার, ডোম, হড্ডি, চণ্ডাল ইত্যাকার ব্রাত্যজন। প্রদোষকাল অতিক্রান্ত হলেই নেমে আসে ঘোর অন্ধকার তথা সংকট। সেভাবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় ‘শেষ বিকালে সংকটে নিতান্ত সাধারণ মানুষ’।

কী সেই সংকট, জানতে হলে আমাদের স্মরণ করতে হবে প্রায় আটশ বছর আগের ইতিহাস। আনুমানিক ১০৯৭-১২২৫ খ্রি. পর্যন্ত একশ বছরের কিছু বেশি সময় সেন বংশ বাংলা শাসন করে। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন সামাজিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। এ ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোক সমাজে অভিজাত ও কুলীন হিসাবে পরিগণিত হন। সেন শাসনামলে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থান ঘটে। লক্ষণসেনের সময় কৌলীন্য প্রথা কঠোর রূপ ধারণ করে। কৌলীন্য প্রথার অজুহাতে সেনরা নিুবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের ফলে অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং নিুবর্ণের হিন্দুরা অন্য ধর্ম ও সুফি-সাধকদের জীবনাচরণ দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। শিল্প ও সাহিত্যচর্চা হয়ে যায় রাজসন্তুষ্টি তথা ফরমায়েশনির্ভর। ক্ষেত্রকার, কুম্ভকার, জালিক, ডোম, হড্ডি প্রভৃতি ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম অত্যাচারের ফলে সমাজে চরম অস্থিরতা ও অসন্তোষ বিরাজ করে। এ প্রক্রিয়া সেন সাম্রাজ্যের সংহতিতে চিড় ধরায় ও পরিণামে বিনা বাঁধায় তুর্কি সেনা মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী’র কাছে রাজা লক্ষণ সেনের পতন ঘটে এবং তিনি পলায়ন করেন। সে সময় সমাজের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অসন্তোষের আলোকে শওকত আলী ধ্রুপদী ভাষ্যে তৎসম শব্দে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে রচনা করেন ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।

উপন্যাসের কাহিনি বিবৃত হয়েছে আত্রাই, পুনর্ভবা, করতোয়া নদী বিধৌত গৌড়বঙ্গ অঞ্চলকে ঘিরে। শুরুতেই দেখা যায় গুরু বসুদেব কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বের হয়ে যায় মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ। পথক্লান্ত শ্যামাঙ্গ বিশ্রামকালে গুরু বসুদেবের সঙ্গে তার মতদ্বৈধতার কথা স্মরণ করে। গুরুদেব তাকে শিখিয়েছেন মূর্তি নির্মাণের কলাকৌশল-গ্রন্থ থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি করে ব্যাখ্যা করেছেন মুদ্রা ও ভঙ্গি, ভাব-বিভাব, রস-অলঙ্কার। সেই গুরুর প্রতি সে ক্ষুব্ধ। কারণ মহাসামন্ত সুধীমিত্র তার নির্মিত মন্দিরগাত্রে মৃৎফলক স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করলে গুরু বসুদেব শ্যামাঙ্গকে মৃৎফলক তৈরির দায়িত্ব দেয়। মৃৎফলকে রামায়ণ কাহিনির চিত্রমালা পরিস্ফুটন করতে হবে। সে জানকীর বরমাল্য দান, রামের বনগমন, হনুমানের গন্ধমাদন বহন ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ মৃৎফলকে উৎকীর্ণ করেছিল। ওইসব ফলকের সঙ্গে আরও কটি মূর্তির ফলক তৈরি করে। প্রেমিকের কণ্ঠলগ্না ব্যাধ তরুণীর প্রণয়দৃশ্য ছিল একটি, শবর যুবতীর প্রতীক্ষার দৃশ্য, মাতৃময়ী ধীবর রমণীর সন্তানকে স্তন্যদানের দৃশ্য। এতে গুরু বসুদেব ক্রুদ্ধ হয়ে যায়। যদিও শ্যামাঙ্গ বলে-রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন সে প্রসঙ্গেই শবর যুবতীর কথা মনে হয়েছে-আর ধীবর মাতা গোদাবরী তীরের। বনবাসের দৃশ্যে অরণ্যচারী ব্যাধ যুবক প্রণয় কি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে? গুরু বসুদেব বলেন-ম্লেচ্ছ ব্রাত্যের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার না থাকলে তাদের প্রসঙ্গ কেমন করে মন্দির গাত্রের মৃত্তিকাপটে উৎকীর্ণ হতে পারে। শ্যামাঙ্গ বোঝাতে চেষ্টা করে মৃৎপট, শিলাপট-এসব তো আর মানুষ নয় নিতান্তই মৃত্তিকা অথবা শিলা-এসবের আবার পবিত্র অপবিত্র কী? এতে বসুদেব বিরক্ত হয়ে বলে-মৃত্তিকা, শিলা পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বত্র থাকলেও দেবতার পীঠস্থান কি সর্বত্র? তুমি আদেশের দাসমাত্র। আদেশ পালনের জন্য তোমাকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। মহাসামন্ত সুধীমিত্রের ফরমায়েশ অনুযায়ী তাকে মৃৎফলক তৈরি করতে হবে।

স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চায় বাধা পেয়ে ক্ষুব্ধ শ্যামাঙ্গ মৃত্তিকাপট নির্মাণ না করে ভূমি কর্ষণ করে তার জীবিকা নির্বাহের কথা বললে বসুদেব রুষ্ট হয়। শ্যামাঙ্গ চলে আসার আগে গুরু বসুদেব তাকে বলে-আমি জরদ্গব এক বৃদ্ধ-কিন্তু তুই না যুবাপুরুষ? তোর অসীম শক্তি রয়েছে-তুই কেন কৃপা ভিক্ষা করতে চাস? শিল্প রচনা কারও মুখাপেক্ষী থাকে না? শ্যামাঙ্গ ভাবতে থাকে গুরুদেব সুধীমিত্রের বিরোধিতা না করে অন্তরে সৎ থাকবে, মহান থাকবে, কিন্তু বাইরে কিছুই বলবে না, এভাবে কি শিল্পী জীবনযাপন করতে পারে?

পথে উজুবট গ্রামে শুকদেবের বাড়িতে রাত্রিযাপনকালে বিল্বগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে শ্যামাঙ্গ জানায় তণ্ডল বর্তমানে অধিক সুলভ নহে, গোধূম কদাচিৎ পাওয়া যায়-বস্ত্রাদি ক্রমেই মহার্ঘ হয়ে উঠছে, তৈজসাদির জন্য নৌযানগুলো আর আত্রেয়ী-করতোয়া সঙ্গম পর্যন্ত আসছে না, রাজপুরুষদের হাতে প্রায়ই মানুষ অহেতুক লাঞ্ছিত হয়। এখানে শুকদেবের শ্যালক দীনদাসের কাছে জানতে পারে যবনদের মধ্যে কোনো জাতপাতের বিভাজন নেই। প্রভূ-ভৃত্য একত্রে বসে আহার করে, উন্মুক্ত প্রান্তরে সমবেতভাবে প্রার্থনা করে। তাদের উপাসনার সম্মুখে কোনো বিগ্রহ, পূজার নৈবেদ্য, উৎসর্গ নেই অথচ উপাসনা হয়ে যাচ্ছে। তাদের ধর্মপুরোহিতের ব্যবহার সুমধুর। ডাকাতের হাতে নিহত পূত্র হারানো শুকদেব পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। পরিচয় হয় শুকদেব কন্যা মায়াবতী যার স্বামী বসন্তদাস বাণিজ্যে গেছে বলে জানতে পারে। মায়াবতী বাল্যসখী স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী প্রথম দর্শনেই শ্যামাঙ্গের মনে গেঁথে যায়।

পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের জনপদগুলোর তখন একই অবস্থা। গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষণাবতীতে শ্রী লক্ষণসেন অধিষ্ঠিত। রাজ সভায় রাজানুগ্রহ প্রাপ্ত উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূর্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। অভিজাত বিত্তশালীরা সুখে থাকলেও কেবল ব্রাত্যজনের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তোকপরি গৃহের আচ্ছাদন নেই। আজ গ্রামপতি বসবাসের স্থান দেয় তো, কালই দূর দূর তাড়িয়ে দেয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্দেহ করা হচ্ছে যবন কেন্দ্রগুলোতে কেন তাদের যাতায়াত এ বিষয়টিতে রাজপোদজীবীদের ভাবনা রয়েছে। শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভেদ, একে অপরকে লাঞ্ছনা করে, শোষণ করে, লুণ্ঠন করে। এই ছিল তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র। এ সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা নিুবর্ণের মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের স্পৃহা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে।

উপন্যাসের কাহিনি পরিক্রমায় সোমজিৎ উপাধ্যায়ের মতো কিছু চরিত্র ছিল, যারা তৎকালীন সমাজিক সংহতি রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। তার সাক্ষাৎ হয় প্রভাবশালী অমাত্য হলায়ুধ মিশ্রের সঙ্গে। তিনি জানান যবনদের আগমনে ধর্ম, জাতি কোনো কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা এ দেশ জয় করে নিলে তাদের দেশ শাসন করতে হবে। এ দেশীয় উচ্চ পদস্থদের সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। যবনরা আসলে তাদের উচ্চ শ্রেণির লোকেরা এ দেশীয় উচ্চ শ্রেণির লোকদের সঙ্গে সদ্ভাব করবে। যে নিচ, সে সর্ব অবস্থায় নিচ থাকবে। এদিকে সুফি সাধক মহাত্মা আহমদ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাজ নিগ্রহীদের যবন কেন্দ্রে আশ্রয় দিচ্ছেন। তার কাছে বসন্তদাস জানতে চায়-যবন সেনারা এ দেশে আসবে কিনা? জবাবে আহমদ জানায়, অবশ্যই আসবে-দস্যু যদি জানতে পারে যে দস্যুবৃত্তি করলে তাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, তাহলে সে কী করে বল?

এক সময় রাজা লক্ষণসেন নদীয়ার প্রাসাদ থেকে পলায়ন করে। হড্ডি এবং চণ্ডালেরা প্রতিদিনই সুফি আহমদের কাছে দীক্ষা নিতে আসে। যবন সেনাপতি কাফুর খার দলে প্রথমে দুইশ সৈন্য ছিল তা বেড়ে দুই হাজারে রূপ নেয়। উজুবটে এলে মহাসামন্ত হরিসেন তাদের বিপুল সমাদর করেন। অবাধে চলে নরহত্যা ও লুণ্ঠন। বেঘোরে প্রাণ হারায় শ্যামাঙ্গ। লেখকের ভাষায় মৃৎশিল্পীকে জীবিত থাকার অধিকার দেয়নি ওই সময়ের সমাজ-ইতিহাস।

লেখক উপন্যাসের চরিত্র চিত্রায়ণ, তৎসম শব্দ প্রয়োগে ভাষা, উপমা আর কাহিনি বিন্যাসে সুদূর অতীতের সমাজকে সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে অনন্য মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসে প্রায় আটশ বছর আগের আবছা ইতিহাসের আলোকে তৎকালীন মানুষের জীবনালেখ্য এবং সমাজচিত্র অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। কেননা, সে সময়ের সমাজব্যবস্থার পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়ার মতো ঐতিহাসিক সূত্র খুবই অপ্রতুল। পুত্রহারা শুকদেব পত্নী যোগমায়ার পুত্রস্নেহ, প্রোষিতভর্তৃকা মায়াবতীর বিরহ, লীলাবতী-শ্যামাঙ্গের প্রেম, মন্দিরদাসী কৃষ্ণার দেশপ্রেম শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তৎকালীন মানুষের গার্হস্থ জীবনের চিত্র, ফরমায়েশি শিল্প নির্মাণ, বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান, পেশা, সাংস্কৃতিক চিত্র প্রভৃতি বিষয় লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঐতিহ্য চেতনা, শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির দাপট ইত্যাদির আবহে সমাজচেতনা ও মানবিক চেতনা এ দুয়ের সম্মিলিত প্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। পরিশেষে বলা যায় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ধ্রুপদী ভাষায় আবছা ইতিহাসের শৈল্পিক চিত্র-দলিল।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম